ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল বিল বার বলেছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ২০২৪ সালের নির্বাচনে জো বাইডেনের বিরুদ্ধে রিপাবলিকান মনোনীত হলে তিনি ‘সেতু থেকে লাফ দিবেন’। বার বলেন, ‘স্পষ্টভাবে বলছি আমি মনোনয়নের জন্য ট্রাম্পের তীব্র বিরোধিতা করি এবং ট্রাম্পকে সমাধান দিতে আসেনি। বিবদমান বৈরী বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে ব্যবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে এসেছিল। তারা কেউই দীর্ঘ দিনের সমস্যার পারস্পরিক সম্মানজনক, গ্রহণযোগ্য সমাধানে উদ্যোগী হয়নি। কার্যত মূল সমস্যাটি তারা বিবেচনায় না নিয়েই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করছে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, প্রভাবশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিনিধিদের যাবতীয় কর্মতৎপরতা ছিল প্রধানত এক পক্ষকেন্দ্রিক। অর্থাৎ বিদ্যমান শাসনব্যবস্থায় পরিবেশ, পরিস্থিতি জিইয়ে রেখেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান! বর্তমান সরকারের আওতায় এ নির্বাচন হবে। বিদেশিদের এ অবস্থান সরকারের বক্তব্য ও অবস্থানেরই পরিপূরক। এই যেখানে তাদের অবস্থান, সেখানে চিহ্নিত সমস্যা-সংকট হতে দূরে থেকে বাস্তবভিত্তিক গ্রহণযোগ্য সমাধান কীভাবে সম্ভব, এ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। মার্কিন প্রতিনিধিদল স্পষ্টতই সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিদেশিরা প্রকৃতপক্ষে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, সংঘাতহীন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। এ কেবল কথার কথা নয়, প্রকৃত অর্থেই ব্যতিক্রম হলে পরিস্থিতি সরকারের অনুকূলে না-ও থাকতে পারে। অবস্থাটা দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার জন্য শুভ না-ও হতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারের ওপর কার্যকর চাপ অব্যাহত থাকবে।
মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন সর্বাধিক প্রভাবশালী প্রতিনিধিদল বৈরী দুই পক্ষকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার কথা বলেছে। দুই পক্ষ যেখানে চরম বৈরী, বিপরীত অবস্থানে রয়েছে, সেখানে সংলাপ কীভাবে সম্ভব, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো গ্রহণযোগ্য সংস্থা, ব্যক্তিবর্গ দুই পক্ষকে এক টেবিলে বসানোর উদ্যোগ যদি না নেয়! নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধিকে তার কার্যালয়ে উভয়কে নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনকে এ ব্যাপারে সহযোগিতার অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নয় বলেই আভাস পাওয়া যায়। কারণ ফলাফল যে পুরোপুরি নেতিবাচক হবে, তা তাদের কাছেও অত্যন্ত পরিষ্কার।
প্রস্তাবিত উদ্যোক্তারা মনে করেন, মূল সমস্যা জিইয়ে রেখে এবং এখানে তৃতীয় পক্ষের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ না থাকায় সমাধান কী করে আশা করা যায়। বিএনপি স্পষ্ট করেই বলেছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মেনে নিলেই আলোচনায় বসবে তারা। অন্যদিকে সরকারি দল তাদের পূর্ববর্তী অবস্থানেই অনড় রয়েছে। বলেছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সুযোগ নেই। সংবিধান-বহির্ভূত কোনো পথে কোনো অবস্থাতেই যাবে না তারা। বিএনপিকে বর্তমান সংবিধানের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে-এ ঘোষণা দিতে হবে। তার পরই তাদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি দেশে অবস্থানকালেই দুই দল তাদের বিপরতীমুখী অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এখনো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই ধারা ধরে রেখেছে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন যে যুক্তরাষ্ট্র একান্তভাবেই প্রত্যাশা করে, উজরা জেয়া তা সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও অন্যান্য পর্যায়ের বৈঠকে রীতিমতো অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই প্রকাশ করেন। এ জন্য তারা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে। প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নির্বাচনে না এলে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, সে কথাও বলেননি। বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ওপর তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে বলে তাদের আচরণে, কথায় স্পষ্ট দৃশ্যমান হয়নি। উজরা জেয়া সহিংসতা পরিহার করে সত্যিকারের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় বলে বিরোধীদের দাবির প্রশ্নে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি সমর্থন জানাননি। বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গ্রহণ বা বর্জন বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। তিনি খোলাসা করেই বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে নয়। কোনো বিশেষ দলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব নেই। বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ারও কোনো আগ্রহ নেই। বাংলাদেশের উন্নয়নের দীর্ঘদিনের সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী বলেও জানান।
সমস্যা-সংকটের পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য, সম্মানজনক সুরাহার চেষ্টা, উদ্যোগ না নিয়েই মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি দেশে ফিরে গেলেন। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সীমাবদ্ধতা, অক্ষমতার দিকগুলো তুলে ধরে সেগুলো দ্রুত সুরাহার নির্দেশনা দিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তা অধিকতর শক্তিশালী করার সুপারিশ করেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। বিদেশিদের তৎপরতা ও বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া সমার্থক বলেই মনে করে তারা। তার পরও একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী মহল থেকে নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার। বলা হচ্ছে, প্রকৃত অর্থেই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হলে, মানুষ ভোট দিতে পারলে বিএনপি ভালো ফলাফল করবে। সরকারের পক্ষে সহজে উতরে যাওয়া কঠিন হতে পারে। নির্বাচন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ না হলে, সরকার নির্বাচন পরোক্ষেও প্রভাবিত করলে সরকারকে অভাবনীয় মূল্য দিতে হবে বলে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে গভীরভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম, নির্বাচন সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, যেকোনো বিবেচনায়ই পরিস্থিতি সরকারের প্রতিকূলে নয়। প্রতিকূলে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মনোভাব নাটকীয়ভাবে সরকারের পক্ষে চলে আসার বিষয়টি রহস্যজনক। তারা মনে করেন, এর পেছনে ভারত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশাল ভূমিকা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারবিরোধী মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন, নীতিনির্ধারক পর্যায়ে জোরালোভাবেই ছিল। সরকারের চীনপ্রীতি ও চীনের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরতা এর কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও উচ্চপর্যায়ে বোঝানো হয়েছে, তাদের কারণেই বাংলাদেশকে চীনের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হয়েছে। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অব্জলকেন্দ্রিক ভূ-রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রকে বিষয়টি তার স্বার্থেই বিবেচনায় নিতে হবে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, ভারতের দিক থকে বিষয়টি খোলাসা করে তুলে ধরা হয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপ ১০০ বছরের জন্য লিজ নেওয়ার প্রস্তাব থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে এসেছে। তবে তাদের সাবমেরিন এখানে সাময়িক অবস্থান করতে পারবে। জ্বালানি নেওয়ার জন্য খণ্ডকালীন অবস্থানের সুযোগ ভারতও মার্কিন ডুবোজাহাজ, যুদ্ধজাহাজকে দিয়েছে। এ জন্য ছয়টি স্থান নির্ধারিত রয়েছে। বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনেও অনুরূপ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি কোনো অবস্থাতেই হুমকিস্বরূপ নয়। এ ধরনের ব্যবস্থা চীন, ভারতের ক্ষেত্রেও কার্যকর করতে বাধা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন সমঝোতার পেছনে নরেন্দ্র মোদির অসামান্য ভূমিকা রয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়।