দেখতে দেখতে আমাদের মাঝ থেকে পবিত্র মাহে রমজানের রহমত ও মাগফিরাতের দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে প্রবেশ করছি নাজাতের দশকে। রমজানকে বিদায় দিতে গিয়ে হজরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমনটি হয়ে থাকত যে আধ্যাত্মিক বসন্ত নিজের চমক দেখিয়ে যখন বিদায় নেওয়ার ক্ষণে পৌঁছে যেত, তখন তিনি (সা.) কোমর বেঁধে নিতেন আর রমজানের কল্যাণরাজিতে নিজ ডালি ভরে নিতে কোনো ত্রুটি করতেন না। হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর শেষ দশকের ইবাদত সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, রমজানের শেষ দশকে প্রবেশ করলে তিনি (সা.) কোমর বেঁধে নিতেন অর্থাৎ খুবই তৎপর হতেন এবং নিজ রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে জীবিত করতেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর (সা.) পরিবার-পরিজনকেও জাগাতেন (বুখারি, কিতাবুস সওম)।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন : ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালামকে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা বা ফজর পর্যন্ত।’ (আল কোরআন)
হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল করিম (সা.) এরশাদ করেন, যদি কেউ ইমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে, তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারি)
শেষ দশকে মহানবী (সা.) লাইলাতুল কদরের অন্বেষণে রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে জাগিয়ে রাখতেন। রমজানের এই শেষ দশকের একটি রাতে এসে থাকে লাইলাতুল কদর। পবিত্র কোরআন-হাদিসে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে উল্লেখ আছে। লাইলাতুল কদর বা সৌভাগ্য রজনী লাভ বোধ করি মুমিনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সারা জীবন কঠোর সাধনা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে শয়তানি প্রবৃত্তিরূপে দৈত্যকে নিধন করার পর মুমিনের কাছে আসে সেই মুহূর্তটি-সেই পাওয়ার মুহূর্তটি, যা আল কোরআনের সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে। হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এ মুহূর্তটি। হাজার মাস অর্থাৎ প্রায় ৮০ বছর। একজন মুমিন সাধারণত ৮০ বছর বেঁচে থাকেন। সুতরাং তার সারা জীবনের সাধনার ফল লাভের মুহূর্তটি তার গোটা জীবনের চেয়েও কদরের তথা কল্যাণের ও মর্যাদার।
লাইলাতুল কদর বলতে আমরা সাধারণত একটি রাতকে মনে করে থাকি। ভৌগোলিক কারণে সারা দুনিয়ায় যেহেতু একই সময়ে রাত থাকে না, সে জন্য লাইলাতুল কদরকে আমাদের গণনার একটি রাত নির্ধারণ করা সঠিক বলে মনে হয় না। লাইলাতুল কদর এমন একটি সময় মুমিনের ব্যক্তিগত জীবন বা জাতীয় তথা মিল্লাতি জীবনে রাতের ন্যায় কাজ করে থাকে।
মুমিন সাধনার শেষ লগ্নে তার প্রভুর দিদার বা দর্শন ও সান্নিধ্য লাভ করে বাক্যালাপে ভূষিত হয়। এ মুহূর্তটিই আসলে তার জীবনে লাইলাতুল কদর। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ মুহূর্তটি অবশ্যই মুমিনের জীবনে আসে রমজানের কঠোর সাধনার শেষ দশকে। রোজার সাধনার মাধ্যমে মুমিন পানাহার ত্যাগ করে, নিদ্রাকে কম করে দিয়ে এবং নিজের প্রজননকে সাময়িকভাবে হলেও স্বীকার করে আল্লাহর রঙে রঙিন হয়। তাই সে আল্লাহর সঙ্গে নিজ নিজ সামর্থ্যানুযায়ী বাক্যালাপ করার সৌভাগ্য লাভ করে।
হাদিস পাঠে জানা যায়, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল করিম (সা.) কদরের রাত্রি সম্বন্ধে বলেছেন, ‘রমজান মাসের শেষের দশ রাত্রিসমূহে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান করো।’ (বুখারি) লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। অনেকেই মনে করেন, ২৭ রমজানই লাইলাতুল কদরের রাত। আসলে এ ধারণাটি সঠিক নয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো বলেন নি, ২৭ রমজানের রাত কদরের রাত। তবে ২১ রমজান থেকে নিয়ে ২৯ রমজন পর্যন্ত বিজোড় যেকোনো রাতই শবে কদর হতে পারে। লাইলাতুল কদরের তারিখের ব্যাপারে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব, তোমরা শেষ দশ রাতের বিজোড় রাতসমূহে তা খোঁজ করবে। (বুখারি) অপর এক হাদিসে উল্লেখ আছে, একদা হজরত উবায়দা (রা.) নবী করিম (সা.) কে লাইলাতুল কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তখন নবীজি (সা.) সেই সাহাবিকে বললেন, রমজানের শেষের দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোকে তালাশ করো। (বুখারি)
হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘তোমাদের কাছে রমজান এসেছে। রমজান মোবারক মাস। এর রোজা আল্লাহ তোমাদের প্রতি ফরজ করেছেন। এ মাসে বেহেশতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করা হয়েছে আর দোজখের দ্বারসমূহ বন্ধ করা হয়েছে এবং দুষ্কৃতকারী শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়েছে। এ মাসের একটি রাত্রি, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত, সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।’ (বুখারি)
হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত আয়েশা (রা.) নবী করিম (সা.)-এর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আমি লাইলাতুল কদর লাভ করলে কী করব? হজরত নবী করিম (সা.) তাঁকে নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করতে বললেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! নিশ্চয় তুমি মার্জনাকারী। মার্জনাকে তুমি ভালোবাসো। অতএব, তুমি আমাকে মার্জনা করো (তিরমিজি)।
মাহে রমজানের শেষ দশকে আমাদের ইবাদতে আনতে হবে বিশেষ পরিবর্তন। রাতগুলোকে ইবাদতে রত থেকে অতিবাহিত করতে হবে। আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেল কিন্তু ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটাতে পারল না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই। কদরের রাতের ইবাদতের সুযোগ যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায়, সে জন্য হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ ১০ দিনের পুরো সময়টাতে ইতিকাফরত থাকতেন। (মুসলিম)
আমাদের উচিত হবে, শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোকে ইবাদতে জাগ্রত রাখা, যেন আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে লাইলাতুল কদর লাভের সৌভাগ্য দান করেন।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এ দোয়াই করি, তিনি যেন এই পবিত্র রমজানে রোজাদারদের রোজা কবুল করে নেন আর আমাদেরকে নাজাত দান করে তাঁর রহমতের ছায়ায় জড়িয়ে নেন, আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট



মাহমুদ আহমদ


