রহমত, বরকত ও নাজাতের অফুরান কল্যাণের বার্তা নিয়ে পুণ্য বৈভবে এলো পবিত্র রমজান। রমজান ত্যাগ ও সংজমের মাস। সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মাস। অমূল্য রতন তাকওয়া অর্জনের মাস। ক্ষমা-মার্জনা ও অনুকম্পায় বিগলিত হওয়ার মাস। রমজান বান্দার দৈহিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি প্রশিক্ষণের মাস। সিয়াম সাধনার মাস।
মহান রব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেভাবে দেওয়া হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। (সুরা বাকারা :১৮৩)। এই মুত্তাকি বা পরহেজগার শব্দটি অতীব তাত্পর্যপূর্ণ। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্যের পার্থক্য নিরূপণপূর্বক কেবল ভালো, ন্যায় ও সত্যের পথে অবিচল থেকে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ একনিষ্ঠভাবে পালন করার মাধ্যেই যথার্থ তাকওয়া বা পরহেজগারি নিহিত, যা মুত্তাকির মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
লাওহে মাহফুজ থেকে অবতীর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ মানব জাতির জন্য আল্লাহর সর্বশেষ চিরন্তন, পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান আল কুরআন অবতীর্ণের মাস মাহে রমজান। হাজার মাসের চেয়েও অধিকতর মর্যাদা ও ফজিলতের রাত লাইলাতুল কদরের মোবারক মাস মাহে রমজান। এ মাসেই মহান রব্বুল আলামিন মানব জাতির হেদায়াতের উদ্দেশে বড় বড় আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। এই রমজান মাসেই হজরত দাউদ (আ.)-এর কাছে জবুর, হজরত মুসা (আ.)-এর কাছে তাওরাত, হজরত ঈসা (আ.)-এর কাছে ইনজিল ও রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতসমূহের মধ্যে একটি লাইলাতুল কদর রসুলে করিম (স.)-এর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ মহাগ্রন্থ কুরআন অবতীর্ণ করা হয়।
রমজান শব্দের অর্থ জ্বালিয়ে দেওয়া, পুড়িয়ে দেওয়া। মূলত মহান আল্লাহর মোহাব্বতে সিয়াম ব্রতের মাধ্যমে জীবনের সব অন্যায় আচরণ, পাশবিক প্রবৃত্তি, আল্লাহর নাফরমানী, হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, পাশবিক প্রবণতাকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে, আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মানবিক বৃত্তির বিকাশ ও উন্মেষ সাধনই তাকওয়া। মূলত ইহসান ও তাজকিরার পবিত্র বিশুদ্ধ স্তরে উপনীত হওয়াই সিয়ামের মহান শিক্ষা। মহান রব্বুল আলামিন বলেন, ‘রমজান মাস হচ্ছে এমন মাস, যে মাসে কুরআন নাজিন করা হয়েছে। আল কুরআন হচ্ছে মানব মণ্ডলীর জীবনপথের দিশা ও সুস্পষ্ট প্রামাণ্য, হিদায়াত, হক ও বাতিলের পার্থক্য নির্ণয়কারী মানদণ্ড। তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ অথবা সফররত থাকবে, সে যেন পরবর্তী কোনো সময়ে গুনে গুনে তা আদায় করে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতর করতে চান, তিনি তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না। তোমারা গণনা করে পূর্ণভাবে সিয়াম আদায় করো, আর আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব প্রকাশ করো। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পরিপূর্ণ জীবনের হেদায়াত দিয়েছেন, যাতে করে তার কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারো।’ (সুরা বাকারা :১৮৫)
প্রকৃত পক্ষে সাওম শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, বিরত করা ও বিরত রাখা। যে মুসলিম জনগোষ্ঠী সিয়ামের মাধ্যমে শুধু সুনির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত পানাহার, কামাচার হতে বিরত থাকে অথচ পরিপূর্ণ জীবনধারায় আল্লাহদ্রোহী জীবনধারা হতে বিরত থাকে না। তাদের সিয়াম সাধনা নিছক আনুষ্ঠনিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অন্যদিকে রোজার মাধ্যমে মুমিনগণ স্বাস্থ্যগতভাবেও উপকৃত হন। যখন আমরা খাওয়া বন্ধ রাখি এবং খাওয়ার যন্ত্রকে বিরতি দেই, তখন দেহে সংরক্ষিত জীবনীশক্তির এক নবজীবনের উদ্ভব হয়। ডা. জুয়েলস এম ডি বলেন, ‘যখন একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখন দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে। খাদ্যের পরিপাক ও আত্তীকরণে যে শক্তি ব্যয় হয়, খাওয়া বন্ধ করে আমরা যদি সেই শক্তি অন্যদিকে নিয়োজিত করি, তবে দেহের অপ্রয়োজনীয় বিষাক্ত অংশ বিতাড়িত করতে পারি। পরিপাক প্রণালি যখন তার আত্মীয়করণে বিরত দেয়, তখন পাকস্থলী ও অন্ত্রের শ্লৈষ্মিক-ঝিল্লি দেহযন্ত্র থেকে জীর্ণ পদার্থগগুলোকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। অন্ত্রের ও পাকস্থলীর শ্লৈষ্মিক আবরণী খাদ্যবস্তু পরিপাকের বেলায় অনেকটা স্পঞ্জের মতো কাজ করে। অতিভোজনের ফলে দেহের স্নায়ুকোষে বিষক্রিয়া দেখা দেয়। ফলে শরীরে নেমে আসে অস্বাভাবিক ক্লান্তিবোধ ও জড়তা। সিয়াম প্রতিষেধকের কাজ করে।
প্রতিটি রোগের পেছনে কোনো না কোনো কারণ রয়েছে। তবে জীবাণুবাহিত রোগগুলোর মধ্যে ব্যাক্টেরিয়াম, ভাইরাস প্রধান। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে, উপবাসের ফলে অনেক জীবাণু মারা পড়ে। ডা. ডিউই বলেছেন, জীর্ণ ও ক্লিষ্ট রুগ্ণ মানুষটি উপোস থাকছে না, সত্যিকারভাবে উপোস থাকছে রোগটি। চিকিত্সাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটিস বলেছেন, ‘অসুস্থ দেহে যতই খাবার দেবে, ততই রোগ বাড়তে থাকবে।’ গ্রাহাম বার্থলো জেনিংস প্রমুখ গবেষক বিষয়টি সত্য বলে প্রতিপন্ন করেছেন। অধিক পানাহারের অন্তর প্রাণহীন হয়ে যায়। রসুল (স.) বলেন, ‘অতিরিক্ত পানাহার দ্বারা অন্তরকে প্রাণহীন কোরো না। কেননা, অন্তর শস্যক্ষেত্রস্বরূপ।’ খেতে অতিরিক্ত পানি দিলে খেতের উর্বরতাশক্তি বিনষ্ট হয়। ক্ষুধার সময় আত্মা নির্মল ও পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে।
লেখক: মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ, অধ্যক্ষ, শ্যামপুর, কদমতলী রাজউক মাদরাসা, ঢাকা
 
                           
                           
                            
                       
    
 
 


 ঠিকানা অনলাইন 
                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
