গত ৮ মার্চ ছিল বিশ্ব নারী দিবস। সকল নারী ও মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই, সমাজে নারীবৈষম্য দূর করতে সবার আগে প্রয়োজন সমাজের নৈতিক অবক্ষয় দূর করা। সমাজ, সংসার, ধর্ম সকল ক্ষেত্রেই আজ সীমাহীন অবক্ষয়। বলা যায়, পচন ধরেছে। সঠিক চিকিৎসা ছাড়া ওপর দিয়ে শুধু মলম লাগিয়ে কোনো কাজ হবে না। নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে পুরুষদের কাছে শুধু অভিযোগ জানিয়ে বা প্রতিবাদ করলেও হবে না। পুরুষদেরকে এগিয়ে আসতে হবে নারীদের সঙ্গে। কারণ সমাজটা তো পুরুষতান্ত্রিকই, অস্বীকার করার উপায় আছে কি?
একটি সুন্দর সমাজ তথা দেশ গড়তে হলে প্রতিটি পরিবারে একজন সুশিক্ষিত নারী তথা মায়ের প্রয়োজন। সুশিক্ষিত বলতে, আমি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলছি না। স্বশিক্ষিত হতে হবে, যা সে তার মা-বাবা অর্থাৎ পরিবার থেকে অর্জন করে। যে শিক্ষা একজন মানুষকে উন্নত চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। যে শিক্ষা একটি পরিবারে মেয়ে ও ছেলে উভয় শিশুই গ্রহণ করে এবং প্রভাবিত হয় আর ধীরে ধীরে উন্নত চরিত্রের মানুষ হয়ে ওঠে। সংসারের নিয়ম, নীতি, সকলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, বিনয়ী ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। এভাবেই একজন পুরুষ নারীদেরকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা করতে শেখে। তাহলে তো নারীদেরকে সমঅধিকার না দেওয়া, অবজ্ঞা করা, সর্বোপরি অত্যাচার করা, হেনস্তা করার প্রশ্নই ওঠে না। তবু সমাজে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। একে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা যাবে না। এর কারণ বহুবিধ এবং অনেক গভীরে প্রোথিত। তবে আজ তো এসব ঘটনা মনে হয় মহামারি আকারে ঘটছে। অথচ আমরা না সভ্য হয়েছি, সভ্যতা আর প্রযুক্তিবিদ্যার উৎকর্ষ সাধনে বহু উপরে অবস্থান করছি? তবে কেন মানবিকতার এই নিম্নগতি?
আমাদেরকে বুঝতে হবে, পৃথিবীর এই এষড়নধষরুধঃরড়হ-এর কারণ পৃথিবী ছোট হয়ে গেছে। ঘরে বসে সকল খবর, দৃশ্যও দেখা যায়। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে সকল জায়গার সভ্যতা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ সবকিছু একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু সত্যি বলতে, সকল দেশের আচার, ব্যবহার, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ইত্যাদি ভিন্ন হয়ে থাকে। আমাদের দেশেরও শত বছরের একটা সংস্কৃতি আছে। হয়তো কোনোটা পুরোনো, তাই নতুনকেও গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বিবেচনায় রাখতে হবে, ভিন্ন দেশের কোনো সংস্কৃতি আমাদের দেশের জন্য কল্যাণকর নয়।
আজ আমার নিজের সময়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার মায়ের কথাও বলতে চাই। আমার মায়ের নাম হাশমত আরা বেগম। তার জন্মতারিখ আমি জানি না। আমার নানার নাম মো. আব্দুল কাদের জোয়ারদার। পেশায় আইনজীবী ছিলেন। শুনেছি, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে ঋরৎংঃ পষধংং পেয়েছিলেন। সময়টা ছিল ব্রিটিশ ভারত শাসনামল। খুবই উচ্চ মানসিকতা ও নির্ভীক মনের মানুষ। তাই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন তদানীন্তন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য। তিনি একজন এমএলএ ছিলেন। মি. নেহরু ও গান্ধীজির সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। স্বদেশি আন্দোলনেও ভূমিকা ছিল। দেশের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের ছেলেমেয়ে, সংসারের দিকে নজর দিতে পারেননি। হ্যাঁ, আমার নানা খুলনা জেলার মধুগ্রাম নিবাসী ছিলেন। সে সময় ভারতের কলকাতা আর খুলনার দূরত্ব খুব কমই ছিল। নানা প্রায়ই নিজ বাড়িতেও থাকতে পারতেন না। এমএলএ হওয়ার কারণে কয়েকবার রাজবন্দীও থেকেছেন।
যাহোক, এসব কারণে আমার আম্মার পড়াশোনাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল গ্রামে থেকে। তাই স্কুলে পড়া অবস্থাতেই মাত্র ১৩ বছর বয়সে আম্মার বিয়ে হয়ে যায়। আম্মাও খুবই মেধাবী ছিলেন। তাই ওই কিশোরী বয়সে লেখাপড়ায় ইতি টানতে খুবই মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। এরপর বিশাল একান্নবর্তী পরিবারে প্রতি দুই বছর অন্তর মোট ১৩টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আমরা মোট নয় বোন, তিন ভাই ছিলাম। এক ভাই জন্মের পরপরই মারা যায়। এত বড় সংসারের কাজ করে প্রতিটি ভাইবোনের শিক্ষার দিকে আম্মার কড়া নজর ছিল। মনে পড়ে, সন্ধ্যাবেলায় আম্মাকে দেখেছি রান্না করছেন আর ছোট বোন বা ভাইকে পড়াচ্ছেন, যে আগামী বছর স্কুলে ভর্তি হবে। আর বড় ভাইবোনকে হুকুম দিয়েছেন, ছোট ভাইবোনদের স্কুলের পড়া তৈরি করে দিতে। তাই ১৯৫৭ সালে আমার বড় বোন ম্যাট্রিক পাস করলে চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসায় আম্মা আব্বাকে বললেন, ‘আমার কোনো মেয়েকে গ্র্যাজুয়েট না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেব না। আমি নিজে পড়াশোনা করতে পারিনি। আমার মেয়েদেরকে তেমন হতে দেব না।’ আমরা তখন সাত বোন। পরে আরও দুই বোন জন্মগ্রহণ করেছে। এই ছিলেন আমার মা। এমন শিক্ষা তিনি নিশ্চয় তার পরিবার হতে অর্জন করেছিলেন। তিনি দেখেছেন, তার আব্বা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়ে কাজ করেছেন। কোনো অন্যায়ের প্রতি মাথা নত করেননি। আমাদের সংসারে অভাব-অনটন তো নিশ্চয় ছিল। কিন্তু আব্বা-আম্মা বুঝতে দিতেন না। আমরা ভাইবোনেরাও কোনো বাড়তি আবদার করতাম না। প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়া সম্ভব হতো না। তবু লেখাপড়া ঠিকই চালিয়ে গিয়েছি। আমরা নয় বোন, প্রত্যেকে কমপক্ষে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছে, এখনো করছে।
গত ৫০ বছরে পৃথিবীতে খুব দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। ‘পরিবার’ সম্পর্কে ধারণা বদলেছে। এখন পরিবার বলতে সংসারে বাবা, মা আর এক বা দুটি সন্তান। আর কেউ নয়। ধর্মীয় প্রভাবও পরিবার থেকে আসে। ধর্ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। নইলে আমাদের মতো দেশে ‘হোলি আর্টিজেনে’ সংঘটিত নৃশংস ঘটনা ঘটতে পারে কি? আক্রমণকারীরা সকলেই শুনেছি উচ্চবিত্ত পরিবারের নামকরা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। যাক, পরিবার বিষয়টি ভালোভাবে বোঝাতে গিয়ে নিজের পরিবার ও বড় হওয়া সম্পর্কে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণাও করে ফেলেছি। আশা করি, পাঠক ক্ষমা করবেন। শুধু দুঃখ হয়, তাই বলি, কোথায় সেই পরিবার, যেখানে একজন আদর্শ মা এবং তার সন্তানেরা বড় হয়ে ওঠে!
শুধু নারী স্বাধীনতার জন্য একটি দিবসের মাধ্যমে সভা-সমিতি করে সেটি সম্ভব কি? মনে হয়, আমাদের চলে যাওয়ার দিন চলে এসেছে, কিন্তু কোন পৃথিবীতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে রেখে যাব? কোনো জবাব পাই না।



ডা. সওকত আরা বীথি


