১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভের পর পেরিয়ে গেছে দুই শতাব্দীরও বেশি সময়। এই দীর্ঘ সময় ধরে দেশটিতে সগৌরবে টিকে আছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, উত্থান ঘটেনি স্বৈরশাসকের। প্রশ্ন হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন ঘটেনি স্বৈরশাসকের উত্থান, কোন জাদুবলে টিকে আছে গণতন্ত্র? এর এককথায় উত্তর: কারণ গণতন্ত্রই তাদের শেষ গন্তব্য।
বিগত সাড়ে চার দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আসা-যাওয়া বা বসবাসের সুবাদে মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। পক্ষান্তরে দেশের রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্য হয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বরূপও প্রত্যক্ষ করেছি। বাংলাদেশে একজন জনপ্রতিনিধি হয়েও যেকোনো বিষয়ে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো দলের প্রতিনিধি হয়ে সেই দলের বিপক্ষে কথা বলা তো মহা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এ জন্য দলীয় পদ-পদবি হারানোসহ মানসিক হয়রানি, জেল-জুলুম এমনকি শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হতে হয়। বিরোধী দলের কোনো নেতাকর্মী সরকার বা সরকারি দলের কোনো কর্মকাণ্ডের যৌক্তিক সমালোচনা করলেও তার ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্্গ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মিডিয়াও সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে ভয় পায় গণতন্ত্র নামধারী স্বৈরাচার সরকারের চোখ রাঙানিতে। আর সাধারণ কোনো মানুষ যদি সরকার বা সরকারি দলের যেকোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করে, তাহলে তার রেহাই নেই।
বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রায় অবাধ। গত ৩৫ বছর ধরে পত্রিকা প্রকাশের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখানে সাংবাদিক, লেখকেরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তিরও কঠোর সমালোচনা করতে পারেন নির্ভয়ে। এর জন্য তাদের ভয়ভীতি, মামলা বা কারাদণ্ডের শিকার হতে হয় না। শুধু স্থানীয় নাগরিকই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীরাও মার্কিন সরকার কিংবা প্রশাসনের সমালোচনা করতে পারেন সম্পূর্ণ নিঃশঙ্কচিত্তে। এমন বিরুদ্ধ মতপ্রকাশের জন্য তাদের কখনো শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার নজির নেই।
পাঠকদের জন্য এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দুটি করে চারটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ তুলে ধরছি :
২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট নিউইয়র্ক, সান ফ্রান্সিসকো, লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্লিভল্যান্ড ও সিয়াটলের রাস্তার মোড়ে এক রাতের মধ্যে হাজির হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিন্ন পাঁচটি নগ্ন মূর্তি। সকাল হতেই পথচারীদের নজরে আসে এই বিতর্কিত শিল্পকর্ম, যা দ্রুত আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়।
প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, INDECLINE নামের একটি অ্যানার্কিস্ট সংগঠন (অরাজনৈতিক) এই প্রতিবাদের আয়োজন করে। তারা এই প্রকল্পের নাম দেয় ‘The Emperor Has No Balls’ (বাংলায় অর্থ : ‘সম্রাটের কোনো বল নেই’)।
এই ব্যঙ্গাত্মক শিল্পকর্মটি করা হয়েছে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের বিখ্যাত রূপকথা ‘The Emperor's New Clothes’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। সেই গল্পে এক আত্মকেন্দ্রিক সম্রাট প্রতারিত হয়ে নগ্ন অবস্থায় জনতার সামনে হাঁটে, অথচ কেউ তার নগ্নতা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে সাহস করে না। কেউ কেউ এই স্টান্টের তুলনা করেছেন জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘Mr. Robot’-এর বিদ্রোহী গ্রুপ ‘fsociety’-এর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, যারা একসময় নিউইয়র্কের আইকনিক ওয়াল স্ট্রিট বুলের অণ্ডকোষ সরিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ করেছিল।
INDECLINE-এর এক মুখপাত্র ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান, ‘পছন্দ করুন বা না করুন, ট্রাম্প এখন বিশ্ব সংস্কৃতির এক বিশাল অংশ। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের স্মরণ করা হতো মূর্তির মাধ্যমে। আমরাও সেটাই করেছি, তবে আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে।’ এই বিতর্কিত মূর্তিগুলোর নির্মাতা হলেন Ginger, যিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের একজন শিল্পী। তিনি মূলত ভৌতিক বাড়ি ও হরর সিনেমার সেট ডিজাইন তৈরি করার জন্য পরিচিত। INDECLINE তাকে নিয়োগ দেয় এই ভাস্কর্যগুলো তৈরির জন্য। নিউইয়র্কের ইউনিয়ন স্কয়ারে মূর্তিগুলোর একটিকে ঘিরে ভিড় জমে যায়। তবে এই প্রতিবাদের জন্য INDECLINE সংগঠন, মূর্তি নির্মাতা এরহমবৎ বা সংশ্লিষ্ট কোনো শিল্পীকে কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।

অন্যদিকে গত বছর জনপ্রিয় নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনের নতুন ‘হেলথ ইস্যু’র প্রচ্ছদ বিপুল সমালোচনার জন্ম দেয়। কারণ, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সেখানে অন্তর্বাস পরা অবস্থায় দেখানো হয়। অনেকে এটিকে ‘অশোভন ও অনৈতিক’ বলে সমালোচনা করেন।
২০২৪ সালের ১৫-২৮ জুলাই সংখ্যার এই প্রচ্ছদ চিত্রিত করেন শিল্পী মার্টিন স্কোলার। ছবিতে বাইডেন ও ট্রাম্পকে চিকিৎসা পরীক্ষার মতো একজোড়া স্কেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এটি মূলত ছবি সম্পাদনার (ডক্টরড ইমেজ) মাধ্যমে তৈরি করা হয় এবং সূত্র অনুযায়ী- ট্রাম্পের ছবি তোলেন সেথ ওয়েনিগ এবং বাইডেনের ছবি তোলেন ম্যানডেল এনগান। নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনের নির্বাহী সম্পাদক জেনেভিভ স্মিথ প্রচ্ছদটি নিয়ে ব্যাখ্যা দেন- আমরা আগেই ভেবেছিলাম, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারের মাঝে যখন এই হেলথ ইস্যু প্রকাশিত হবে, তখন কীভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করা যায়। প্রেসিডেন্ট বিতর্কে প্রার্থীদের স্বাস্থ্য ও বয়স জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে, আর আমরা সেই বিষয়টিই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। তবে এই প্রচ্ছদ রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এতে শিল্পী মার্টিন স্কোলার, ম্যাগাজিনের সম্পাদক বা ফটোগ্রাফারদের কোনো শাস্তি পেতে হয়নি।
এই দুটি উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা শক্তিশালী। এখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের ব্যঙ্গ করা হলেও শিল্পী, সাংবাদিক বা সম্পাদকদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি।
এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, আমাদের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে শুধু একটি প্রতিবাদমূলক কার্টুন ফেসবুকে শেয়ার করার অপরাধে লেখক মুশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন এবং পরে কারাগারেই তার মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে কার্টুন আঁকার অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। গ্রেপ্তারের পর তিনি চরম নির্যাতনের শিকার হন এবং দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকেন। মুক্তি পেলেও গুরুতর শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন।
উপরের বর্ণিত চারটি ঘটনা থেকে কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আমাদের প্রিয় জন্মমাটি, যেখানে আমাদের নাড়িপোঁতা, সেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে মানুষ কতটা গণতন্ত্র উপভোগ করছে। আর কতিপয় রাজনীতিকদের নাক ছিটকানো দেশ আমেরিকা, যেখানে আমরা ৬-৭ লক্ষাধিক অভিবাসী হয়েও জন্মভূমির চেয়ে বেশি মর্যাদা-সম্মান নিয়ে বসবাস করছি।
বিগত দিনে বাংলাদেশে এমন অগণিত ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, যা ছিল বীভৎস, নির্মম, নিষ্ঠুর। অন্যায়ভাবে হত্যা, গুম, খুন, রাহাজানি, লুটপাট, দখল-এসব অপরাধ যেন স্বাভাবিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এসব অপরাধের মূলে রয়েছেন রাজনীতিবিদরা- হয় সরাসরি, নয়তো তাদের নির্দেশেই এসব সংঘটিত হয়েছে।

আমার জানামতে, আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের বহু প্রবাসী সাংবাদিক, সম্পাদক, লেখক দেশের শাসকগোষ্ঠীর ভয়ে সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকতেন। আর যারা নির্ভয়ে মানুষের কথা বলেছেন, তাদের অনেক সময় চড়া মূল্য দিতে হয়েছে-যেন কড়াই থেকে আগুনে পড়ার মতো অবস্থা।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করছি। দ্বিতীয় মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুই নেতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে উঠে আসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। এ সময় মোদি ও ট্রাম্প একে অপরকে আলিঙ্গন করেন ও করমর্দন করেন। এরপর গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করেন। এমনই এক প্রশ্নে উঠে আসে বাংলাদেশ ইস্যু। ভারতীয় এক সাংবাদিক ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশের বিষয়ে আপনার অভিমত কী? কারণ এটা স্পষ্ট যে বাইডেন প্রশাসনের আমলে মার্কিন ডিপ স্টেট বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এমনকি মুহাম্মদ ইউনূসও জুনিয়র সরোসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বাংলাদেশের বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
যদিও ট্রাম্প সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের ভূমিকা অস্বীকার করে বলেন, আমাদের ডিপ স্টেটের কোনো ভূমিকা ছিল না।
তবে ট্রাম্পের স্থলে আমি হলে দৃঢ়তার সঙ্গে বলতাম, হ্যাঁ, করেছি! কারণ যে দেশে আইনের শাসন নেই, মানবাধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই, রাজনীতিতে সমমর্যাদা নেই, যেখানে পুরো দেশটাই লুটতন্ত্রে পরিণত হয়েছে-সেই দেশকে দেখভাল করা আমাদের দায়িত্ব। কারণ আমরা সেই দেশটির অন্যতম প্রধান সাহায্যকারী রাষ্ট্র।
এই সফরে টেক্সাসের হিউস্টনে ভারতীয় প্রবাসীদের আয়োজিত এক বিশাল সংবর্ধনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘ বক্তব্য দেন। বিশেষভাবে নরেন্দ্র মোদি তার বক্তব্যে গর্বের সঙ্গে বলেন, আমরা দুই দেশ-ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র-পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা বিশ্বকে আরও উন্নত, নিরাপদ ও স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে।
আমার যদি সুযোগ থাকত, তাহলে ভারতের সাংবাদিকের মতো বাংলাদেশের পক্ষে আমি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রশ্ন করতাম, গণতান্ত্রিক ভারত কেন গত ১৭ বছরে প্রতিবেশী বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিল? ভারত কি গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে একনায়কতন্ত্রকে মদদ দিয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে মোদির কী বলার থাকত, সেটাই ছিল দেখার বিষয়!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ‘প্রেসিডেন্সিয়াল’ পদ্ধতির। সোয়া দুইশ বছরের অধিককাল আগে আমেরিকার ‘ফাউন্ডিং ফাদাররা’ তাদের সংবিধানে ‘জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্যে’র যে বিধান রেখে গেছেন, তা আজও অটুট আছে এবং বেশ ভালো ও কার্যকরভাবেই কাজ করেছে। আইনসভায় আছে দুটি কক্ষ-প্রতিনিধি পরিষদ বা ‘হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ’ এবং ‘সিনেট’। এই দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনকে বলে কংগ্রেস। মার্কিন সংবিধান প্রেসিডেন্টকে অনেক নির্বাহী ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু একচেটিয়া ক্ষমতা দেয়নি। যেমন আইন তৈরি, বাজেট পাস, যুদ্ধ ঘোষণা এবং শাসনতান্ত্রিক পদে পদায়নের ব্যাপারে কংগ্রেসের এক বা উভয় কক্ষের অনুমোদন ছাড়া প্রেসিডেন্ট এসব কাজ করতে পারেন না। আবার প্রেসিডেন্টের অনুমোদন ছাড়া কংগ্রেস নিছক সাধারণ সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে পাস করা কোনো বিল আইনে পরিণত করতে পারে না এবং তার পক্ষে কোনো বাজেট প্রস্তাবও পাস করা সম্ভব হয় না। এসব বিষয়ে প্রেসিডেন্টের ভেটো পাওয়ার আছে। তবে কোনো বিল বা বাজেটে যদি আইনসভার নিম্নকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন থাকে, তবে প্রেসিডেন্টের ভেটো আপনাআপনিই খারিজ হয়ে যায়। এর ফলে প্রতিটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একদিকে প্রেসিডেন্ট কংগ্রেস, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দুই দলের মধ্যে চলে অনবরত দর-কষাকষি। কেউ কারও ওপর গায়ের জোরে একচেটিয়াভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। দিন শেষে বিবদমান দুই দলকেই জাতীয় স্বার্থে বাগাড়ম্বর ছেড়ে আপসের পথে আসতে হয়। এর একটাই কারণ-আমেরিকায় গণতন্ত্র চর্চিত হয় ব্যক্তির ইচ্ছায় নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায়। এ কারণেই আমেরিকা সগর্বে প্রত্যয় নিয়েই বলে- এই পৃথিবীকে দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের। এটাই আমেরিকা, এটাই আমেরিকার গণতন্ত্রের বিশেষত্ব ও সৌন্দর্য। এটাই গণতন্ত্রের সফলতা।
মার্কিন গণতন্ত্রের এই সুবাতাসের ছোঁয়া বাংলাদেশের মানুষের গায়ে কখনো লাগেনি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের শাসন ছিল মূলত গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরাচারী শাসন। ওই সময়টায় এ দেশের আপামর জনতা গণতন্ত্রের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তবে জনগণের মনে গণতন্ত্রের আশা জেগেছিল ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের পরে। ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র নিশ্চিতকরণে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করলেও সংসদ কার্যকর, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং আইনের প্রকৃত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই দলীয় সকল কাজকেই নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছে সঠিক বলে বিবেচিত হওয়ার অযৌক্তিক নীতি থেকে বের হয়ে ভালো কাজে বাহবা ও মন্দ কাজের সমালোচনার সংস্কৃতি গড়ে না উঠলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া সুকঠিন।
অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী পদটি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। দেশের সব প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক ব্যক্তি কার্যত প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুল। প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা কার্যত নির্বাহী, বিচার ও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এতে ইচ্ছা করলেই প্রধানমন্ত্রী যা খুশি তা করতে পারেন। এর ফলে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কাঠামো স্বৈরতান্ত্রিক রূপ ধারণ করেছে। তাই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার পরিধি নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি ক্ষমতার একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যার নিয়োগ হবে জনগণের দ্বারা এবং যার পেছনে জনগণের সমর্থন থাকবে। রাষ্ট্রপতির কোনো কাজেই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সুযোগ রাখা যাবে না। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো বাংলাদেশেও একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারার বিধান করতে হবে। এতে প্রধানমন্ত্রীর পদকে নিজ সম্পত্তি বানিয়ে তোলার আগেই অন্য প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, যা স্বৈরতন্ত্রের পথকে কিছুটা হলেও রোধ করবে।
সামরিক শাসন আর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আশির দশকজুড়ে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার লড়াই এবং নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসের অংশ। তেমনি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল চব্বিশের বীরত্বপূর্ণ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। এবারের জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, বিশেষ করে তারুণ্যের জাগরণ যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল, তা বাংলাদেশের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ভিন্নতর। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার গতানুগতিক সরকার নয়, দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সিংহভাগ মানুষের সমর্থনে গঠিত। তাই দলমত-নির্বিশেষে সবার উচিত এ সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করা, কারণ এই সরকার ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ আবার সংকটে পড়বে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে ছয় মাস পার করেছে। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এরই মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির কাছে পাঠানো হবে। এরপর রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তির সঙ্গে আলোচনা এবং সমঝোতাক্রমে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক ফেব্রুয়ারিতেই হবে। সরকারের পক্ষ থেকে চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও আভাস দেওয়া হয়েছে। দেশে ধীরে ধীরে নির্বাচনের পরিবেশও সৃষ্টি হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শেষে দ্রুতই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ বাংলাদেশের ‘নির্বাচন-পাগল’ মানুষ দীর্ঘ দেড় দশক ধরে একটি উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। তবে ত্রয়োদশ নির্বাচনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যে দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হবে, তাকে অতীতের সব গ্লানি মুছে দিয়ে ছাত্র-জনতার কাক্সিক্ষত নতুন বাংলাদেশ উপহার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত। যে দলই সরকার গঠন করবে, সেই দলের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
মার্কিন গণতন্ত্রের ন্যূনতম ছোঁয়াও যদি বাংলাদেশে লাগে, তাহলে এই দেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। এর পথ ধরে একটা সময়ে এসে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হবেই। দেশের বর্তমান প্রজন্মের অদম্য তারুণ্যশক্তির মাধ্যমেই এটা সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার কষ্টার্জিত ফল বিফলে যাবে। তাই ভবিষ্যতে যাদের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের এখন থেকেই সতর্ক পন্থা অবলম্বন করা উচিত, যাতে দেশে আর কখনো স্বৈরাচারী সরকারের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
শত প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে প্রবাসীসহ সবার ভালোবাসা, সমর্থন ও সহযোগিতায় আসন্ন একুশে ফেব্রুয়ারি ৩৫ পেরিয়ে ৩৬ বছরে পদার্পণ করছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রিয় মুখপত্র ‘ঠিকানা’। জন্মদিনে পত্রিকাটির পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট, শুভানুধ্যায়ীসহ সবাইকে নিরন্তর শুভেচ্ছা।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, ঠিকানা এবং সাবেক সংসদ সদস্য।