Thikana News
২৫ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫
২০২৪ সালের আমেরিকার নির্বাচন (পর্ব-২)

ট্রাম্পের এই অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন কীভাবে সম্ভব হলো?

শেষ পর্যন্ত ভোটারদের কাছে আমেরিকার দুটি সংস্করণ উপস্থাপন করা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের বলেছিলেন, তাদের দেশ একটি ব্যর্থ জাতি, যা কেবল তিনিই একমাত্র আবার মহান করে দিতে পারেন। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে খোদ মার্কিন গণতন্ত্রই অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়বে
ট্রাম্পের এই অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন কীভাবে সম্ভব হলো?
২০২৪ সালের নির্বাচন নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে নাটকীয় এক প্রত্যাবর্তন। হোয়াইট হাউস ছাড়ার চার বছর পর লাখ লাখ আমেরিকান তাকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে ভোট দেন। এর ফলে  ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে যান। জানুয়ারি ২০২৫ সাল থেকে আবার তিনি ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন।
যখন নির্বাচনী প্রচারণার ইতিহাসের ওপর বই লেখা হবে, তখন মূল দুটি বিষয়ের ওপর সবার চোখ পড়বে :
১) দুটি হত্যার প্রচেষ্টা থেকে ট্রাম্প বেঁচে গিয়েছিলেন এবং
২) তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে নিজেকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এতে নতুন ক্যান্ডিডেট, ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, নির্বাচনী প্রচারণা করার জন্য যথেষ্ট সময় পাননি।
আরও যে কারণগুলো যোগ করা যায়, সেগুলো হলো :
৩) এবার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোর (যেখানে একবার ডেমোক্র্যাট তো আরেকবার রিপাবলিকান) সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকানই তাকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং
৪) এদের অনেকেই আবার দেশে বিরাজমান অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ইমিগ্রেশন বা অভিবাসনকেই তাদের প্রধান উদ্বেগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এ কথা মনে রাখতে হবে, ট্রাম্পের বিজয় এসেছে বেশ দৃশ্যমান একটি পতনের পরে এবং এই পতন কোনোভাবেই দর্শকনন্দিত ছিল না। জো বাইডেনের কাছে পরিষ্কার হেরে গেলেও তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পুরোপুরি অস্বীকার করেছিলেন। অফিসে টিকে থাকার জন্য ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টায় তার যে ভূমিকা ছিল, সেটা আজও যাচাই করা হচ্ছে, যেটা এখনো শেষ হয়নি। যেমন
১) কোন রাজ্য কাকে ভোট দিয়েছে?
২) ট্রাম্পের হাতে অবাধ রাজত্ব চলে আসার ফলাফল বিশ্লেষণ।
৩) যুক্তরাষ্ট্র কেন ট্রাম্পকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিল, তার বিশ্লেষণ।
৪) ট্রাম্প কবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন?
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে ইউএস ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে সহিংস হামলায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। ঠিকমতো রায় হলে, ব্যবসায়িক নথিপত্র জালিয়াতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রথম ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট হিসেবেও ইতিহাস গড়বেন তিনি। অনেকে মনে করেন, তিনি গভীর মেরুকরণ করা এক ব্যক্তি। তাদের মতে, নির্বাচনী প্রচারণার পুরোটা সময়ে ট্রাম্প উসকানিমূলক বাগাড়ম্বর করেছেন, উদ্ভট রসিকতা করেছেন এবং তার রাজনৈতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছেন।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ওই সব বিষয় বাদ দিলে অর্থনীতি নিয়ে তার বার্তা সবার মন ছুঁয়ে গেছে। অবশ্য ট্রাম্পের ক্ষেত্রে যেসব লোক দেখা গেছে, বলতে গেলে তাদের কেউই মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী ব্যক্তি ছিলেন না। কারণ প্রচারাভিযানের সময় যেসব সাংবাদিক ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের বেশির ভাগকেই বলতে শোনা গেছে, তারা চেয়েছিলেন  ট্রাম্প তার মুখে যেসব অকথ্য ভাষার ব্যবহার করেন, সেগুলো বন্ধ করুন। কিন্তু এসব প্রোপাগান্ডা ছাড়িয়ে তারা অতীতের দিকে তাকাতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিটি সমাবেশে ট্রাম্প যে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেদিকেই মনোনিবেশ করেছেন তারা। তার প্রধান প্রশ্ন ছিল, ‘আজ আপনারা চার বছর আগের চেয়ে কি ভালো আছেন?’ ট্রাম্প মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ার ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চেয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন এমন অনেক মানুষ বারবার বলেছেন, তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাদের মনে হয়েছিল অর্থনীতি অনেক ভালো ছিল। এখন তারা তাদের খরচ চালানোর চেষ্টা করতে করতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। যদিও মূল্যস্ফীতির বেশির ভাগ কারণ কোভিড-১৯ মহামারির মতো বাইরের শক্তির কারণে হয়েছিল কিন্তু তারা বাইডেন প্রশাসনকে এসবের জন্য দোষারোপ করে যাচ্ছিলেন।
বাইডেনের আমলে রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া অবৈধ অভিবাসন নিয়েও ভোটাররা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তারা সত্যি সত্যি বর্ণবাদী মতামত প্রকাশ করেন না বা বিশ্বাস করেন না যে অভিবাসীরা এসে এখানকার মানুষদের যাবতীয় পোষা প্রাণী খেয়ে ফেলছে, যদিও প্রোপাগান্ডা হিসেবে ট্রাম্প এবং তার সমর্থকেরা এটাই দাবি করেছিলেন। সাধারণ মানুষ শুধু চেয়েছিল সীমান্তে আরও শক্তিশালী বলপ্রয়োগ করা হোক, যাতে লাগামহীন অবৈধ অভিবাসনটা বন্ধ হয়।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রচারণাতেও ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগানটি আগের মতো বজায় ছিল। স্লোগানটি আমেরিকান ভোটারদের মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে। সারা দেশে সাংবাদিকেরা বাম ও ডান, উভয় দিকের লোকজনের কাছ থেকে বারবার অভিযোগ শুনেছেন, ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে, তারা ভেবেছিলেন সেই অর্থ তাদের নিজেদের দেশে আরও ভালোভাবে ব্যয় করা যেতে পারত।
জনসাধারণ শেষ পর্যন্ত কমলা হ্যারিসকে ভোট দিতে পারেননি এ কারণে যে তিনি পুরো চার বছর বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও যুদ্ধ থামানোর পক্ষে তার কোনো রোল দেখা যায়নি। একটা বাক্যও তিনি এ ব্যাপারে উচ্চারণ করেননি। তা সে ইউক্রেনের যুদ্ধই হোক বা গাজার যুদ্ধ হোক। এতে তাদের বদ্ধ ধারণা হয়ে গিয়েছিল, হ্যারিস থাকলে আগামী চার বছর সেই একইভাবে চলবে। কিন্তু পাবলিক তেমনটি আর চায় না। তারা এর পরিবর্তন চাচ্ছিল। সে জন্য হ্যারিসের ওপর থেকে তাদের মন উঠে যায়। তারা এই লাগামহীন যুদ্ধ আর চায় না বরং এই অবস্থার অবশ্যই একটা পরিবর্তন চায়।
প্রকৃতপক্ষে এই নির্বাচনের বিড়ম্বনা এটাই, আজকের প্রার্থী (ট্রাম্প), যিনি সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তিনি মাত্র চার বছর আগেও ক্ষমতায় ছিলেন। অবশ্য তখনকার আর এখনকার অবস্থার মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।
২০১৬ সালে যখন ট্রাম্প সাহেব প্রথম ক্ষমতায় আসেন, তখন রাজনৈতিক দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন বহিরাগত। সে জন্য অন্তত কিছু সময়ের জন্য তিনি নিজেকে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং কর্মীদের তার চারপাশে ঘিরে রেখেছিলেন। তারা তাকে উপরে ওঠার দড়িটি দেখিয়েছিলেন এবং তার কম অভিজ্ঞতার কারণে তার ক্রিয়াকলাপকে সীমাবদ্ধ করে রেখে দিয়েছিলেন। অবশ্য আজ আর সে অবস্থা নেই। এখন তিনি অভিজ্ঞ। এখন সেই খেলার নিয়ম মেনে চলতে তার তেমন আগ্রহ আর আছে বলে মনে হয় না।
আগে এই একই উপদেষ্টা এবং কর্মীদের অনেকেই তাকে ‘মিথ্যাবাদী’, ‘ফ্যাসিবাদী’ এবং ‘অযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছেন। তারা আবার সাবধান করে দিয়েছেন, যদি তিনি নিজেকে অনুগতদের সঙ্গে ঘিরে রাখেন, তবে তার আরও চরমপন্থী সব ধারণা থেকে তাকে বিরত রাখার মতো কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।
প্রথম মেয়াদের দায়িত্ব ছাড়ার সময় ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের দাঙ্গায় তার ভূমিকা, জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্র তিনি কি কীভাবে সামলাতেন, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, একজন পর্নো তারকাকে গোপনে অর্থ প্রদানের মতো ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখিও হয়েছিলেন তিনি। 
কিন্তু যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন, অফিসে অফিশিয়াল কাজের জন্য প্রেসিডেন্টের বিচার থেকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তির বিধান রয়েছে, তাই পরবর্তী প্রশাসনের সময় যেকোনো প্রসিকিউটরের পক্ষে তাকে অভিযুক্ত করা একটি কঠিন লড়াই হয়ে দাঁড়াবে। আবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি নিজেই তার বিচার বিভাগকে ৬ জানুয়ারির দাঙ্গা-সম্পর্কিত তার বিরুদ্ধে ফেডারেল অভিযোগ প্রত্যাহারের নির্দেশ দিতে পারেন। তেমন হলে তাকে আর কারাদণ্ডের বিষয়ে চিন্তা করতে হয় না এবং একই সঙ্গে ক্যাপিটল দাঙ্গায় জড়িত থাকার দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত শত শত মানুষকে ক্ষমা করে দিতে পারেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত ভোটারদের কাছে আমেরিকার দুটি সংস্করণ উপস্থাপন করা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের বলেছিলেন, তাদের দেশ একটি ব্যর্থ জাতি, যা কেবল তিনিই একমাত্র আবার মহান করে দিতে পারেন। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ট্রাম্প নির্বাচিত হলে খোদ মার্কিন গণতন্ত্রই অস্তিত্বের হুমকির মুখে পড়বে। এখন সেটাই দেখার বিষয়।
কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প নিজেই যা বলে গেছেন, তা মানুষের আশঙ্কা দূর করতে পারেনি। তিনি রাশিয়ার ভøাদিমির পুতিন এবং উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের মতো কর্তৃত্ববাদী নেতাদের প্রশংসা করেছেন এই বলে যে তারা ‘তাদের খেলার শীর্ষে রয়েছেন, আপনি এটি পছন্দ করুন বা না করুন’।
সংবাদমাধ্যমে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টার কথাও বলেছেন তিনি। তিনি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং নির্বাচনে জালিয়াতির ভিত্তিহীন দাবিকে প্রশস্ত করা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু সেগুলোর আর দরকার হয়নি। নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত তাকে বিজয়ের দিকে পরিচালিত করেছিল।
এখন ভোটাররা দেখবেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি যা বলেছিলেন তার কতটুকু ছিল ‘ট্রাম্প হচ্ছেন ট্রাম্প’ এই বাচনটি ফলপ্রসূ হতে পারবে। এটা মনে রাখতে হবে, কেবল আমেরিকানদেরই যে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে তা নয়, বাকি বিশ্বও এখন আবিষ্কার করবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বলতে আসলে কী বোঝায়।
তিনি মার্কিন আমদানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিণতি থেকে শুরু করে ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পর্যন্ত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে তার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এখন দ্বিতীয় ম্যান্ডেট নিয়ে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে কম বোঝা নিয়ে আমেরিকা এবং বিশ্ব দেখতে পাবে তিনি আসলে কতটুকু কী করতে পারেন।
 

কমেন্ট বক্স