মুহম্মদ শামসুল হক
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের এক অজপাড়াগাঁয়ে মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুসের জন্ম। সংসারে প্রথম নবাগত হিসেবে জন্মের পঞ্চম দিনে ইসলামি শরিয়তমতে জোড়া খাসি জবাই করে যথারীতি আকিকা দেওয়া হয়েছিল। দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজন এবং পাড়া-পড়শিদেরও ভূরিভোজে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি ও ভূরিভোজ শেষে দাদিমার প্রস্তাব অনুসারে নবজাতকের নাম রাখা হয়েছিল মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস। অথচ বাবা-মা আদর করে ডাকতেন কুদ্দুস। বাবা আকবর আলী ভিনদেশি জাহাজে চাকরি করতেন বিধায় আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সবেধন নীলমণি হিসেবে শৈশবে কুদ্দুসের আদর-যত্ন ও আরাম-আয়েশের ইয়ত্তা ছিল না। সামাজিক প্রথানুযায়ী তিন-চার বছর বয়সে পাড়ার মক্তবেই কুদ্দুসের ধর্মীয় শিক্ষার হাতেখড়ি। অবশ্য তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অশিক্ষিত সমাজব্যবস্থায় পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুসের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার্জনের সূত্রপাত হয় প্রায় সাত বছর বয়সে। নাদুসনুদুস চেহারার কুদ্দুস গায়ে-গতরে তত দিনে কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রায় ১৩ বছর বয়সে বেশ সাফল্যের সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি মাড়িয়ে কুদ্দুস বয়ঃসন্ধিক্ষণে পদার্পণ করে এবং বাড়ি থেকে প্রায় দেড় ক্রোশ দূরবর্তী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। বয়ঃসন্ধিক্ষণে পদার্পণের পরপরই গায়ে-গতরে কুদ্দুস অনেকটা যুবকে পরিণত হয়েছে।
যাহোক, ছাত্র হিসেবে কুদ্দুস মোটামুটি মেধাবী ছিল বিধায় তার নিরক্ষর পিতা পুত্রকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন মনে মনে এঁকেছিলেন। অবশ্য ১৯৫০ এর দশকে গ্রাম-বাংলায় উচ্চশিক্ষিত তো দূরের কথা, মেট্রিক পাসের সংখ্যাও ছিল নিতান্ত হাতে গোনা। তখন গ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিএ পাস করা ছিল অনেকটা মহত্তম জীবনের গৌরব তিলক। এদিকে অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই কুদ্দুসের ছোটখাটো সচ্ছল সংসারে অনাকাক্সিক্ষত রাহুর পদচারণ ঘটে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আকবর আলী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় পরিবারের সদস্যদের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রাঘাত হয়। সামান্য ফসলি জমি কট-বন্ধক দিয়ে পিতা আকবর আলীর চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে অভাবদৈত্য সংসারে স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসে। কট-বন্ধকের অর্থে দেনা শোধ না হওয়ায় অগত্যা ফসলি জমিজমা বিক্রি করতে হয়। সংসারের ব্যয় মেটানোর দুশ্চিন্তায় তার মাও একপর্যায়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন এবং কিছুকাল ভোগান্তির পর অনেকটা বিনা চিকিৎসায় ইহলোকের পাট চুকিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমান। স্ত্রীর অকালপ্রয়াণে আকবর আলী আরও কাতর হয়ে পড়েন। অন্যদিকে অবর্ণনীয় শোক ও দুঃসহ বেদনা এবং শয্যাশায়ী পিতার সেবা-শুশ্রƒষা, প্রায় অন্ধ দাদিমার দেখভাল, রান্নাবান্না, আর্থিক অনটনÑসব মিলিয়ে কুদ্দুস দুশ্চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগল। নিকট সম্পর্কের কেউ না থাকায় এই চরম সংকটাপন্ন মুহূর্তে কুদ্দুস কাউকে কাছে পেল না। সাহায্য-সহানুভূতি তো দূরের কথা, একমাত্র সতীর্থ সফি উল্লাহ ছাড়া সবাই কুদ্দুসকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল।
মনুষ্যরূপী হায়েনাদের আচরণে ধৈর্যচ্যুত না হয়ে কুদ্দুস যাবতীয় প্রতিকূলতা ও ঘাত-প্রতিঘাত সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে লাগল। সেই চরম দুর্যোগঘন মুহূর্তে বুড়ো দাদিমার পরামর্শে দূরসম্পর্কের এক অনাথ বালিকাকে নববধূ হিসেবে সংসারে আনতে বাধ্য হলো কুদ্দুস। অনাথিনী ছালেহারও তিন কুলে কেউ ছিল না। কলেরায় অকালে পিতা ও মাতা মারা যাওয়ার পর রাতারাতি সে অনাথ হয়ে পড়েছিল। তখন পার্শ্ববর্তী ভদ্রলোকের বাড়িতে পেটভাতায় ছালেহা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেল। দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই ছালেহা সমকন্যা হয়ে উঠেছিল এবং অগতির গতি হিসেবে কুদ্দুসের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। পৈতৃক সূত্রে অনাথ ছালেহা সামান্য জোত-জমার মালিক হয়েছিল। কুদ্দুসের সঙ্গে সংসার রচনার পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে ছালেহা সেই সম্পত্তিটুকু বিক্রি করে অভাবগ্রস্ত কুদ্দুসের ঋণের বোঝা কিছুটা হালকা করল। পারিবারিক জীবনের সেই সূচিভেদ্য অন্ধকার রজনীতে কুদ্দুস পিতার কর্মজীবনের এক সহকর্মীর পরামর্শে পিতার একমাত্র সার্টিফায়েড ডুপ্লিকেট কপি (সিডিসি) নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দপ্তরে ধরনা দিল। নাদুসনুদুস চেহারা এবং শারীরিক বলিষ্ঠ গঠনের কারণেই ভাগ্যলক্ষ্মী কুদ্দুসের প্রতি মুখ তুলে তাকালেন এবং সে খুব সহজেই বৈধভাবে ভিনদেশি জাহাজে কাজ করার জন্য সিডিসি পেয়ে গেল। জাহাজে চাকরিলাভের সুযোগ পাওয়ায় কুদ্দুসের মনে হলো যেন বেহেশতের চাবি হস্তগত হয়েছে এবং পরিবারের সদস্যরাও আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ল।
প্রথম মাসের মাসোহারা হাতে পেয়েই কুদ্দুস চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি এল এবং শয্যাশায়ী পিতা, অন্ধ দাদিমা ও প্রিয়তমা পত্নীকে জড়িয়ে ধরে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করল। তৎকালে ভাগ্যচক্রে কেউ আমেরিকায় আসা ও থাকার সুযোগ পেলে তার সুখ্যাতি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ত। পাশের গ্রামের এক আমেরিকানের কল্পকাহিনি লোকমুখে শোনার পর থেকে কুদ্দুসও একদা আমেরিকায় পাড়ি জমানোর স্বপ্ন মনে মনে এঁকেছিল। তাই অভাবের তাড়নায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বার চিরতরে অবরুদ্ধ হওয়া এবং ভিনদেশি জাহাজে চাকরিলাভের পর কুদ্দুস আমেরিকায় পাড়ি জমানোর তাড়না তীব্রভাবে উপলব্ধি করল। ইতিমধ্যে সে বহু কষ্টে পার্শ্ববর্তী গ্রামের আমেরিকা প্রবাসী দুজনের নাম-ঠিকানাও সংগ্রহ করে ফেলল।
জাহাজে ওঠার আগেই কুদ্দুস পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ বাবদ মাসিক কিস্তি হিসেবে কিছু টাকা বরাদ্দ করেছিল। অবশেষে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, শয্যাশায়ী বাবা, অন্ধ দাদিমা সকলের অকৃত্রিম স্নেহ-মমতা-দরদ-ভালোবাসার স্নেহবন্ধন ছিন্ন করে অশ্রুসিক্ত বদনে কর্মস্থল অভিমুখে রওনা হলো। ছাত্রাবস্থায় কুদ্দুস শুনেছে, আমেরিকা আধুনিক বিশ্বের স্বর্গরাজ্য বা তিলোত্তমা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে গোটা বিশ্বের ভাগ্যান্বেষী জনসাধারণের বিন্দু বিন্দু ঘাম ও শ্রমের ফসল হিসেবে আমেরিকা ভূস্বর্গে পরিণত হয়েছে। অনবদ্য কারণে আমেরিকার প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির হাতছানিতে প্রলুব্ধ হয়ে বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ বহ্নিমুখ পতঙ্গের মতো শ্বাপদসংকুল ও দুর্লঙ্ঘ্য পথ পাড়িয়ে বৈধ-অবৈধ উপায়ে প্রতিনিয়ত নোঙর করছে আমেরিকার উপকূলে। আবার পঙ্গপালের মতো দলে দলে গৃহত্যাগী অসংখ্য নিয়তিলাঞ্ছিতের আমেরিকায় পৌঁছার আগেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটছে গভীর অরণ্যে, সলিলসমাধি রচিত হচ্ছে নদী-নালা-সাগর-মহাসাগরে। এদের সিংহভাগেরই মরদেহের সৎকার হয় না এবং তা মাংসাশী প্রাণিদের উপাদেয় খাদ্যে পরিণত হয়। এসব সত্ত্বেও বন্যার বানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে পা বাড়ানো ভাগ্যান্বেষী জনতার ঢল অব্যাহত রয়েছে। তাই যেকোনো মূল্যে কুদ্দুস আমেরিকায় অবতরণের ধনুর্ভাঙাপণ গ্রহণ করল।
এদিকে ভিনদেশি জাহাজে যোগ দেওয়ার পর থেকেই কুদ্দুসের ছোট পরিবার থেকে অভাবরাহু বিদায় নিয়েছে। নিয়মিত মাসোহারার সাহায্যে পরিবারের ভরণপোষণ, বাবার চিকিৎসাÑসবকিছু স্বচ্ছন্দে নির্বাহ হয়। যথাসময়ে ছালেহার কোলজুড়ে এক পুত্রসন্তানের আগমন ঘটে। প্রথম ছয় মাসের কর্মজীবনে চিঠিপত্রের লেনদেনের মাধ্যমে দু-তিন মাসের ব্যবধানে সব খবর জানা যায়। অবশ্য সময়ের অগ্রযাত্রায় কুদ্দুসের যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখার স্বপ্ন ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং দেশের সঙ্গে যোগাযোগ কমতে থাকে। বিভিন্ন বন্দর-শহর-নগর পাড়ি দিয়ে অবশেষে সাড়ে তিন বছর পর কুদ্দুস যুক্তরাষ্ট্রের একটি বন্দরে অবতরণের সুযোগ পায়। যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখার পরপরই হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা, কাঠফাটা রোদ, বরফগলা আবহাওয়া উপেক্ষা করে কুদ্দুস গ্রিন কার্ড লাভের আশায় উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনি শুরু করে। অবশ্য অবৈধতার অভিশাপ ও পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার ভীতি তাকে সর্বদা তাড়না করে।
সর্বোপরি সাবওয়েতে উপর্যুপরি দুবার নির্মমভাবে মার খাওয়া এবং মুখের উপরের পাটির দুটি তরতাজা দাঁত ভেঙে যাওয়ার পর কুদ্দুসের গ্রিন কার্ড হাতে পাওয়ার স্বপ্ন নিমেষে কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিশে যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সহকর্মীদের পরামর্শে কুদ্দুস সাহস ফিরে পায় এবং ললাটের লিখন জ্ঞানে সবকিছু নীরবে হজম করে। কুদ্দুস বাস্তবে দেখতে পায়, আমেরিকাতেও মালিকপক্ষ অবৈধদের নানাভাবে প্রতারিত করে। নামমাত্র মজুরিতে অবৈধদের দিন-রাত কলুর বলদের মতো খাটায়। অগত্যা কয়েকজন বাংলাদেশির পরামর্শে কুদ্দুস চুক্তিভিত্তিক বিয়ে এবং বৈধতা অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু করে। ফলে অহর্নিশ অমানুষিক খাটুনির মাধ্যমে অর্জিত ডলারের সিংহভাগই গার্লফ্রেন্ড এবং আইনজীবীকে পরিশোধ করতে হয়।
ধড়ে প্রাণ ধরে রাখার জন্য স্যান্ডউইচ, চিপস ইত্যাদি খেয়েই দিন কাটাতে হয় কুদ্দুসকে। মুখরোচক বাঙালি খাবারের স্বাদ কুদ্দুসের জীবন থেকে কবে বিদায় নিয়েছে, তা রীতিমতো প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে সাধারণ ক্ষমার আওতায় প্রায় এক যুগ পর গ্রিন কার্ড নামক সোনার হরিণ কুদ্দুসের হস্তগত হয়েছে। কিন্তু তত দিনে নানা অনাকাক্সিক্ষত রোগব্যাধি কুদ্দুসের শরীরে বাসা বেঁধেছে। ২৮ বছর বয়সী কুদ্দুসের প্রকৃত বয়স ৫৮ কি ৬৮, তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাহোক, গ্রিন কার্ড নামক সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার পর স্বজনদের দেড় যুগ পূর্বের বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতি ও করুণাকাতর মুখচ্ছবি তার মানসপটে অকস্মাৎ ভেসে ওঠে। প্রিয়তমা পত্নী ছালেহা, শয্যাশায়ী পিতা আকবর আলী, প্রায় অন্ধ দাদিমা, নবজাতক সকলের স্নেহকাতর ও অশ্রুসিক্ত মুখচ্ছবি মানসপটে ভেসে ওঠার পরপরই কুদ্দুস হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়। অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর কুদ্দুস শান্ত হয় এবং জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর বজ্রকঠোর সংকল্প গ্রহণ করে। বার টেন্ডারের চাকরি ছেড়ে দেয় এবং আড্ডা দেওয়া, মদ সেবনের বদভ্যাস ইত্যাদি পুরোপুরি পরিত্যাগপূর্বক আবার নতুনভাবে সংসার সাজানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। নির্মাণশ্রমিক হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করে এবং যথাসম্ভব ব্যয় সাশ্রয়ের মাধ্যমে দেশে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সেদিন ব্রুকলিনে কাজ করার সময় সৌভাগ্যক্রমে কুদ্দুসের হাইস্কুল সতীর্থ সফির বড় ভাইয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
সফির বড় ভাইকে তেমন কিছু না বলে তার কাছ থেকে সফির দেশের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে কুদ্দুস। অতঃপর রুমমেটদের সাহায্য-সহযোগিতায় প্রায় দেড় যুগ পর এক বিশেষ মুহূর্তে কুদ্দুস বিমানযোগে স্বদেশের উদ্দেশে পাড়ি জমায়। আগেই বলা হয়েছে, তিন কুলে কুদ্দুসের আপন বলতে কেউ নেই। সেও অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি বিলাসী ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়। যাহোক, যাত্রার আগেই সতীর্থ সফিকে কুদ্দুস ফোনালাপে তার স্বদেশযাত্রার তারিখ-দিনক্ষণ-সময় সবকিছু জানিয়ে দিয়েছিল। যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করে সফিও অধীর আগ্রহে নির্দিষ্ট সময়ে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে কুদ্দুসের জন্য প্রহর গুনছিল। সফির হাতে ধরা প্ল্যাকার্ড দেখে কুদ্দুস তার একেবারে কাছে আসামাত্রই সফির মোহ ভঙ্গ হয়।
কৈশোর ও যৌবনের নাদুসনুদুস কুদ্দুস যেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। তার উষ্কখুষ্ক কেশধাম, জরাজীর্ণ দেহ, রোগাটে চেহারা, কোঠরাগত অক্ষিযুগল দেখে কুদ্দুসের জন্য সফির দরদ বারি উপচে ওঠে। আকস্মিকতার ধকল কাটিয়ে দুই বন্ধু পরস্পরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে এবং কুদ্দুসকে সফি একটি আবাসিক হোটেলে নিয়ে যায়। হাত-মুখ ধোয়ার পর কুশল বিনিময় এবং আলাপচারিতাকালে সফি কুদ্দুসকে বলল, সে জানতে পেরেছে, কুদ্দুসের বাড়ির মিষ্টি আমের বড় গাছটি তত দিনে কাটা হয়ে গেছে। কারণ জানতে চাওয়ায় সফি বলল, সম্ভবত তার দাদিমার কাঙালিভোজের সময় লাকড়ির প্রয়োজনে গাছটি কাটা হয়েছে। কুদ্দুস বলল, তাহলে কি আমার দাদিমা মারা গেছেন? সতীর্থ বলল, শোনা মতো একমাত্র পৌত্রের মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পারায় বৃদ্ধার মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। কুদ্দুস বলল, তাহলে কি আমার একমাত্র পুত্রটাও মারা গেছে!
খানিকটা ইস্ততত করে সফি বলল, দুগ্ধপোষ্য শিশু মায়ের অবর্তমানে কদিনই বেঁচে থাকতে পারে। এবার কুদ্দুসের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল এবং প্রলাপের সুরে বলতে লাগল, আমার প্রিয়তমা ছালেহাও আমার ওপর অভিমান করে নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেছে। পরবর্তী এক ঘণ্টা হোটেলকক্ষে শ্মশানের শূন্যতা ও হাহাকার বিরাজ করল, কেউ টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করল না। শোকের আকস্মিক ধাক্কা সামলে ওঠার পর কুদ্দুস নিজ বাড়িঘরের খবর জানতে চাওয়ায় সফি জানাল, সম্ভবত বাড়িঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা পার্শ্ববর্তী বাড়ির মালিক জাল দলিলের সুবাদে প্রায় ১০ বছর আগে কুদ্দুসের পিতৃবিয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই তা দখল করে নিয়েছে এবং বর্তমানে সেখানে হাল ফ্যাশনের ভবন নির্মাণ করেছে। সবকিছু শোনার পর কুদ্দুসের মনে হলো বেহেশতের চাবি তার হাত ফসকে বেহাত হয়ে গেছে এবং প্রজ্বলিত নরকসম অগ্নিকুণ্ড সামনে তার জন্য প্রহর গুনছে। অবশ্য সফি কুদ্দুসকে বলল, বাংলাদেশে এখন চলছে দখলের রাজত্ব।
সরকারি দলের আশীর্বাদপুষ্টরা গোটা দেশটাকেই নিজেদের পৈতৃক সম্পদ জ্ঞান করে। সে কুদ্দুসকে পরামর্শ দিল বাড়িঘর নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দু-চার দিন ঢাকায় কাটিয়ে যেন আমেরিকায় পুনরায় পাড়ি জমায়। সফির হিতোপদেশে কুদ্দুসের মনোজগতে হঠাৎ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ঢেউ খেলে গেল। সে সফির পরামর্শে কর্ণপাত করল এবং বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুহূতেই নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ফেলল। তারপর দুই বন্ধু দুপুর ও রাতের খাবার খেয়ে হোটেলকক্ষেই রাত কাটল এবং পরদিন সাতসকালে বিমান অফিসে গিয়ে টিকিটের তারিখ পরিবর্তন করে আমেরিকায় ফেরত আসার দিনক্ষণ নির্ধারণ করল। মূলত সফি এসেছিল আমেরিকা প্রবাসী সতীর্থ কুদ্দুসকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে। অথচ নিয়তির নির্মম বিধানে পরদিন সফিই সতীর্থ প্রবাসী কুদ্দুসকে সি-অফ করল। ফেরতযাত্রার পূর্বে মুহূর্তে অশ্রুসিক্ত কুদ্দুস শুধু উচ্চারণ করল : ‘কে দিয়েছে হেন শাপ, হেন ব্যবধান/ কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ; কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ।’ তারপর সতীর্থ সফির সঙ্গে কোলাকুলি করে প্রায় দেড় যুগ পূর্বের ন্যায় স্বদেশ ও স্বদেশবাসীকে চিরদিনের মতো বিদায় জানিয়ে বিমানবন্দরের লোকারণ্যে হারিয়ে গেল কুদ্দুস।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
১১ জুলাই ২০২৩