একমাত্র ছোট বোনকে নিয়ে পালিয়ে বাঁচলেও একের পর এক বেশুমার মামলা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বাঘা বাঘা দাম্ভিক নেতারাও আসামি। প্রায় প্রতিদিনই ধাপে ধাপে দুয়েকজন ধরা পড়ছেন ছিঁচকে চোর স্টাইলে নোংরাভাবে। ছেলে জয়, মেয়ে পুতুল, শেখ সেলিম, শেখ তাপসসহ শেখ পরিবারের সদস্যরা গণহত্যা, হত্যা, হত্যাচেষ্টা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, লোপাট, বড় বড় দুর্নীতির মামলার আসামি। ভারতের অ্যাজেন্ডায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্তও হতে যাচ্ছে। সাক্ষী-সাবুদ প্রস্তুত। শাপলা চত্বরে শহীদদের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচারের দাবিতে সোচ্চার নানা মহল। নমুনা বুঝে দিল্লিকে দ্রুত শেখ হাসিনাকে ঢাকায় পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের কমিটমেন্ট ভঙ্গের অভিযোগও করা হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ছেলে জয় এবং রেহানার মেয়ে টিউলিপের মধ্যস্থতায় শেখ হাসিনা কত টাকা চুরি করেছেন, সেই সংবাদও বেশ চাউর। বিডিআর বিদ্রোহের নামে পরিকল্পনা করে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছে, শেখ সেলিম-শেখ তাপস কীভাবে গোটা অ্যারেঞ্জটি করেছেন- এ সংক্রান্ত তথ্য ওই হত্যাকাণ্ডের শিকার তখনকার ডিজি জেনারেল শাকিলের ছেলে বলেছেন। সেদিন বেঁচে যাওয়া কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাও বলেছেন। শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের হত্যার পর লাশ গুম ও গায়েব করার তথ্য-সাবুদও দেওয়া হচ্ছে। সেই ঘটনা চাপা দিতে আরও কতজনকে কীভাবে কী করা হয়েছে, সেই বর্ণনাও আসছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি সাবেক মেজর বজলুল হুদাকে ফাঁসিতে না ঝুলিয়ে শেখ হাসিনা রাতে কারাগারে গিয়ে কীভাবে বুকে পা দিয়ে গলায় ছুরি চালিয়ে জবাই করা হয়েছে, তাও ঘুরছে নিউজফিডে।
দেরিতে হলেও সেনাবাহিনী ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার কাজে নামায় পরিস্থিতিটা শেখ হাসিনার জন্য ধারণার বাইরে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। একই সময়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি শেখ হাসিনার উন্নয়ন পার্টনার হিসেবে পরিচিত চীন পর্যন্ত ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তার কথা জানান দিচ্ছে বারবার। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলার ভারতীয় গণমাধ্যমের নাটকও ধরা পড়েছে স্ক্রিপ্ট-অভিনেতাসহ। এটি ভারত ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপি সরকারের জন্য চরম বিপর্যয়ের। এমন সময়ে মোদিকে দ্রুত ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র ও মানুষের সম্প্রীতি-উচ্ছ্বাস দেখে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ড. ইউনূস। এ-ও বলেছেন, নইলে মিস করবেন। মোদির ফিরতি জবাব এখনো আসেনি। তিনি দিল্লিতে তার দেশের স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্টের ভাষণে ১৪০ কোটি ভারতীয় বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন মন্তব্য করে একপ্রকার ফেঁসে গেছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বলেছিলেন ‘ভারত আছে, আমরা আছি’, তখনো নরেন্দ্র মোদি আওয়ামী লীগের এমন পরিণতির কথা চিন্তাও করেননি। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ‘পদ্মায় চুবানি দেওয়া উচিত’ বলে সদম্ভে বক্তব্য দেওয়া শেখ হাসিনাকে আশ্রয়ে রেখে ড. ইউনূসের সঙ্গে ভিন্ন উচ্চতার সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। জবাবে মোদিকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিজ চোখে দেখে যেতে বলেছেন।
এর আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে ভারতের হাইকমিশনার উপস্থিত না থেকে নতুন সরকারের প্রতি অনুভূতি ধরনের বার্তা দিয়েছেন। আবার বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ইউনূসের বিশ্ব উচ্চতাও তিনি জানেন। এই ওজনের নেতৃত্ব ভারতে বা আশপাশে কোথাও আছে কি না, তা-ও তার জানা।
ভারতসহ গোটা বিশ্বের কাছে ইউনূস আগে থেকেই এক অপার সম্ভাবনার মানুষ। এমন অবস্থার মাঝে আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বাংলাদেশের ভারতপ্রেমী রাজনৈতিক দলগুলোর কী দশা হবে, তা জেনেবুঝেই এখন এগোতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে। নেপাল, চীন, ভুটান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাসহ আশপাশের দেশগুলোর কারও সঙ্গেই ভারতের এখন সদ্ভাব নেই। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, কাতার, অস্ট্রেলিয়ায়ও বৈরী অবস্থা করে রেখেছে ভারত। মণিপুর, আসাম, কাশ্মীরসহ নিজ দেশের ছোট রাজ্যগুলোতেও মোদিবিরোধী সেন্টিমেন্ট মারাত্মক নেতিবাচক। তার ওপর এখন বইতে হচ্ছে শেখ হাসিনার বোঝা। কোনো বিশেষ ভিসায় শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন, নাকি তাকে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম দেওয়া হয়েছে, তাও আনুষ্ঠানিক বলতে পারছে না দেশটি। এ কারণে প্রশ্ন উঠছে, ভারতে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার অবস্থানের ইমিগ্রেশনগত (অভিবাসন) বৈধতা ঠিক কী, আর সেই স্ট্যাটাস কত দিন পর্যন্ত বৈধ থাকতে পারে?
দিল্লি সরকারের শীর্ষ পর্যায় শেখ হাসিনার ‘ডিপ্লোম্যাটিক’ বা ‘অফিশিয়াল’ পাসপোর্টটিকে এখনো বৈধতা দিচ্ছে। কিন্তু অফিশিয়ালি বলছে না। আর শেখ রেহানার বিষয়টি একটু ভিন্ন। তিনি যুক্তরাজ্যের পাসপোর্টধারী। এর ফলে তিনি সাধারণ ‘ভিসা অন অ্যারাইভালে’ যত দিন খুশি ভারতে থাকতে পারেন। এ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে নির্দিষ্ট প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে। রণধীর জয়সওয়ালের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, প্রায় দুই সপ্তাহ হলো শেখ হাসিনা দিল্লিতে এসেছেন। তিনি (মুখপাত্র) কি বলতে পারেন, তার (শেখ হাসিনা) এই অবস্থানের (ইমিগ্রেশনগত) স্ট্যাটাস কী? অর্থাৎ তিনি কি নিয়মিত ভিসায় এ দেশে আছেন, নাকি তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন? নাকি তাকে কোনো ধরনের গৃহবন্দী বা অন্তরীণ অবস্থায় (ডিটেনশনে) রাখা হয়েছে? প্রশ্নটা এ কারণেই করা যে সাংবাদিকেরা নানা ধরনের পরস্পরবিরোধী বার্তা পাচ্ছেন। শেখ হাসিনার মেয়ে (সায়মা ওয়াজেদ) টুইট করেছেন, তিনি তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। আবার যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বিবৃতি দিয়েছেন।
যে সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে মুখপাত্র তার জবাব দেওয়ার সময় প্রথমেই স্পষ্ট করে দেন, শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী। রণধীর জয়সওয়াল তখন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারতে আসার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছিল খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে। এই পরিস্থিতি এখনো ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে। ভারতীয় কোনো কোনো মহল বলছে, শেখ হাসিনার এই মুহূর্তে দিল্লি অবস্থানের ভিত্তি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সংশোধিত ট্রাভেল অ্যারেঞ্জমেন্ট’। ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই ঢাকায় দুই দেশের সরকারের মধ্যে এই সমঝোতা স্বাক্ষর হয়। প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে শেখ হাসিনা যখন দেশত্যাগ করেন, তার ডিপ্লোম্যাটিক বা অফিশিয়াল পাসপোর্ট সম্পূর্ণ বৈধ ছিল। যেকোনো কারণেই হোক তা বাতিল করা হয়নি। বাংলাদেশে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারও তা বাতিল করেনি। এর ফলে যত দিন এই পাসপোর্ট বহাল থাকছে, তার ভিত্তিতেই দুই দেশের মধ্যকার সমঝোতা অনুযায়ী শেখ হাসিনা টেকনিক্যালি কোনো ধরনের ভিসা ছাড়াই ৪৫ দিন ভারতে অবস্থান করতে পারবেন।
শুধু বাংলাদেশ নয়, ডিপ্লোম্যাটিক ও অফিশিয়াল বা সার্ভিস পাসপোর্টধারী ব্যক্তিরা যাতে বিনা ভিসায় একে অন্যের দেশে থাকতে পারেন, সে জন্য মোট ১০০টি দেশের সঙ্গে ভারতের একই ধরনের সমঝোতা আছে। শুধু ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টধারী ব্যক্তিদের জন্য অনুরূপ সমঝোতা আছে আরও ৩৪টি দেশের সঙ্গে। বিনা ভিসায় থাকার এই মেয়াদ কোনো দেশের ক্ষেত্রে ৯০ দিন, কোথাও ৪৫, ৩০ বা ১৪ দিন। ভারত-বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ৪৫ দিন। কিন্তু এই দেড় মাসের মধ্যে শেখ হাসিনার বর্তমান পাসপোর্ট ‘রিভোকড’ বা বাতিল করলে একটু জটিলতা দেখা দেবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভারতের প্ল্যান বি, প্ল্যান সি প্রস্তুত রাখা আছে।



ঠিকানা রিপোর্ট


