‘লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে’-প্রায় ৭৫ বছর আগে ফিলিস্তিনিদের রক্তে আগুন লেগেছে। যেদিন থেকে জায়েনিস্টরা ফিলিস্তিনিদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও বাস্তুচ্যুত করে তাদের ভিটেমাটি দখল করে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছে, সেদিন থেকে বংশপরম্পরায় তাদের বাড়িঘর উদ্ধার এবং তাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার শপথে লড়ে যাচ্ছে। তাদের দৃপ্ত শপথ তাদের আদর্শ বাস্তবায়ন বা রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত থাকবে। ইয়াহিয়া ইব্রাহিম হাসান আল সিনওয়ার। ডাকনাম ছিল আবু ইব্রাহিম (কুনিয়া)। একজন দেশপ্রেমিক হামাস বীরযোদ্ধা। যার সংগ্রামী জীবন পর্যালোচনা করলেই তার বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ‘আশকেলন’ শহর থেকে সিনওয়ারের পিতা-মাতা পৈতৃক বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত হন। গাজার খান ইউনুস শহরের রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ১৯৬২ সালের ২৯ অক্টোবর এই ক্যাম্পেই তার জন্ম।
তার আরেক সহোদরের নাম ছিল মোহাম্মদ সিনওয়ার। এই শহরেই বড় হওয়া। তিনি খান ইউনুস শহরের প্রাইমারি স্কুল ও বয়েজ হাইস্কুল থেকে শিক্ষা নিয়ে গাজার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষার ওপর ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন ও মেধাবী। একসময় তাদের সবই ছিল। কিন্তু ইহুদিদের অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে নিজেদের বাড়িঘরহারা উদ্বাস্তু শিবিরে বাবা-মায়ের দুঃখ-কষ্টের মধ্যে বড় হন সিনওয়ার। সিনওয়ারের তিন সন্তানসহ বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিল তার পরিবার। তাই প্রতিশোধের নেশায় বুকের ভেতর চাপা আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল। সেই সময় খান ইউনুসে মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘাঁটি ছিল। শিক্ষাজীবন শেষ করেই তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দিয়ে এক সংগঠিত ও শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে যা হামাসের শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৮২ সালে সিনওয়ার প্রথম গ্রেফতার হন। দুই বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৮৫ সালে আবার গ্রেফতার হন। ১৯৮৭ সালে হামাস গঠনের পর প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। সিনওয়ার মাত্র ২৫ বছর বয়সে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা আল মজিদ গঠন করেন। ১৯৮৮ সালে দুই ইসরায়েলি সৈন্যকে অপহরণ এবং হত্যার দায়ে ইসরায়েল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। সিনওয়ার তার জীবনের একটা বড় অংশ ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত (২৩ বছর) ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী জীবন যাপন করেন। এই দীর্ঘ কারাজীবন তাকে আরও কঠোর ও কঠিন করে তোলে। তিনি সব সময় ইসরায়েলকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন এবং ফিলিস্তিনে কোনো ইহুদি অস্তিত্ব না থাকার পরিকল্পনা করেন। ২০১১ সালে ইসরায়েল কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সরাসরি হামাসে যোগ দিয়ে দ্বিগুণ শক্তি ও সাহসিকতার সঙ্গে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোযোগী হন। তিনি মূলত হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়ার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে কাজ করেন। সমস্ত গাজাকে ইহুদি বাহিনীর বিরুদ্ধে টানেল নির্মাণসহ বিভিন্ন ব্যাংকার খনন এবং বড় বড় দালানের ভেতর হামাসের ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি ভালোভাবেই জানতেন, এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার নয়। যত দিন পর্যন্ত ইহুদি বাহিনীকে ফিলিস্তিনের মাটি থেকে বিতাড়িত বা উচ্ছেদ করা হয়েছে, তত দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। এটা তাদের অস্তিত্বের প্রশ্নের লড়াই।
এদিকে হামাসের পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন সিনওয়ার। কিন্তু যখন দেখা গেল আমেরিকার মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনের সমস্যার সমাধান না করে আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং তা যদি হয়ে যায়, তবে ফিলিস্তিনিদের দাবি চিরদিনের জন্য তামাদি হয়ে যাবে। তাই এই মধ্যস্থতা কার্যকর হওয়ার আগেই তাদের যা করার করতে হবে। সে জন্যই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইহুদিদের ছুটির দিনটি আক্রমণের সঠিক সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। হামাসের সামরিক শাখার কাসেম ব্রিগেডের প্রধান নেতা মোহাম্মদ দাইফকে উদ্বুদ্ধ করে মূল পরিকল্পনা ও মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছিলেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তাদের পরিকল্পনা এত নিখুঁত ছিল যে সারা বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র, উচ্চশিক্ষায় প্রশিক্ষিত ইহুদি বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে ইসরায়েলের ভেতর ঢুকে ১২০০ ইহুদিকে হত্যা এবং ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে নিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনার পর সারা পৃথিবী হামাসের এই হামলায় আতঙ্কিত হয়ে যায় এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয় যে ফিলিস্তিনের মানুষের মূল সমস্যার সমাধান না করে এই এলাকার শান্তি আনা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপ, আমেরিকা স্তম্ভিত হয়ে যায়। আর ইসরায়েল হয়ে যায় বাকরুদ্ধ। নেতানিয়াহু তার মিত্রদের নিয়ে বলেন, তাদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। এর পর থেকেই শুরু হয় একতরফাভাবে ফিলিস্তিনের নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুর ওপর গণহত্যা। জাতিসংঘসহ সারা পৃথিবীর মানুষ এর বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি, দ্বিজাতি এবং দুই রাষ্ট্রের সমমর্যাদার ভিত্তিতে স্থায়ীভাবে সমাধানের জন্য জাতিসংঘের দুই-তৃতীয়াংশ দেশ এ ব্যাপারে একমত হয়। কিন্তু আমেরিকা ও তাদের মিত্রদের কূটচালের কারণে মুসলিম রক্তপিপাসু বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ পর্যন্ত গাজায় ৪৩ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ আহত, বিকলাঙ্গ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। সমস্ত গাজার বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, উপাসনালয়, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল সবকিছু ধ্বংস করে পৃথিবীর বুকে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি করা হয়েছে। তার পরও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বসে নেই। গাজাকে নিঃশেষ করার পর হিজবুল্লাহ নিধনের নামে লেবাননের দিকে যুদ্ধ শুরু করেছেন। দুই হাজারের অধিক লোক নিহত, চার-পাঁচ হাজার লোক আহত এবং ২০-২৫ হাজার লোক ভয়ে দেশ ত্যাগ করছেন। ইরানের সঙ্গেও কয়েক দফা ক্ষেপণাস্ত্র চালাচালি হয়ে গেছে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের দামামা গড়ে তোলার মাধ্যমে পরমাণুর আক্রমণের দিকে সারা পৃথিবীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার নিজের দেশের মানুষ ইসরায়েলিরাও শান্তি চায়। নেতানিয়াহুর পদত্যাগের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি ও ইরানের আক্রমণের কারণে ইসরায়েলের জনসাধারণকে সর্বদা আতঙ্কিত থাকতে হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি মন্দা, ইসরায়েল বসবাসের জন্য নিরাপদ জায়গা নয় ইত্যাদি কারণে এ পর্যন্ত ৩০-৪০ হাজার ইসরায়েলি দেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার ইসরায়েলি সেনা নিহত, অসংখ্য অগণিত মানুষ ও সেনাবাহিনীর লোক আহত হয়েছেন। অর্থাৎ ইসরায়েলের শান্তিপ্রিয় মানুষ মনে করছেন, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য ইসরায়েলকে ধ্বংস এবং পৃথিবীর বুকে ইহুদি জাতি ও রাষ্ট্রকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
এদিকে গত বছরের ৭ অক্টোবর সফল হামলার পর সিনওয়ার অদৃশ্য হয়ে যান। ইসরায়েল ও তার মিত্ররা জানত, এই হামলার মূল হোতা সিনওয়ার। তাকে ধরা অথবা হত্যার জন্য হাজার হাজার সৈন্য, ড্রোন, ইলেকট্রনিক ডিভাইস, গোয়েন্দা বিভিন্ন জনের সহায়তা নেয়। তার অবস্থান শনাক্ত করার জন্য মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞ টিম দিনরাত পরিশ্রম করে অবশেষে বলে, সিনওয়ার মিসরের সিনাই উপত্যকা দ্বীপে পালিয়ে গেছেন এবং সেখান থেকে লেবানন বা সিরিয়ায় পালিয়ে যেতে পারেন। বাইডেন প্রশাসন ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন নাদেলের সঙ্গে তুলনা করে। সে জন্য আমেরিকা, ইউরোপসহ ইসরায়েলিদের কাছে তিনি মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর হামাস নেতারা বলেন, সিনওয়ার গত বছরের অক্টোবর হামলার পর এক দিনের জন্যও গাজা ছেড়ে বা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে কোথাও যাননি। কোনো সময় সুড়ঙ্গ বা যুদ্ধের মাঠে, ব্যাংকারে, বিল্ডিংয়ে সর্বত্র সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল তার বিচরণ, যা কোনো কল্পকাহিনি বা সিনেমাকেও হার মানায়। ইসরায়েল বাহিনী খাবার পানি, বিদ্যুৎ, ওষুধ সবকিছু বন্ধ করে দেয়। একমাত্র ইমানি শক্তি, মাতৃভূমি রক্ষার মর্যাদার লড়াইয়ে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিয়ে যুদ্ধ করে মারাত্মক আহত হন সিনওয়ার। এই রক্তাক্ত আহত অবস্থায় ঘৃণায় ইসরায়েল বাহিনীর ওপর বাম হাতে থাকা শেষ লাঠিটা ছুড়ে মেরে তাদের গোলার আঘাতে গাজার মাটিতেই ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার এই বীরত্বের মৃত্যু পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর পরও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হামাসও আরও দ্বিগুণ প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের স্পৃহায় উজ্জীবিত হয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিনওয়ারের উত্তরসূরি দেশপ্রেমিক হামাস-যোদ্ধারা আত্মসমর্পণ বা নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাননি। ফিনিক্স পাখির মতো বারবার ফিরে আসেন। হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন অথবা সামনে স্বাধীন ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব-এর বিকল্প তাদের কাছে নেই।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক