কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কথা খুবই ঘুরপাক খাচ্ছেÑনারী কিসে আটকায়? কেউ বলেছেন নারী আটকায় বিয়েতে, কেউ বলেছেন নারী আটকায় লেখাপড়া না করতে পেরে মানে অশিক্ষায়, আবার কেউ বলেছেন নারী আটকায় তাদের সন্তানদের জন্য। হয়তো ভাবছেন আমি আজ এত দিন পর কেন এ বিষয় নিয়ে কথা বলছি? এর কারণ যতবারই নারীর আটকে যাওয়ার কারণগুলো পড়েছি বা দেখেছি, ততবারই মনের অজান্তে মনের ভেতর অনেক ক্ষোভ আর দুঃখ ঢেউ খেলে গিয়েছে। মনের ভেতরে অনেক কথামালা শুধু ঘুরপাক খেয়েছে।
আজ সকল নারীর মনের কথাগুলো অকপটে বলব বলে এসেছি। আসলেই কি কোনো অর্ধশিক্ষিত নারী শুধু কম শিক্ষার কারণে জীবনে আটকে যায়? না, আসলে আটকে যায় শুধু আমাদের দুর্বল ঘুণে ধরা এই সমাজব্যবস্থায়। তা না হলে সেই একই নারী অন্য কোনো সমাজব্যবস্থায় কীভাবে স্বাবলম্বী? নির্বিঘ্নে সকল খাবার দোকান, গ্রোসারি এমনকি ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানে পুরুষের সমান পদচারণে সেই একই কম শিক্ষিত নারীরা যারা আমাদের সমাজব্যবস্থায় আটকে যায়, তারা দিব্যি দৌড়ে বেড়াচ্ছে, কই কম শিক্ষার কারণে আটকাচ্ছে না তো। আমাদের দেশে ও আমাদের সমাজে বিয়ে হয়ে গেলেই নারী আটকে গেল। কই আমরা যে এই দেশটাতে থাকি, এখানে তো বিয়ে নারীকে আটকায় না। এখানে একজন বঙ্গ নারীও বিয়ের পর চাকরি, লেখাপড়া, সন্তান সবই সামাল দিচ্ছে, আটকাচ্ছে না তো কোথাও।
আবার একজন নারী যখন মা হন, তখন সন্তান তার জীবনের বেঁচে থাকার শক্তি। সেই সন্তান কীভাবে নারীর দুর্বলতা হতে পারে। একটা সংসারে শত কষ্টের পরও একজন নারী মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে, কারণ সন্তান তার অপারগতা নয় বরং আমাদের নোংরা, পচা, গলা সমাজব্যবস্থা। নারী জানে যে সন্তান নিয়ে অথবা রেখে যেভাবেই বের হোক না কেন, এ সমাজের নিচু মানসিকতা তাকে কোনোভাবে শান্তি দেবে না। কেউ আবার ভাববেন না আমি নারীবাদী আর পুরুষবিদ্বেষী। এ রকম কিছুই নয়। নারী আসলে পুরুষের পাশেই সুন্দর, আবার পুরুষও নারীর সঙ্গেই সার্থক। কিন্তু নারী তখনই আটকে যায়, যখন সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা, নিচু মানসিকতা নারীর চলার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একজন নারী আটকে যায় তার সম্মানহীনতায়। আমাদের সমাজে শতকরা কত ভাগ নারী সম্মানের সঙ্গে জীবন পার করতে পারে? আমাদের সমাজে কত নারী, কত মা বাড়ির বাইরে, কর্মক্ষেত্রে অপমানিত অপদস্থ হয়েও কোনো প্রতিকার করতে পারে না, এমনকি অনেক সময় কাউকে বলতেও পারে না। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী নিজেই প্রশ্নের শিকার হয়ে যায়। যেমন ‘নিজে ভালো হলে জগৎ ভালো।’ এক হাতে কি আর তালি বাজে? ঠিক এই সময়টাতেই নারী আটকে যায়। নারীর যে পা দুখানা সকল বন্ধুর পথ নির্বিঘ্নে পাড়ি দেয়, সে পা দুখানা নিথর করে দেয় আমাদের সমাজের এই নিচু মানসিকতা। সারাক্ষণ অদৃশ্য এক প্রতিবন্ধকতার শেকল আটকে দেয় আমাদের সমাজের নারীর জীবন। হাতে হাত রেখে যে হাত রঙিন জীবন পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখাত, সে হাতই হয়তো কোনো একদিন নারীর নির্যাতনের কারণ হয়। প্রচণ্ড অপমানে, দুঃখে তখন নারী নির্বাক, স্তব্ধ হয়ে যায়। আবারও নারী আটকে যায় অমানবিকতার পৃষ্ঠতলে।
আমাদের সমাজে নারী আটকে যায় তার কাজ আর কৃতিত্বের সম্মানজনক স্বীকৃতি না পেয়ে। এই সমাজ, সংসার আর এই সমাজের তথাকথিত কিছু পুরুষ নারীদের রান্নাবান্না, ঘর-সংসার ছাড়া অন্য সকল কাজের প্রশংসা আর স্বীকৃতি দিতে ভয় পায়, ভাবে তারা নিজেরা ছোট হয়ে যাবে। অথচ নারীরা এখন দেশ চালাচ্ছে, ওই দূর আকাশে উড়ে উড়ে বিমান চালাচ্ছে। একজন শিক্ষিত নারী এই সমাজে আর সংসারে কত বিশাল ভূমিকা রাখেন, এই অবদানটা বুঝতে পারলে একজন নারী, যিনি মা, যিনি বোন অথবা যিনি স্ত্রী, তাকে তার সঠিক সম্মানটুকু দিতে হবে। তার কাজের ও সকল কৃতিত্বের সঠিক স্বীকৃতি দিতে হবে। একজন নারীর এ ছাড়া সমাজের কাছে আর কিছুই চাওয়ার নেই।



কানিজ ফাতেমা


