তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দেওয়ার দাবি অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত হয়েছে। ভারত তিস্তার পানিবণ্টন থেকে সরে গিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা বলছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এতে সায়ও দিয়েছিল। অথচ আগামী এক দশকের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনোই সম্ভাবনা নেই।
পরিকল্পনা অনুযায়ী তিস্তার অববাহিকায় বিশাল জলাধার নির্মাণ করা হবে। বাংলাদেশের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই জলাধার হবে। এই বিপুল পরিমাণ জমির প্রায় সবটাই কৃষিজমি। বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পানিও এই জলাধার থেকে সরবরাহ করা হবে। জানা যায়, এই মহাপ্রকল্পে ভারত তার কর্তৃত্ব আইনসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রকল্পটি ভারতীয় অংশেও সম্প্রসারিত করতে চায়। বাংলাদেশ ও ভারতের জমিতে তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। বাংলাদেশ এর পক্ষে নয়। কারণ বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের কর্মসূচি বাংলাদেশের। বাংলাদেশের শুকনো মৌসুমের চাহিদা মিটিয়ে ভারতকেও পানি দেওয়ার বিপক্ষে নয় বাংলাদেশ। ভারতের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এতে অসম্মতও ছিল না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষও এতে রাজি ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর ভারত এ পরিকল্পনা থেকে হঠাৎই সরে আসে। অথচ বিগত সরকারের সময়েই দুই দেশের সম্মত সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের কোন কোন এলাকা জলাধার নির্মাণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী, শুকনো মৌসুমে দুই দেশের কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন, জলাশয়ের ধারণক্ষমতা নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ের ব্যাপারে সরেজমিন সমীক্ষা করে সুপারিশ রাখবেন দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা। সম্মিলিত পর্যবেক্ষণ, সমীক্ষার বিরোধিতা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তাদের বক্তব্য ছিল বিষয়টি একান্তভাবেই বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপারে। সরেজমিন সমীক্ষার জন্য বাংলাদেশের যথেষ্ট অভিজ্ঞ, দক্ষ প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। ভারতীয় প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া, তাদের এখানে আনার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু ভারতীয় চাপের মুখে বিগত সরকার এতে সম্মত হয়। এ ব্যাপারে লিখিত কোনো চুক্তি বা সমঝোতা না থাকায় অন্তর্বর্তী সরকার তা থেকে সরে এসেছে। তারা যৌথ সমীক্ষারই পক্ষে নয়। এক ভয়ংকর দুরভিসন্ধি থেকেই ভারত অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্ছিতভাবে যৌথ সমীক্ষার দাবি তোলে। এই প্রকল্পে সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকাও ভারত প্রকল্পভুক্ত করতে চায়। তাদের ইঞ্জিনিয়ার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে যৌথ সমীক্ষা চালানোর মাধ্যমে ভারতীয় দাবি প্রতিষ্ঠার কৌশল মেনে নেওয়া হবে। বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা ও বেসরকারি খাতে একাধিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পানি বিশেষজ্ঞরা যৌথ সমীক্ষার ঘোরতর বিরোধিতা করেন। ভারতের প্রতি একান্তভাবে অনুগত, পরম বিশ্বস্ত বিগত সরকার তাদের মতামত উপেক্ষা করে।
তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাড়ে সাত লাখ হেক্টর কমান্ড এরিয়াতেই ২০ লখ মে. টন চাল উৎপাদিত হবে। ভারত সরকার তার গজলডোবায় ব্যারাজ নির্মাণের পর বাংলাদেশের ডালিয়ার বিস্তার প্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে যায়। ১৯৯৫ সালে এই ব্যারাজ নির্মাণের পর বাংলাদেশ প্রান্তে তিস্তার প্রবাহ নেমে আসে ১২০০ থেকে ১৫০০ কিউসেফ। অথচ এর আগে প্রবাহ ছিল ৬ হাজার ৭১০ কিউসেফ। প্রবাহ উদ্বেগজনকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের সেচ কাজ ও কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চরম অনাকাক্সিক্ষত এ অবস্থার অবসানে বাংলাদেশ তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু ভারত নানা কৌশলে এর বিপক্ষে ভূমিকা রাখছে। গত ডিসেম্বরে যৌথনদী কমিশনের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দেয়নি ভারত।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনার ভারতীয় প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ব্যাপারে সরকার চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের স্টাডি বিগত সরকারের সময়েই চীনের বিশেষজ্ঞরা সরেজমিনে পরিচালনা করেন। অধিকতর জরিপ চীনাদের দিয়েই করা হবে। চীন এ প্রকল্পে মোটা অঙ্কের অর্থায়ন করতেও আগ্রহী। জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, কুয়েত ফান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এতে অর্থায়ন করতে আগ্রহী। তাই তিস্তা মহাপরিকল্পনা থেকে ভারতকে সরিয়ে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।