‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের অনুভূতিতে পূর্ণতার স্বাদ এনে দেয়। ১৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে আমরা পিয়েতারসারি থেকে রওনা হলাম তাম্পেরের উদ্দেশে। আমাদের মন ভারাক্রান্ত। বাবু মানে আমার ভাই আর যাচ্ছে না আমাদের সঙ্গে। ওকে ছেড়ে যাচ্ছি। আবার কবে দেখা হবে কে জানে! মনে পড়ে গেল নীলফামারী থেকে শৈশবে যখন সুনামগঞ্জ ফিরতাম, অর্ধেক রাস্তা আমরা অশ্রুসজল থাকতাম। আজও আমরা অশ্রুসজল চোখে বিদায় নিলাম। বাবুর অফিস করতে হবে আগামীকাল থেকে। আমাদের সঙ্গে এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে এসেছে। এর আগে এক সপ্তাহ বেলজিয়ামে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়েছিল আর তার আগের মাসে বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রীসহ লফোটেন ঘুরে এসেছে। তাই আর ছুটি পাওনা নেই। এবার ড্রাইভিং সিটে তানিয়া। আর ওদের ছোট ছেলে সুজনসহ যাচ্ছি। তানিয়া আর সুজন পুরোদমে বাংলা বলতে পারে। তবে ওদের জিপিএস ফিনিশ ভাষায় কথা বলে।
ভ্রমণমাত্রই বৈচিত্র্যের অবগাহন। দৈনন্দিন জীবনের তাড়াহুড়ো থেকে বেরিয়ে আসাতে এর কোনো বিকল্প নেই। ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা জীবন থেকে মুক্ত হয়ে দেশ-বিদেশ ঘোরাঘুরি এক উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে শেখায়। যারা ৯টা-৫টার গোলকধাঁধার নৈরাশ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তাদের একমাত্র ওষুধ-ভ্রমণ। দেশ-বিদেশ ঘোরা মানে নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচত হওয়া, নতুন ভাষার সঙ্গে পরিচিতি। নতুন খাবার, নতুন কৃষ্টির সঙ্গে পরিচয়। নীল রঙের কোনো লেকের শান্ত পানিতে ডুব দেওয়া বা পর্বতচূড়ায় মেঘের ধোঁয়াশায় চোখ রেখে নিজের চোখে সৌন্দর্যটুকু ধারণ করা। এই শ্বাসরুদ্ধকর আশ্চর্যগুলো জীবনটাকেও একইভাবে সুন্দর করার জন্য দৃষ্টি খুলে দেয়।
সকালে আমরা ভাইয়ের বাসা থেকে বের হলাম। বাবুর মনটা নরম। আমরা কাঁদলাম। জীবন এক মায়া। শিশুবয়সে সামারের ছুটির পর নীলফামারীতে গিয়ে ১০-১৫ দিন থেকে যখন সুনামগঞ্জে ফিরতাম, কাঁদতে কাঁদতে ফিরতাম। আজও আমি শক্ত থাকতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত ভাইটা আমার নিজে কেঁদেই আমাকেও কাঁদাল। দুজনেই কাঁদলাম। সঙ্গে ওর বিদেশি বউটাও কাঁদল।
আমরা এখন তাম্পেরে যাচ্ছি। তানিয়া ড্রাইভ করছে। তাম্পেরে ইউনিভার্সিটিতে বাবু কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তে এসেছিল। তানিয়াও পড়ত এই ইউনিভার্সিটিতে। বাবুর ইউনিভার্সিটি দেখে বিকেলে তুর্কু যাব। তুর্কু থেকে সন্ধ্যার স্টিমার নিয়ে স্টকহোমে পৌঁছাব ভোরে। এখন মাইলের পর মাইল পাইনের বন। হৃদয় হু হু করে। জীবনের টানে মানুষ শুধু ছুটে চলে। স্থিতি ভালো বাসলেও থাকা হয় না এক জায়গায় দীর্ঘ দিন। আজ আকাশেরও মন খারাপ। থমথমে মুখ। টুপটাপ ঝরছে সকাল থেকে। পৃথিবীর বুকে এত সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। কতটুকু আর এক জীবনে একজন দেখতে পারে বা দেখার সৌভাগ্য হয়। আমার মেয়ে আমাকে প্রতিবছর ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে। এ বছর প্রথমে এপ্রিল মাসে গ্রিসে যাওয়ার প্ল্যান করে দেখা গেল, আমার পাসপোর্ট রিনিউ করতে হবে। আর মেয়েও ছুটি পেল না ওই সময়। মাঝে আবার আমাকে বিশেষ দরকারে দেশে যেতে হলো। তখন সেপ্টেম্বর মাসে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ঘোরার প্ল্যান হলো। আমরা হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ করে প্ল্যান বানাতে থাকি, কই কই যেতে চাই। বাবু জানায় কই কই যাওয়া যাবে। ছুটি মিলিয়ে নেয়। তারপর ফ্লাইট বুকিং করি। বাবু পরিকল্পনা অনুযায়ী ফেরি, এয়ারবিএনবিতে বুকিং সব করে ফেলে। আমরা ৪ সেপ্টেম্বর এসে হেলসিঙ্কি এয়ারপোর্টে নামলাম ব্রিটিশ এয়ারলাইন্স আর ফিনএয়ার লাইন্সের যুক্ত বিমানে। হেলসিঙ্কি এয়ারপোর্টে লাগেজ পাওয়ার পর ট্রেন নিয়ে সেন্ট্রাল রেল স্টেশনে পৌঁছালাম। ভাইয়ের ছেলে জাফির সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশনে দেখা করে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। আমরা রাতে পিয়েতারসারিতে পৌঁছাই।
রোড ই-১২ নিয়ে তাম্পেরে এলাম ঘণ্টা দুয়েক ড্রাইভ করার পর। অরা নামক রেস্টিং এরিয়ায় ফ্রেশ হতে নামলাম। অরা ফিনল্যান্ডের একটি নদীর নাম। রেস্টরুমগুলোতে ওয়াটারবিডেট আছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এবারের ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য দিকÑইউরোপের শহর ফিনল্যান্ডে টয়লেটগুলোতে এত সুন্দর পানির ব্যবস্থা, একদম দুবাই-কাতারের মতো। আমরা অরার রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলাম। বৃষ্টি এল বেশ জোরে। পিসপালা সম্ভবত তাম্পেরের সবচেয়ে সুন্দর অংশ। রঙিন কাঠের ঘর, খাড়া শিলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রাস্তা, বাগান ও সিঁড়ির ধাপগুলো। রিজ থেকে নাসিজারভি এবং পাইহাজারভি হ্রদের দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন অথবা দক্ষিণ হ্রদ থেকে পুরো পিসপালা শৃঙ্গটির ছবি নিতে পারবেন। আমরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে নামি। পিসপালায় ফিনিশ কবি লরি ভিতার স্মৃতিস্তম্ভটি রিজের সর্বোচ্চ বিন্দুর কাছে অবস্থিত এবং শট টাওয়ার নামে একটি বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক আছে। তানিয়ার এলিমেন্টরি স্কুলটি আর তার খেলাধুলার জায়গা তাদের আগের বাসার এখানেই। তার স্কুলের বান্ধবীর বাসাও এই মনোরম স্থানে। প্রাচীনতম পাবলিক সাওনা, ক্যাফে পিসপালা এবং পিসপালান পুলতেরি রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন করতে পারেন।
তাম্পেরে নর্ডিক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল শহর। শহর এলাকায় আনুমানিক জনসংখ্যা ৩ লাখ ৪০ হাজার। তাম্পেরে ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহুরে, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তাম্পেরের দুটি হ্রদ-লেক নাসিজারভি এবং লেক পাইহাজারভির মধ্যে জলস্তরের ১৮ মিটার পার্থক্য রয়েছে। অতি সম্প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ও ফিনিশ শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে তাম্পেরে ‘উত্তরের ম্যানচেস্টার’ নামে পরিচিত, যা তার ফিনিশ ডাকনাম ‘মানসে’ ও ‘ম্যানসারক’ এর মতো শব্দের জন্ম দিয়েছে। তাম্পেরেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বের সাউনা ক্যাপিটাল’ হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ, এখানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাবলিক সাউনা আছে। হেলসিঙ্কি তাম্পেরের প্রায় ১৬০ কিমি দক্ষিণে এবং পেন্ডোলিনো হাই-স্পিড ট্রেনে ১ ঘণ্টা ৩১ মিনিটে এবং গাড়িতে ২ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়। হেলসিঙ্কি এবং তাম্পেরের পরে দেশের তৃতীয় সর্বাধিক জনবহুল নগর এলাকা তুর্কুর দূরত্ব প্রায় একই। পৃথিবী বিখ্যাত নকিয়া করপোরেশন হলো একটি ফিনিশ বহুজাতিক টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স করপোরেশন, যা মূলত ১৯৮৫ সালে একটি পাল্প মিল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নকিয়ার প্রধান সদর দপ্তর হেলসিঙ্কি মেট্রোপলিটন এলাকায় ফিনল্যান্ডের এস্পুতে অবস্থিত। কিন্তু কোম্পানির প্রকৃত শিকড় তাম্পেরেতে। তাম্পেরেতে ১৮০টি হ্রদ আছে। তাম্পেরেতে অনেক স্থাপত্য নিদর্শনের চিহ্নস্বরূপ বহু পুরোনো ভবন আছে। মেসুকিলার ওল্ড স্টোন চার্চ মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের একমাত্র উদাহরণ। তাম্পেরে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অফিসের মতে, অঞ্চলটি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অটোমেশন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য ও জৈবপ্রযুক্তি, সেই সঙ্গে পাল্প ও কাগজশিল্পে শক্তিশালী। তাম্পেরে ইউনিভার্সিটি দুটি ক্যাম্পাসে অবস্থিত। একটি কালেভানহারজু জেলায়, শহরের কেন্দ্রের কাছে এবং একটি শহরের দক্ষিণ অংশে হেরভান্তায়। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব তাম্পেরে (ইউটিএ) এবং তাম্পেরে ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (টিইউটি) একত্রিত হওয়ার ফলে গঠিত হয়েছিল। তাম্পেরের প্রধান খেলা আইস হকি। প্রথম ফিনিশ আইস হকি ম্যাচটি তাম্পেরেতে অনুষ্ঠিত হয়। এই শহরে বাবু আর তানিয়ার দেখা হয়েছিল। বিয়েও হয় এই শহরে। ওদের বিয়ের সময় বড় মামা উপস্থিত ছিলেন। ওদের প্রথম বেবি সাফিনের জন্মও এ শহরে। বৃষ্টির ভেতর তাম্পেরেতে এসব কিছু দেখা হলো। বাবুর ইউনিভার্সিটি দেখলাম। এই শহরে ওদের পরিচয়, বিয়ে, প্রথম সংসার। ওদের স্মৃতিময় শহর। শহরটি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। তানিয়ার জন্ম এ শহরে না হলেও স্কুল শুরু এ শহরে। ওর স্কুল আর বাসা দেখলাম। ওর বাবা এ শহরে এখনো থাকেন। মা শৈশবে মারা গেছেন। বাবুর ছোট ভাই শুভও এখানে কম্পিউটার সায়েন্স পড়েছিল। বৃষ্টির তোপ বাড়ল। বাবুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করে আমরা তুর্কুর দিকে রওনা হলাম। এখন ই-৬৩ ধরে তুর্কু যাচ্ছি। বৃষ্টি আজ আর থামছে না। তুর্কু ফিনল্যান্ডের প্রাচীনতম শহর। তুর্কু ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অরা নদীর মুখে অবস্থিত। তুর্কুকে কখন শহরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তা জানা যায়নি। পোপ গ্রেগরি (নবম) ১২২৯ সালে প্রথম আবোয়া শহরের উল্লেখ করেছিলেন এবং এ বছরটি এখন শহরের প্রতিষ্ঠার বছর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তুর্কু ছিল সুইডেন রাজ্যের (আজকের ফিনল্যান্ড) পূর্ব অংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। ফিনিশ যুদ্ধের পর, ফিনল্যান্ড ১৮০৯ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের একটি স্বায়ত্তশাসিত গ্র্যান্ড ডাচি হয়ে ওঠে এবং তুর্কু গ্র্যান্ড ডাচির রাজধানী হয়। তুর্কু হলো একটি দ্বিভাষিক পৌরসভা, যেখানে ফিনিশ এবং সুইডিশ এর সরকারি ভাষা। জনসংখ্যার ৭৯ পারসেন্ট ফিনিশ ভাষাভাষী। ১৯৯৬-এ তুর্কু শহরটিকে ফিনল্যান্ডের ‘ক্রিসমাস সিটি’ ঘোষণা করা হয়। তুর্কুকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিনল্যান্ডের ফুড ক্যাপিটাল হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ এখানে আছে ফিনল্যান্ডের প্রাচীনতম এবং সর্বোচ্চ মানের কিছু রেস্তোরাঁ। সেই সঙ্গে বছরে দুবার অনুষ্ঠিত হয় একটি ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত মাছের বাজার। তুর্কুর ক্যান্টিন ও ক্যাফে সংস্কৃতিকে প্রায়শই ফরাসি খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে তুলনা করা হয়। যে কারণে তুর্কু ‘ফিনল্যান্ডের প্যারিস’ নামেও পরিচিত।
কাকোলা ফানিকুলার ২০১৯ সালে চালু হওয়া প্রথম ফানিকুলার, তুর্কুতে অবস্থিত। এটি সত্যিকারের ফানিকুলার নয়, কারণ এটিতে কোনো মানব অপারেটর নেই বা কাউন্টারওয়েট হিসেবে দ্বিতীয় গাড়ি নেই। ফানিকুলার লিফটটি কাকোলানমাকি পাহাড়ে নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতের সুযোগ করে দেয়, যেখানে অন্য কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। ফানিকুলারের দুটি স্টেশন আছে এবং স্টেশনগুলোর মধ্যে ভ্রমণের সময় প্রায় এক মিনিট। উভয় স্টেশনে হপিং এবং অফ করা সম্ভব এবং বিনা মূল্যে ভ্রমণ করা যায়। বৃষ্টির জন্য আমরা এটা মিস করলাম। তুর্কু শহরে বাড়িঘরগুলো খুব মজবুত কাঠামোর। তুর্কু ক্যাসেল এবং তুর্কু ক্যাথেড্রাল সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে প্রাকৃতিক পাথরে নির্মিত মধ্যযুগীয় বিল্ডিং। তুর্কু অঞ্চল ফিনিশ প্রাকৃতিক পাথরশিল্পের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিল্ডিং উপাদান হিসেবে প্রাকৃতিক পাথর সুন্দর, বহুমুখী, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং প্রায় চিরস্থায়ী স্থায়িত্ব রয়েছে। তুর্কুর ইতিহাসজুড়ে বিভিন্ন ধরনের নির্মাণের জন্য প্রাকৃতিক পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। তুর্কুর নিউ সিটি গ্রন্থাগারটি শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে অবস্থিত। নতুন লাইব্রেরির একটি কার্যকরভাবে পরিষ্কার নকশা রয়েছে। পাবলিক স্পেসগুলো প্রধানত উঠানের খোলার চারপাশে দুটি তলায় অবস্থিত। ভবনটি পুরোনো লাইব্রেরি এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান ভবনসহ একটি ব্লকের সর্বশেষ সংযোজন। সাইটটির ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য নতুন ভবনের পরিকল্পনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করেছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল একটি নতুন স্থাপনা তৈরি করা, যা ঐতিহাসিকভাবে অমূল্য স্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং তার নিজস্ব যুগের একটি স্থাপত্যকেও প্রকাশ করবে। ক্যাথেড্রালটি দেশের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হয়েছে এবং এটি শহরের সবচেয়ে স্বীকৃত প্রতীক হয়ে উঠেছে। ক্যাথেড্রালটি অরা নদীর তীরে ওল্ড গ্রেট স্কয়ারের পাশে তুর্কুর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। জাতীয় রেডিওতে সম্প্রচারিত দুপুরবেলা বেল বাজানোর মাধ্যমে এর উপস্থিতি স্থানীয় এলাকা ছাড়িয়ে প্রসারিত হয়। এটি ফিনল্যান্ডের বার্ষিক ক্রিসমাস উদ্্যাপনের কেন্দ্রবিন্দু। আমরা ফন্টানা নামের রেস্টুরেন্টে বৈকালিন চা পর্ব ক্যারট কেক, পেস্ট্রি, চিজ, কেক, কফি, চা খেলাম। তারপর ক্যাথেড্রালটি দেখতে গেলাম। গির্জার পাঁচটা বাজার ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিল তখন। আর অবস্থানের কারণে তুর্কু বন্দরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এবং যাত্রীবাহী সমুদ্রবন্দর। যেখানে প্রতিবছর তিন মিলিয়নেরও বেশি যাত্রী স্টকহোম ও মারিহ্যামন ভ্রমণ করেন। এ ছাড়া তুর্কু বন্দর থেকে সুইডেন ও আল্যান্ড পর্যন্ত দৈনিক ফেরি পরিষেবা রয়েছে, যা সিলজা লাইন এবং ভাইকিং লাইন দ্বারা পরিচালিত হয়। লোকেরা প্রায়শই বোথনিয়া উপসাগরজুড়ে ক্রুজ নিতে ফিনল্যান্ডজুড়ে তুর্কু পর্যন্ত দীর্ঘ দূরত্ব ভ্রমণ করে। ভাইকিং লাইন ফেরির গ্রেস নামক ফেরিটি আমাদের নিয়ে সন্ধ্যা নয়টায় স্টকহোমের উদ্দেশে রওনা হলো। আমরা আমাদের কেবিনে পৌঁছে দেখি চারটি টুইনবেড আর অ্যাটাচড টয়লেটসহ সুন্দর কেবিন। কেবিনে চারটা বেড। দুটো বাঙ্ক বেড ওপরে, দুটো নিচে। বাবু আবার আগেই বলে দিয়েছে, আপা, আপনি আর তানিয়া ওপরের বেডে ওঠার চিন্তাও করবেন না। পড়ে গেলে গন্ডগোল হয়ে যাবে। এখন ডাইনিংয়ে এসেছি। আজ সমুদ্রযানখানা সম্পূর্ণ ভর্তি। বেশ ভিড়। রাতের খাবারের সঙ্গে সমুদ্রযাত্রা। পাশে ফুল মুন আকাশে উঠল। ডিনারের পর ডিসকো যেখানে হবে, সেই এরিয়া দেখতে গেলাম। তখনো আয়োজন জমজমাট হয়নি। এরপর গেলাম শপিংয়ে। কে বলবে এটা শিপ? বড় কোনো মেগা শপের মতো সব ধরনের আইটেম আছে। আমরা পারফিউম আর চকলেট সেকশনে গেলাম। কেনা হলো চকলেট আর সুগন্ধি। রাতে ওপরের বেডে একটিতে পূর্ণতা আর একটিতে সুজন উঠে শুয়ে পড়ল। আমি আর তানিয়া নিচে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙল, দেখি গোলাকার জানালার বাইরে মস্ত গোল এক চাঁদ। চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে চারপাশ। আদিগন্ত পানি আর পানি। পর্দা টেনে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এরই ভেতর ফিনল্যান্ড আর সুইডেনের সময় পার্থক্য এক ঘণ্টা। তাই ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে গেল। এক ঘণ্টা বাড়তি সময় ঘুমাতে পারলাম। ভোরের আলো ফুটতেই আবার জানালায় চোখ রাখলাম। দেখি, অনেক ছোট ছোট দ্বীপ। আমরা স্টকহোম পৌঁছাব আজ। বহুদিন আগে যখন আমার বয়স বিশ, তখন আমাদের শহরের সৈয়দ শফিক মামা স্টকহোমে থাকতেন। বিচিত্রায় প্রবাস থেকে কলাম লিখতেন সুইডেনের নানা বিষয় নিয়ে। সে সময় দেশে ফিরলে আব্বার অনুরোধে আমাকে অর্থনীতি আর স্ট্যটিসটিকস বোঝানোর পাশাপাশি মামা স্টকহোমের অনেক গল্প করতেন। গামলাস্টেন স্টেশনের নামটা মনে পড়ল।
এ পৃথিবীতে প্রকৃতির কত অফুরন্ত সম্ভার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, বন-বনানী সৌন্দর্যের অপরূপ ডালি বিধাতা সাজিয়ে রেখেছেন এ পৃথিবীতে। মানুষ অসীম আগ্রহ আর অনন্ত উৎকণ্ঠা নিয়ে এ নৈসর্গিক দৃশ্যকে অবলোকন করার জন্য দেশ থেকে দেশে ছুটে চলে। এ যেন এক দুরন্ত নেশা। এর মাঝে যে রোমাঞ্চ আছে, তার স্বাদই আলাদা। জীবনের আনন্দকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগের জন্য, জীবন ও জগৎকে জানার জন্য দেশ ভ্রমণ অপরিহার্য।