১৯৩৮ সাল। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তারা দু’জন গোপালগঞ্জ আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন। অ্যাগজিভিশনও হবে ঠিক হয়েছে। বাংলার এই দুই নেতা এক সাথে গোপালগঞ্জ আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হলো। তখন বঙ্গবন্ধু স্কুলের ছাত্র। অসুস্থতার কারণে বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়া অনেকদিন বন্ধ ছিলো। তাই স্কুলে সবার চাইতে একটু বয়স বেশি। নেতাদের আগমণে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠণ করার দায়িত্ব পড়লো বঙ্গবন্ধুর উপর। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করলে পরে দেখা গেলো, হিন্দু ছেলেরা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়েছে। ব্যাপারটা তখন বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারছিলেন না। তাই একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, হিন্দু ছেলেরা কেনো আসেনি? যাকে জিজ্ঞেস করেছিলো সেও ছাত্র। সে বঙ্গবন্ধুকে বললো, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে ঐ সভায় যোগদান করতে। যাতে বিরূপ সংবর্ধনা হয়, তারও চেষ্টা করবে। অ্যাগজিভিশনে যাতে কোনো দোকান-পাট না বসে, তাও কংগ্রেস থেকে বলে দেয়া হয়েছে। তখনকার দিনে শতকরা আশিটি দোকানই ছিলো হিন্দুদের। বঙ্গবন্ধু এ খবর শুনে আশ্চর্য হলেন! তখন বঙ্গবন্ধু কখনও হিন্দু-মুসলমান নিয়ে মোটেও ভাবতেন না। এবং বঙ্গবন্ধুর হিন্দু ছেলেদের সাথে খুব বন্ধুত্ব ছিলো। তিনি তাদের সাথে একসাথে গান-বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো- সবই করতেন।
অনেক নেতা বঙ্গবন্ধুকে বললেন, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন বলে হিন্দুরা ক্ষেপে গিয়েছে। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু একটু বিচলিত হলেন। বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, যে করেই হোক সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হককে সংবর্ধনা দিতেই হবে। তার জন্য যা কিছু করতে হয়, তা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মুসলমান ছেলেদের নিয়েই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করলেন। তবে কিছুসংখ্যক নমশুদ্র হিন্দু বঙ্গবন্ধুর সাথে অংশগ্রহণ করলেন। কারণ মুকুন্দবিহারী মল্লিক তখন মন্ত্রী ছিলেন, তিনিও ফজলুল হকের সাথে আসবেন। তখনকার সময় শহরে হিন্দুরা সংখ্যায় খুব বেশি ছিলো। গ্রাম থেকে যথেষ্ট লোক এলো, বিশেষ করে নানা রকম অস্ত্র নিয়ে। যদি কেউ বাধা দেয়, যা কিছু হয় হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হতে পারতো। দুই মন্ত্রী- সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা ফজলুল হক আসলেন। সভা হলো, অ্যাগজিভিশনও উদ্বোধন করলেন। শান্তিপূর্ণভাবে সবকিছুই হলো। ফজলুল হক পাবলিক হল দেখতে গেলেন। আর শহীদ সোহরাওয়ার্দী গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। বঙ্গবন্ধু মিশন স্কুলের ছাত্র। বঙ্গবন্ধু শহীদ সাহেবকে স্কুলে সংবর্ধনা দিলেন। শহীদ সাহেব স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন। বঙ্গবন্ধুও সাথে সাথে চললেন। শহীদ সাহেব ভাঙা ভাঙা বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে কি যেনো জিজ্ঞেস করলেন। বঙ্গবন্ধুও উত্তর দিলেন। শহীদ সাহেব বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? একজন সরকারি কর্মচারি বঙ্গবন্ধুর বংশের কথা বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শহীদ সাহেব বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে ডেকে নিলেন। আদর করলেন এবং বললেন, তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ গঠণ করা হয়নি? বঙ্গবন্ধু বললেন, না কোন প্রতিষ্ঠান নেই। মুসলিম ছাত্রলীগও নেই। শহীদ সাহেব কিছুই আর বললেন না। শুধু নোটবুক বের করে বঙ্গবন্ধুর নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু একটি চিঠি পেলেন। চিঠিতে বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছেন, কলকাতা গেলে যেনো শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুও চিঠির উত্তর দিলেন। এইভাবে তাদের মধ্যে নিয়মিত চিঠিপত্র আদান-প্রদান হতো। ঐসময় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটু আড়া-আড়ি চলছিলো। গোপালগঞ্জ শহরের পাশে অনেক হিন্দু গ্রাম ছিলো। দু’একজন মুসলমানরে উপর অত্যাচারও হলো। আবদুল মালেক নামে বঙ্গবন্ধুর এক সহপাঠী ছিলো। সে খন্দকার শামসুউদ্দিন আত্মীয় হতো। একদিন বঙ্গবন্ধু খেলাধুলা করে মাঠ থেকে বাড়ি এসেছেন। বঙ্গবন্ধুকে খন্দকার শামসুল হক ওরফে বাসু মিয়া মোক্তার সাহেব (এই লোক পরে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন) বঙ্গবন্ধুকে ডেকে বললেন, মালেককে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করছে। যদি পারো একবার যাও। আরো বললেন, তোমার সাথে ওর বন্ধুত্ব আছে, তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসো। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু কিছু ছাত্রকে ডাকলেন। অনেককে নিয়ে একসাথে সেই বাড়িতে গেলেন। অনুরোধ করলেন, তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। রমাপদ দত্ত নামে এক ভদ্রলোক বঙ্গবন্ধুকে দেখেই গালি দিয়ে বসলো। বঙ্গবন্ধু তার কথার প্রতিবাদ করলেন এবং আরো ছাত্রকে আসতে বললেন। এর মধ্যে রমাপদরা থানায় খবর দিয়ে দিলো। ৩ জন পুলিশ এসে হাজির হয়ে গেলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, ওকে ছেড়ে দিতে হবে, না হলে কেড়ে নেবো। বঙ্গবন্ধুর মামা শেখ সিরাজুল হক হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। আরেক মামা নারায়ণগঞ্জে ব্যবসা করতেন, তার নাম শেখ জাফর সাদেক। তারা খবর পেয়ে দলবল নিয়ে ছুটে এলেন। এর মধ্যেই মারপিট শুরু হয়ে গেলো। দু’পক্ষে ভীষণ মারপিট হলো। বঙ্গবন্ধু দরজা ভেঙে মালেককে নিয়ে চলে আসেন। এ ঘটনার পর শহরে খুব উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধুকে কেউ কিছু বলতে সাহসও পাচ্ছে না। সেদিন ছিল রবিবার। বঙ্গবন্ধুর বাবা ছুটির দিন বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঘটনা ঘটেছে গোপালগঞ্জে। গোপালগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ১৪ মাইল। নৌকায় ছিলো যাওয়া-আসা। হিন্দুরা রাতে এসে হিন্দু অফিসারের সাথে আলাপ করে একটা মামলা দায়ের করলো। হিন্দু নেতারা থানায় বসে মামলায় এজাহার ঠিক করে দিলেন। ঐ মামলায় খন্দকার শামসুল হক মোক্তার সাহেবকে হুকুমের আসামী, আর বঙ্গবন্ধু খুন করার চেষ্টা করে দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়েছিলো- এভাবে মামলা করা হলো। ঐ মামলায় নাম দেয়া হলো বঙ্গবন্ধুর মামা মোক্তার সাহেব, খন্দকার শামসুল উদ্দিন আহমেদ এমএমএ-র মুহুরী জহুর শেখ, শেখ নূরুল হক ওরফে মানিক মিয়া, সৈয়দ আলী খন্দকার, আবদুল মালেকসহ আরো অনেকের। কোন গণ্যমান্য লোকের ছেলেদের নাম বাদ রাখেনি। বঙ্গবন্ধু সকাল ৯টায় খবর পেলেন। এর মধ্যে অনেককে গ্রেফতার করে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কি করে আসবে, দারোগা বাবু একটু লজ্জায় পড়ে গেলেন। সকাল ১০টায় টাউন হল মাঠে দাঁড়িয়ে দারোগা আলাপ করছেন, সময় নষ্ট করছেন, বঙ্গবন্ধু যেনো পালিয়ে যান। টাউন হলের পথেই বঙ্গবন্ধুর বাসা। বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতো। সে বঙ্গবন্ধুকে বললো, মিয়া ভাই পাশের বাড়িতে একটু সরে যাও। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি যাবো না, আমি পালাবো না। লোকে বলবে আমি ভয় পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর বাবা বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। দারোগা বাবুও তার পিছনে পিছনে বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন। দারোগা বাবু আস্তে আস্তে বঙ্গবন্ধুর বাবাকে সব ঘটনা খুলে বললেন। বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারী পরোয়ানাও দেখালেন। বঙ্গবন্ধুর বাবা বললেন, নিয়ে যান। দারোগা বাবু বললেন, খেয়েদেয়ে আসুক, আমি একজন সিপাহি রেখে যাচ্ছি, আর ১১টার মধ্যে যেনো থানায় পৌঁছে। কারণ দেরি হলে জামিন পেতে অসুবিধা হবে। বাবা বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, মারামারি করেছো? বঙ্গবন্ধু চুপ করে থাকলেন, যার আর্থ দাঁড়ালো, করেছি। বঙ্গবন্ধুর খাওয়া-দাওয়া করে থানায় চলে গেলেন। গিয়ে দেখেন, বঙ্গবন্ধুর মামা, মানিক-সৈয়দসহ আরো ৭/৮ জন হবে, তাদের আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পৌঁছার সাথে সাথেই তাদের কোর্টে পাঠিয়ে দেয়া হলো। তবে হাতকড়া দেয়নি। সামনে পুলিশ, পিছনেও পুলিশ। কোর্ট দারোগা হিন্দু ছিলেন। কোর্টে যাওয়ার সাথে সাথেই কোর্ট হাজতে নিয়ে তালা লাগিয়ে দিলেন। কোর্ট দারোগার রুমের সাথেই হাজতখানা। বঙ্গবন্ধুকে দেখেই বললেন, মুজিবুর খুব ভয়ানক ছেলে। ছোরা মেরেছিলো রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যাবে না।
বঙ্গবন্ধু বললেন, বাজে কথা বলবেন না, ভালো হবে না। যারা দারোগা সাহেবের সামনে বসছিলেন, দারোগা তাদের বললেন, দেখো ছেলের সাহস। অন্যলোকেরা বঙ্গবন্ধুকে কথা বলতে নিষেধ করলেন। বঙ্গবন্ধু জানতে পারলেন, তিনি নাকি ছোরা দিয়ে রমাপদকে মারতে গিয়েছিলেন- এজাহারে তা উল্লেখ আছে। রমাপদের অবস্থা ভয়ানক খারাপ, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে রমাপদের সাথে মারামারি হয় একটা লাঠি দিয়ে। যার জন্য ওর মাথা ফেটে গেছে। মুসলমান উকিল বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জামিনের আবেদন দাখিল করলো। জজ সাহেব মোক্তার সাহেবকে জামিন দিয়ে বাকি সবাইকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। এমডিও হিন্দু ছিলেন, তাই জামিন দিলেন না। কোর্ট দারোগা হাতকড়া পরাতে হুকুম দিলেন। বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়ালেন। সবাই বঙ্গবন্ধুকে বাধা দিলো। জেলে চলে গেলেন। মেয়েদের রাখার একটি রুমে রাখা হলো। কারণ তখন সেখানে কোন মেয়ে আসামী ছিলো না। বাড়ি থেকে বিছানা, খাবার দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ৭ দিন হাজতে থাকতে হলো। তারপর জামিন পেলেন। ১০ দিনের মধ্যে সবাই জামিন পেলো। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে টেলিগ্রাম করা হলো। হিন্দু উকিলের সাথে বঙ্গবন্ধুর বাবার বন্ধুত্ব ছিলো। তারপর উভয়ের মধ্যে আলোচনা হলো। ১,৫০০ টাকার বিনিময়ে ওরা মামলা প্রত্যাহার করবে। টাকা দেয়া হলে ওরাও মামলা প্রত্যাহার করলো।
এটাই ছিলো বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রথম মামলা ও কারাবাস।