Thikana News
০৮ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫

উপমহাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে কুফা দেশ পাকিস্তানের সরকার ও রাজনীতি সম্বন্ধে কিছু কথা

উপমহাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে কুফা দেশ পাকিস্তানের সরকার ও রাজনীতি সম্বন্ধে কিছু কথা



 
শহীদুল ইসলাম তালুকদার এই লেখার বাকি অংশ আর শেষ করতে পারেননি। গত ১৫ মার্চ রোববার বিকেলে নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুর ১০-১২ দিন আগে ঠিকানা অফিসে সশরীরে এসে তিনি লেখাটি দিয়ে গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে ঠিকানা পরিবার শোকাহত। শহীদুল ইসলাম তালুকদার ছিলেন একাধারে লেখক, মানবাধিকার কর্মী, সাউথ এশিয়া ওয়াচ হিউম্যান রাইটস নিউইয়র্কের সেক্রেটারি জেনারেল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।)

তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জিন্নাহর তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে কোনোমতে গোঁজামিল দিয়ে তড়িঘড়ি করে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একদম পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল জিন্নাহ ও লিয়াকত চক্র। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাকে ভয় করতেন বলে তারা খাজা নাজিমুদ্দিনের মতো একজন মেরুদণ্ডহীন নেতাকে তাদের পক্ষে নিয়ে স্বাধীনতার পরক্ষণে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বানালেন। চামচা হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দিনের কপাল খুবই ভালো ছিল। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিনকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল বানানো হলো। ১৯৫১ সালে যখন লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হন, তখন খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।
পাকিস্তানের এককালীন আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল আজিজ মুন্সীর সঙ্গে করাচিতে আমার দেখা হয়। তিনি একটা মজার তথ্য দিলেন। তিনি বলেছিলেন, তার চাচা এম এন মুন্সী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পারসোনাল সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি বলেছেন, সাধারণত গভর্নর জেনারেলরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক উচ্চমহলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খাজা নাজিমুদ্দিনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। পাকিস্তানের উচ্চমহলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিশেষ করে আইয়ুব খান ও কয়েকজন আইসিএস অফিসারের কারসাজিতে খাজা নাজিমুদ্দিনকে একরকম জোর করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে রাজি করানো হয়। তখন নিয়মানুযায়ী গভর্নর জেনারেল প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দিতে গিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটাতে হলো। খাজা নাজিমুদ্দিন তখন লিখলেন, ‘আই খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান অ্যাপয়েন্টিং খাজা নাজিমুদ্দিন অ্যাজ দ্য প্রাইম অব পাকিস্তান।’ এই ছিল খাজা নাজিমুদ্দিন!

পাক-ভারতের স্বাধীনতার পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল থেকে যান। লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তানেরও গভর্নর জেনারেল থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব গোঁ ধরলেন গভর্নর জেনারেল হওয়ার জন্য। জিন্নাহর যে ক্যানসার হয়েছিল, তা তার বোন ফাতেমা জিন্নাহ ছাড়া অন্য কেউ জানতেন না। লর্ড মাউন্টব্যাটেন, নেহরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল, মওলানা আজাদ এটা জানলে পাকিস্তান স্বাধীনতা পেত না। যা হোক, মালিক গোলাম মোহাম্মদ গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর প্রথমেই খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। পরবর্তী সময়ে তখনকার পার্লামেন্টের স্পিকার মৌলভী তমিজউদ্দিন গভর্নর জেনারেলের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে কেস ফাইল করেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। কারণ আইয়ুব খানসহ বেশ কিছু বড় মাপের আমলার কারসাজিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় মৌলভী তমিজউদ্দিনের বিরুদ্ধে যায়। আর এভাবেই রাজনৈতিক কুফা গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের হাতেই পাকিস্তানের গণতন্ত্রের পুরোপুরি কবর ঘটে।

এখানে মৌলভী তমিজউদ্দিনের কিছুটা পরিচয় দেওয়ার আবশ্যকতা মনে করছি। মৌলভী তমিজউদ্দিনের বাড়ি ফরিদপুরে। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের একজন জাঁদরেল নেতা। তিনি অবিভক্ত বাংলায় শেরেবাংলা মন্ত্রিসভার একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন। তা ছাড়া তিনি ছিলেন কুখ্যাত নুরুল আমিনের বেয়াই।
এখানে একটা ব্যাপারে কিছু কথা বলা আবশ্যক মনে করছি। আমাদের বাংলাদেশের মানুষ পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তাকে আল্লাহ তায়ালা বলি, কিন্তু পাকিস্তানিরা আল্লাহ তায়ালাকে ‘আল্লাহ মিয়া’ বলে সম্বোধন করে। তাই পাকিস্তানিরা, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীরাই খাজা নাজিমুদ্দিনকে নির্বুদ্ধিতার জন্য ‘আল্লাহ মিয়া’ বলত।
একবার পাকিস্তানের সাংবাদিকেরা স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী দুজনের মধ্যে কার ক্ষমতা বেশি?’ জাতীয় বলদ খাজা নাজিম বলেছিলেন, ‘আমি যখন গভর্নর জেনারেল ছিলাম, তখন দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বেশি। তবে যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, তখন ক্ষমতা বেশি ছিল গভর্নর জেনারেলের।’


উল্লেখ্য, ১৯৬৪-৬৫ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিন্নাহর পক্ষে পিরোজপুরে এক জনসভায় মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য কিছু নেতার সঙ্গে চোস্ত পাজামা পরিহিত খাজা নাজিমুদ্দিনকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। করাচিতে খাজা নাজিমুদ্দিনের দুই ছেলেÑখাজা মহিউদ্দিন ও খাজা সাইফুদ্দিনের সঙ্গে ২০-২২ বছর আগে দেখা হয়েছিল। খাজা মহিউদ্দিন ব্যবসা করতেন ও খাজা সাইফুদ্দিন একটা বেসরকারি সংস্থায় জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন, যার বস ছিলেন সিলেটের কোনো এক চৌধুরী সাহেব। তাদের মুসলিম লীগ বা অন্য কোনো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। খাজা নাজিমুদ্দিনের ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দিন আইয়ুব খান মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েক বছর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। পরে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। খাজা শাহাবুদ্দিনের ছেলে ছিলেন লে. জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে।

গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। ইস্কান্দার মির্জাই পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলাইমান পাকিস্তানেই ছিলেন আগাগোড়া। তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মহিলা। সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে হিসেবে পাকিস্তান সরকার তাকে বহু বছর যাবৎ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেয়। সোহরাওয়ার্দীর নাতনি ব্যারিস্টার সাহিদা জামিল পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন। তার সঙ্গে আমার করাচিতে দেখা হয়েছে। বেগম আখতার সোলাইমান ও তার মেয়ে ব্যারিস্টার সাহিদা জামিলের কখনো খোঁজ নেয়নি বঙ্গবন্ধু সরকার বা তার পরবর্তী বাংলাদেশের কোনো সরকার। ব্যারিস্টার সাহিদা জামিল দুঃখ করে বললেন, ‘আমার নানা বাংলাদেশের অনেক নেতাদের নেতা ছিলেন, কিন্তু তার মৃত্যুর পরে কেউ আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয়নি।’

এরপর বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাবা ফজলুর রহমান পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। সালমান এফ রহমানের বোনের বিয়ে হয়েছে পাকিস্তানের এককালীন প্রধানমন্ত্রী আই আই চুন্দ্রিগড়ের ছেলে ব্যারিস্টার আবু বকর চুন্দ্রিগড়ের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে করাচিতে আমার দেখা হয়।
তা ছাড়া খাজা খায়েরউদ্দিন ফ্যামিলি নিয়ে করাচিতেই আছেন। খাজা সাহেব পাকিস্তান মুসলিম লীগের একাংশের নেতা ছিলেন। ভুট্টো সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুখ্যাত নুরুল আমিন এবং তার সাথি ও তৎকালীন পিডিপির সেক্রেটারি মাহমুদ আলীকে যথেষ্ট সম্মানে সম্মানিত করেছে। নুরুল আমিনকে পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিল এবং মাহমুদ আলীকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের আজীবন মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে। তা ছাড়া নুরুল আমিনের মৃত্যুর পর জিন্নাহর মাজারের কাছেই তার কবর দিয়েছে। জিন্নাহর মাজারের সঙ্গে বাকি কবরগুলোর মধ্যে বেগম ফাতেমা জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, সরদার রব নিস্তারের (প্রধানমন্ত্রী) মাজার আছে।
পাকিস্তানে বহুবার সফর করেছি, যেমন করেছি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে।
আমার এই লেখা ছাপা হওয়ার পরে হয়তো পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সাময়িকভাবে দূর হতে পারে। আমার লেখার বাকি অংশ পরবর্তী সংখ্যায় শেষ করার আশা রাখছি।
 

কমেন্ট বক্স