৩২ হাজার ১৬৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ময়মনসিংহের কেওয়াটখালি সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সংযোগ সড়কের নকশা পরিকল্পনায় ত্রুটি-বিচ্যুতি ও স্থানীয় ভুক্তভোগীদের সাথে সমঝোতা অমীমাংসিত রেখেই তড়িঘড়ি করে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্নের মাধ্যমে প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা লুটপাট নিশ্চিত করতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ-কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ একটি চক্র।
ত্রুটিপূর্ণ নকশায় ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে সংযোগ সড়কটি ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা ও শতাধিক মিল-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি ঘিরেই শুরু হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ-কেন্দ্রিক লুটপাটের কার্যক্রম। জমির শ্রেণির পরিবর্তন করাসহ কারও নিচু নামা ভূমিকে ভিটেবাড়ি দেখানো, টিনের বস্তিসদৃশ ঘরকে বিরাট আয়তনের কারখানা হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। লাখ টাকার সম্পদ-স্থাপনাকে কয়েক কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণের নকশা আঁকাআঁকির অপকর্ম চলছে প্রকাশ্যেই। এসব কারণে কেওয়াটখালি সেতু নির্মাণ প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ টাকা যেমন অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকল্পটি কাঙ্ক্ষিত জনকল্যাণ নিশ্চিতকরণে ব্যর্থ হওয়ারও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে মোশাররফ হোসেন নামের এক ব্যক্তি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি লিখিত আবেদন জমা দেন।
জানা যায়, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি প্রবার ব্রিজের আদলে কেওয়াটখালি সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহের সাথে রাজধানী ঢাকার নিরাপদ, উন্নত ও ব্যয়সাশ্রয়ী যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সরকার ময়মনসিংহে এই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। স্টিল আর্চ সেতু নির্মাণ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ৩২৬৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা গত ২৪ আগস্ট ২০২১ তারিখে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন করে।
ইতিমধ্যেই সড়ক অধিদপ্তর প্রকল্প কাজের ব্যাপারে যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার্সের মধ্যে চুক্তি সই সম্পাদন করেছে।
দেশে নতুন প্রযুক্তির এই স্টিল আর্চ (ধনুক) ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৩৩ দশমিক ২ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। মূলত এই অধিগ্রহণ খাতে মাত্রাতিরিক্ত টাকা ব্যয়ের অপকৌশলেই সেতু প্রকল্পের সংযোগ সড়কগুলো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা দিয়ে নির্মাণের ত্রুটিপূর্ণ নকশা করার অভিযোগ উঠেছে। অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, সেতুর সংযোগ সড়কটি ময়মনসিংয মহাসড়কের বাইপাস মোড় থেকে শুরু হয়ে কেওয়াটখালি এসে সেতুর পশ্চিম প্রান্তে যুক্ত হয়েছে।
কিন্তু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়কটি উত্তর-পূর্ব দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়ে আবার পেছন ফিরে পশ্চিম দিকে দুটি রেলওয়ে ওভারপাস ফ্লাইওভার আকারে পেরিয়ে টোল প্লাজা পর্যন্ত পৌঁছে আবারও উত্তর দিকে চায়না মোড়ের দিকে অগ্রসর হয়েছে। অথচ সেখানেও সংযোগ সড়কটি যুক্ত না করে দুটি র্যামে বিভক্ত করা হয়। বিভক্ত একটি র্যামকে পূর্ব দিকে চলমান চার লেন মহাসড়কে ১০০ মিটার ওভারপাস দ্বারা ক্রস করে উত্তর পাশ দিয়ে রংধনুর আকৃতিতে ঘাওগরা স্কুলের সামনে মূল সড়কে সংযুক্তি দেখানো হয়। আরেকটি র্যাম চার লেন মহাসড়কের দক্ষিণ পাশ ঘাওগরা স্কুলের বিপরীত পাশে মূল রাস্তায় মিলিত হয়েছে।
কিন্তু ফ্লাইওভারটি পেছন দিকে না ঘুরিয়ে সরাসরি নেওয়া হলে অন্তত এক কিলোমিটার সংযোগ সড়ক কমে যেত। এ ক্ষেত্রে এক হাজার কোটি টাকা নির্মাণব্যয় যেমন কমত, তেমনি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণেরও প্রয়োজন হতো না। কারণ সংযোগ সড়কটি সরাসরি নেওয়া হলে সেখানে বেশির ভাগই ছিল সরকারি খাসভূমি। ফলে ভূমি অধিগ্রহণ খাতে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ খরচ হতো বলেও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা মন্তব্য করেছেন।
স্থানীয় ভুক্তভোগীদের পক্ষে ও নিজ উদ্যোগে মো. মোশারফ হোসেন এ ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ করে সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক ও সচিব, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগসহ কেওয়াটখালি সেতু নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রায় সকলকেই লিখিতভাবে অবগত করেছেন। সেখানে ভূমি অধিগ্রহণ চক্রের অন্যতম সদস্য বিদায়ী প্রকল্প পরিচালক নূরে আলম ও সদ্য বিদায়ী জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মাহমুদ এবং বিদায়ী ও বর্তমান প্রজেক্ট ম্যানেজার যথাক্রমে নূরে আলম ও দিদারুল আলমের যৌথ কারসাজিতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সেতু প্রকল্পে মাত্রাতিরিক্ত অপচয় ঘটানোর অভিযোগ তুলে অবিলম্বে সংযোগ সড়কের ত্রুটিপূর্ণ নকশা সংশোধনেরও দাবি জানানো হয়।
কিন্তু জেলা প্রশাসনের এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ভূমি অধিগ্রহণ চক্রের লুটপাট ও দুটি আবাসন প্রকল্পের স্বার্থে লিখিত অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হয়নি। উপরন্তু অধিগ্রহণ খাতের শত শত কোটি টাকা লুটপাট নিশ্চিত করার মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পাঁয়তারা চলছে। এমনকি অভিযোগকারীর আবেদনের পরপরই প্রকল্প পরিচালক নূরে আলম ও জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মাহফুজুল হককে অন্যত্র বদলি করা হয়। পরবর্তীতে ও যোগদানকৃত তথা বর্তমান দায়িত্বরত প্রকল্প পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ নাজুকেও একই পথে চলতে দেখা যাচ্ছে। তিনি অভিযোগকারীকে কোনো সহযোগিতা না করে উল্টো অভিযোগ প্রত্যাহার করতে প্রতিনিয়ত প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে আসছেন। এমনকি অভিযোগ প্রত্যাহার না করলে অভিযোগকারীকে মামলা-হামলাসহ প্রাণনাশের হুমকিও দিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে সরেজমিন অনুসন্ধানপূর্বক জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
এ বিষয়ে সাবেক প্রকল্প পরিচালক দিদারে আলমের বক্তব্য জানতে চাওয়ার জন্য বারবার তার সেলফোনে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি এবং বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর মেলেনি।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ময়মনসিংহের এক ব্যক্তি একটি আবেদন করেছেন। আবেদনটি আমার দপ্তরে আসছে। তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছু বলা যাবে না।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও ভূমি অধিগ্রহণ অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্মিলিত যোগসাজশে ময়মনসিংহে চলমান দুটি হাউজিং কোম্পানিকে বাণিজ্যিক সুবিধা প্রণয়নের নেপথ্যে স্টিল আর্চ সেতুর সংযোগ সড়ক ব্যয় বেড়ে গেছে এক হাজার কোটি টাকার মতো।
২০২১ সালের ২৪ আগস্ট শেরেবাংলা নগর এনইসি সভাকক্ষে একনেক চেয়ারপারসন তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে সভায় যোগদান করেন।
সভা শেষে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ময়মনসিংহ বিভাগের কয়েকটি জেলাসহ এ অঞ্চলের স্থলবন্দর, ইপিজেড এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহের সাথে রাজধানী ঢাকার নিরাপদ ও উন্নত যোগাযোগ স্থাপন হবে, যার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক কার্যক্রমসমূহ ত্বরান্বিত হবে। তিনি আরও জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মিত হলে ময়মনসিংহ শহরের বাইপাস সড়কের যানজট কমে আসবে। এতে যাত্রী ও পণ্য চলাচল অনেক সহজ হবে। তিনি উল্লেখ করেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৬৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করবে ১ হাজার ৩৫৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বাকি ১ হাজার ৯০৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা প্রকল্প সাহায্য হিসেবে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইবিবি) অর্থায়ন করবে। সেতু নির্মাণ কাজ ২০২৫ সালের জুনে শেষ হবে বলে আশা করেছিল কর্তৃপক্ষ।
ব্রিফিংয়ের সময় সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমসহ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর একটি ব্রিজ, ওভারপাস ও ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়ক পৃথক এসএমভিটি লেনসহ ৪ লেনে নির্মাণের মাধ্যমে ময়মনসিংহ বিভাগের আওতাধীন উত্তরাঞ্চলের জেলাসহ এ অঞ্চলের স্থলবন্দর, ইপিজেড এবং এসইজেডের সাথে রাজধানী ঢাকার উন্নত যোগাযোগ স্থাপন করা। প্রকল্পের আওতায় ৩২০ মিটার দৈর্ঘ্যের মূল সেতু, ৭৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের সংযোগ সেতু, ৫৫১ মিটার দৈর্ঘ্যের সড়ক ওভারপাস, ২৪০ মিটার দৈর্ঘ্যের রেলওয়ে ওভারপাস ও ৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এসএমভিটি লেনসহ ৪ লেনের মহাসড়ক নির্মাণ করা হবে।
সে সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মামুন আল রশীদ বলেন, কেওয়াটখালি সেতু হবে দেশের প্রথম স্টিল আর্চ সেতু। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যে ধরনের স্টিলের সেতু রয়েছে, এটিও সে রকম হবে। কিন্তু প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ফুল চেইনে যদি উল্লেখিত দুর্নীতির বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে বিশ্ব দরবারে এই স্টিল আর্চ সেতু প্রকল্প দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকরণে আরেকটি নিন্দনীয় মাত্রা যোগ করবে বলে সুস্পষ্ট ধারণা করা হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় আছেন পুরো জেলাবাসী। একই সাথে পুনরায় তদন্তের মাধ্যমে সকল দুর্নীতির শিখর উপড়ে ফেলে এই প্রকল্পের অবকাঠামোগত ব্যাপারে সময়োপযোগী ও যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দিকেই চেয়ে আছে এলাকাবাসী।
ঠিকানা/এনআই