Thikana News
১৮ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

শেরে বাংলা স্মরণে

শেরে বাংলা স্মরণে



 
১৯১৮ সালের সুন্দর একটি দিন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভায় সাধারণ সম্পাদক সাহেব বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখলেন। দিন সাতেক পর ওই একই নেতা সভাপতিত্ব করলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে অন্য একটি সভায়। পরস্পরবিরোধী দুটি প্রকাণ্ড রাজনৈতিক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যুগপৎ দায়িত্ব পালনের এমন অদ্ভুত ও আজব ঘটনা ব্রিটিশ ভারতের ২০০ বছরের ইতিহাসে আর কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি-কিন্তু সম্ভব হয়েছিল একজন খাঁটি বাঙালি খাঁটি মুসলিম রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হকের পক্ষে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই একজন সহজ-সরল জনকল্যাণমুখী রাজনীতিবিদ হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। রাজনীতির মাঠে তিনি মানুষকে হিন্দু-মুসলমান হিসেবে বিভক্ত করতেন না। বরং তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণেই সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে তিনি অচিরেই বিপুলভাবে মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, চিত্তরঞ্জন দাশ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমসাময়িক। কিন্তু রাজনীতির বেলায় তিনি ছিলেন অনেকখানি এগিয়েÑবিশেষ করে মহাত্মা গান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চেয়ে। কারণ ১৮৯৩ সালে গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান ২১ বছরের জন্য এবং জিন্নাহ সাহেব লেখাপড়ার স্বার্থে লন্ডন চলে যান একই বছরে কমপক্ষে ১১ বছরের বিরতিতে।
বৃহত্তর বাংলা প্রেসিডেন্সির (BENGAL PRESIDENCY OF BRITISH INDIA) এক ক্ষুদ্র জেলা বরিশালের তৎকালীন বাকেরগঞ্জ উপজেলার সাটুরিয়া গ্রামের মাতুতালয়ে ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর ফজলুল হকের জন্ম হয়। তার পিতা ছিলেন কাজী মোহাম্মদ ওয়াজেদ এবং মাতার নাম সায়দুননেছা খাতুন। পিতা ওয়াজেদ সাহেব বরিশাল শহরের একজন নামকরা আইনজীবী ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে ‘হক সাহেব’ কোনো বই একবারের বেশি পড়তেন না। বরিশাল জিলা স্কুলে পড়ার সময় প্রতিবছরই তিনি ক্লাসে প্রথম হতেন। তার স্বনামধন্য শিক্ষক অশ্বিনী কুমার দত্তের তত্ত্বাবধানে অঙ্ক, ইংরেজি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সাবজেক্টগুলোতে কেউ তার ধারেকাছেও আসতে পারত না। বিভিন্ন ধরনের স্পোর্টস বা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি ছিলেন সর্বসেরা। অন্যদিকে খাওয়ার সময় তিনি একাই পাঁচ-সাতজনের খাবার খেয়ে ফেলতেন। কথিত আছে, তিনি ঘুষি মেরে নারকেল ভাঙতে পারতেন এবং একটি বড়সড় কাঁঠাল একাই খেয়ে ফেলতেন।
তিনি ১৮৯০ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (বা মেট্রিক) পাস করে কলকাতার স্বনামধন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে FA (তৎকালীন H.S.S) শেষ করার পর প্রথম শ্রেণিতে তিনটি বিষয় নিয়ে অনার্স পাস করেন। সে বিষয় তিনটি ছিল ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও ম্যাথমেটিকস। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এর আগে কোনো ছাত্র একই সাথে এতগুলো বিষয় নিয়ে Honors করার সৌভাগ্য অর্জন করেনি। ১৮৯৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্স করছিলেন। ফাইনাল পরীক্ষার ছয় মাস আগে তার পিতার এক হিন্দু বন্ধু তার সাথে মিলিত হয়ে বলেছিলেন, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্কে সব সময়ই কাঁচা এবং সে কারণে তারা অঙ্কশাস্ত্রকে এড়িয়ে চলে। এ কথায় হক সাহেব অপমানিত বোধ করেন এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে বিশেষ পারমিশন নিয়ে মাত্র ছয় মাসের প্রস্তুতিতে ইংরেজির বদলে অঙ্ক নিয়েই পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে দেখা গেল যে তার ক্লাসের সব হিন্দু-মুসলিম ছাত্রকে ডিঙিয়ে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। পরের বছর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ University Law School থেকে BL বা ‘ব্যাচেলর অব ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় মুসলিম ব্যক্তি, যিনি এমন দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। এ সময়ে তার পিতার মৃত্যু হলে তিনি বছর কয়েকের জন্য বরিশাল শহরে ফিরে আইন ব্যবসায় ব্যস্ত থাকেন। তিনি একসময় শহরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু তার মন পড়ে থাকত তৎকালীন ভারতের সেরা শহর কলকাতায়। অতঃপর কলকাতায় ফিরে শহরের প্রখ্যাত আইনজীবী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ল’ ফার্মে প্রথম মুসলিম শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করেন। এরপর একজন সফল আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে তার সুনাম দ্রুত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি একই সঙ্গে ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসিলম লীগের নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতেন। ১৯১৩ থেকে লীগের সভাপতি হিসেবে কাজ করে ১৯১৬ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ পদে তিনি আসীন ছিলেন ১৯২১ সাল পর্যন্ত। এরই মধ্যে ১৯১৮-১৯ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের পর তুরস্কের ‘অটোম্যান সাম্রাজ্যে’র পতন হলে ভারতের মুসলমানরা ‘খেলাফত’ আন্দোলন শুরু করে। এতে মহাত্মা গান্ধী বিপুলভাবে সমর্থন করলেও তুরস্কের জনগণ ও সেনাবাহিনী ‘মোস্তফা কামাল পাশা’র নেতৃত্বে ‘রাজতন্ত্র’ হটিয়ে ‘প্রজাতন্ত্রের পক্ষে বিদ্রোহ করেন। এ কারণেই তুর্কি ‘রাজতন্ত্র’ রক্ষার জন্য ভারতীয় মুসলমানদের আন্দোলন করার বিপরীতে সে যুগের দুজন প্রখ্যাত বাঙালি রাজনীতিবিদ ‘দেশবন্ধু’ বলে খ্যাত চিত্তরঞ্জন দাস ও ‘শেরে বাংলা’ নামে পরিচিত ফজলুল হক কংগ্রেসে ও মুসলিম লীগ থেকে দূরে সরে আসেন। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা নিয়েও অবাঙালি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষী রাজনীতিবিদদের মতবিরোধ দেখা দেয়। চিত্তরঞ্জন দাশ অচিরেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে তার নিজস্ব ‘স্বরাজ’ পার্টি গঠন করেন এবং ১৯২৩ সালে কলকাতার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। হিন্দু-মুসলিম জনতার কাছে সমানভাবে জনপ্রিয় ‘দেশবন্ধু’ মেয়র থাকা অবস্থাতেই ১৯২৫ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে হঠাৎ করে পরলোকগমন করলে কলকাতা শহরের হিন্দু-মুসলিম এলাকাগুলোতে একই সাথে কান্নার রোল পড়ে যায়। কংগ্রেসে ও মুসলিম লীগের বাঙালিদের ঐক্যবিরোধী নেতারা তখন সুযোগ বুঝে ধর্মীয় ও ভাষার বিরোধকে উসকে দিয়ে কলকাতার রাজনৈতিক মঞ্চে তাদের আধিপত্য বিস্তারের এক মহাসুযোগ পেয়ে যায়। কিন্তু তার বিপক্ষে বাংলার হিন্দু-মুসলিম জনতার আরেক প্রিয় নেতা, খাঁটি মুসলমান হয়েও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভাসিত শেরে বাংলা ফজলুল হক অচিরেই মুসলিম লীগ ত্যাগ করে নিজস্ব ‘কৃষক শ্রমিক-প্রজা পার্টি’ গড়ে তোলেন (১৯২৯) সালে। পরে তার দলের নাম হয় ‘কৃষক প্রজা পার্টি।’
হক সাহেব ১৯৩৫ সালে বাঙালি মুসলমানদের পাশাপাশি মেজরিটি হিন্দুদের ভোট পেয়ে কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন। একই বছর ইংরেজরা ‘১৯৩৫ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ (1935 India Ac) নামে নতুন আইনের মাধ্যমে বিশালকায় ভারতীয় প্রদেশ বা Presidency-গুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন দিতে রাজি হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে অন্য রাজ্যগুলোর মতো বৃহত্তর বাংলাতেও নির্বাচনের বাতাস বইতে শুরু করে। ফজলুল হক তখন বাংলার সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ জনপ্রিয় নেতা হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু ভারতীয় মুসলিম লীগ বাঙালি বলেই তার বিরুদ্ধে মুসলিম ভোটারদের খেপিয়ে তোলে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত তার পক্ষে সবচেয়ে বেশি ভোট দেয়। তিনি কয়েকটি ছোট দলের সাথে সমঝোতা করে অবশেষে প্রথম ভারতীয় হিসেবে বৃহত্তর বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বছরে বহু জনহিতকর আইন পাস করেন। ইংরেজ সরকার কর্তৃক সৃষ্টি করা ‘মধ্যস্বত্বভোগী’ তথাকথিত জমিদারশ্রেণি ট্যাক্স বা খাজনা আদায় করার জন্য ১৭৯৩ সাল থেকেই বাংলার দরিদ্র, দুঃখী, চরমভাবে অবহেলিত কৃষককুলের ওপর যে জঘন্য, অমানবিক অত্যাচার-অবিচার চালিয়ে যাচ্ছিল-বিশেষ করে, ঋণগ্রস্ত সর্বহারা মানুষদের জমিজমা ও ঘরবাড়ি জোর করে দখল করে-তার চির উচ্ছেদে হক সাহেব ছিলেন বদ্ধপরিকর। তিনি সমূলে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করে সারা বাংলায় এগারো হাজার ‘ঋণ সালিসি বোর্ড’ গঠন করে সর্বস্বান্ত মেহনতি কৃষকদের জমিজমা, খাল-ক্ষেত ও ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছেন। ক্ষমতায় থাকাকালে তার অসংখ্য জনকল্যামুখর কর্মতৎপরতার কথা একটি মাত্র নিবন্ধে লিখে শেষ করা যাবে না। তবে একটির কথা না উল্লেখ করলেই নয়। সে যুগে সারা বাংলায় একটি মাত্র বোর্ডের অধীনে মেট্রিক, আইএ (IA), BA ইত্যাদি পরীক্ষা হতো। ছাত্রদের মধ্যে একটি অংশ, সামাজিকভাবে সে যুগে অনেক পিছিয়ে থাকা, মুসলমান ছাত্ররা থাকলেও শিক্ষককুলের মধ্যে মুসলমান শিক্ষক ছিল না বললেই চলে। যেহেতু পরীক্ষার খাতার উপরে নাম লিখলেই কে হিন্দু আর কে মুসলমান তা বোঝা যেত এবং স্বম্ভবত সে কারণেই পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার ক্ষেত্রে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা ছিল অনুপাতে অনেক বেশি, সে কথা চিন্তা করেই ‘হক সাহেব’ খাতার উপরে নাম লেখা নিষিদ্ধ করে শুধু ‘রোল নাম্বার’ লেখার পদ্ধতি চালু করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলিম মেজরিটি কোনো প্রদেশেই সরকার গঠন করতে পারেনি। এমনকি মুসলিম মেজরিটি প্রদেশ বা রাজ্যগুলোতেও নয়। ভারতীয় কংগ্রেস অনেকগুলো রাজ্যে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে শেরে বাংলা ফজলুল হকের তীব্র বিরোধিতার কারণে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রায়ই প্রভুত্ব দেখিয়ে অভ্যস্ত অবাঙালি নেতারা বাংলার সীমান্তে এসে আচমকাই থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে অবস্থায় তিরিশের দশকের প্রারম্ভ থেকেই শুরু হয়ে গেল অবাঙালি নেতাদের ‘ডিভাইভ অ্যান্ড রুল’ পলিসি। আর সে জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল সাধারণ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতি। ভারতবর্ষে ধর্মের নামে যত তাড়াতাড়ি বিভেদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনাখুনি শুরু করা যায়Ñততটা বোধ হয় করা যায় না দুনিয়ার আর কোথাও। কিন্তু অত্যন্ত চতুর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অত্যন্ত সহজ-সরল মনের অধিকারী হক সাহেবকে টেক্কা দিয়ে পূর্ব বাংলাকে তার স্বপ্নের পাকিস্তানের একটি ‘কলোনি’ হিসেবে পেতে নানা রকম চাল চালতে থাকেন। তার সবচেয়ে বড় চালটি ছিল ভারতবর্ষের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের জান-মাল, ইজ্জত, জীবন ইত্যাদির মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতার কথা বা অজুহাত তুলে ধরা। তার মারাত্মক সব যুক্তি শুনে শুনে পূর্ব বাংলার অনেক জুনিয়র মুসলিম নেতাও তার পক্ষে চলে গেলেন। আসলে এসব জুনিয়র বাঙালি ও আধা বাঙালি নেতাদের অনেকেই ‘বাংলার বাঘ’ ফজলুল হকের অভাবিত জনপ্রিয়তায় ভীষণভাবে ঈর্ষান্বিত ছিলেন। বাংলাদেশ যেমন যুগে যুগে অসংখ্য বীর পুরুষ ও বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়-তেমনি জন্ম দিয়েছে বহু মীর জাফর, জগৎ শেঠ ও  মোনায়েম খানদের।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত এদের অবিরত পীড়াপীড়ির পাশাপাশি একশ্রেণির তীব্র সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতাদের কার্যকলাপে বিব্রত ও অসন্তুষ্ট হওয়া ফজলুল হক সাহেব স্বল্পকালীন সময়ের জন্য হলেও মুসলিম লীগে যোগ দিতে রাজি হলেন। এমন সময়ের অপেক্ষাতেই ছিলেন তীব্র কূটবুদ্ধিসম্পন্ন নতুন করে আচকান টুপি পরতে শেখা, ছল-চাতুরীতে ওস্তাদ জিন্নাহ সাহেব। এত দিনে ভারতবর্ষের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে হিন্দু চরমপন্থীদের হাতে মুসলমানরা সত্যি সত্যি ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হতে শুরু করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, ভারতের তৎকালীন ১২টি বৃহৎ প্রদেশ বা রাজ্যের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের পাঁচটি রাজ্যেই মুসলমানরা ছিল এবং এখনো আছে বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে। ভারত দুই ভাগ কেন-একশত ভাগে ভাগ হলেও এ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো দিনই বিলীন হওয়ার নয়। দুটি চিরশত্রু দেশের মধ্যে ‘আণবিক বোমা’ যেমন করে ‘ভারসাম্য’ রক্ষা করে, তেমনি একটি দেশে পরস্পরবিরোধী দুটি সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেও এলাকাভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণেই স্বাভাবিক ভারসাম্য টিকে থাকে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার কারণেই। আসলে ক্ষমতালোভী নেতাদের ফন্দি-ফিকিরের অভাব নেই-তাদের নীতিই হচ্ছে নানা অজুহাতে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ টিকিয়ে রেখে মানুষে মানুষে বিভক্তির সৃষ্টি করে যতটা সম্ভব ফায়দা লোটা। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে?
যাহোক, এসব বর্ণচোরা, তীব্র স্বার্থপর দেশি-বিদেশি শোষক শ্রেণির ছল-চাতুরীর পাল্লায় পড়ে যাওয়া শেরে বাংলাকে দিয়েই জিন্নাহ সাহেব ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ উত্থাপন করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। হক সাহেব তখন ৬৭ বছরের বৃদ্ধ। মুসলিম লীগের সেই সম্মেলনে হক সাহেব উপস্থিত হওয়ার আগেই জিন্নাহ সাহেব বক্তৃতা দিচ্ছিলেন বেশ কিছু সময় ধরে। শেরে বাংলা সেখানে এসে উপস্থিত হতেই ‘ডেলিগেট’ সব দাঁড়িয়ে গিয়ে তাকে চিৎকার করে অভ্যর্থনা জানাতে থাকলে জিন্নাহর কথা কেউ শুনতে পাচ্ছিল না। তখন বাধ্য হয়ে বক্তৃতা থামিয়ে জিন্নাহ সাহেব বলে ওঠেন, ‘বাঘ এলে তো দুম্বাকে (LAMB) জায়গা ছেড়ে দিতেই হয়।’ আমি বলি, তার আসলে বলা উচিত ছিল, ‘বাঘ এলে ধূর্ত শিয়ালকে তো কেটে পড়তেই হয়।’ আসলে ধূর্ত মানুষরা সাময়িকভাবে কেটে পড়লেও সহসাই ফিরে আসে নতুন নতুন ফন্দিফিকির আবিষ্কার করে।
যাহোক, সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাবে পরিষ্কারভাবে লেখা ছিল একাধিক স্বাধীনতা-সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা-ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে। কিন্তু বছর দু-এক না যেতেই ‘TATES’ হয়ে গেল ‘STARE’ জিন্নাহ সাহেব বললেন, IT WAS A TYPING MISTAKE. তখন তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের নেতা বুঝলেন জিন্নাহর চালাকির কাছে তিনি ধরা খেয়ে গেছেন। ধর্মভিত্তিক তীব্র সাম্প্রদায়িকতার মুখে মনুষ্যত্ব-মানবতা সত্যি সত্যি হেরে গেল। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের তথাকথিত ‘পাকিস্তান দিবস’-এর নামে কলকাতা শহরের বাঙালি ভাইরা (হিন্দু মুসলিম) একে অপরকে খুন করলেন হাজারে হাজারে। কই, সেদিন করাচি, লাহোর, দিল্লি, মুম্বাইতে তো কোনো অবাঙালিরা মরল না নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা করে?
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই একজন রাজনীতিবিদ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হক সাহেব, এত চেষ্টা করেও তো আপনি পারলেন না পাকিস্তানের জন্ম ঠেকাতে।’ নেতা উত্তর দিলেন, ‘পাকিস্তান হলো একটি ঘোড়ার ডিম। বছর কয়েক অপেক্ষা করো।’ সবশেষে ৮১ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে হক সাহেব নির্বাচনের মাধ্যমেই মুসলিম লীগের কবর রচনা করে গেছেন পূর্ব বাংলার মাটিতেই।
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা নগরীতে এই ক্ষণজন্মা, মহান বাঙালি নেতা, বিংশ শতাব্দীতে নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বপ্ন দেখা ফজলুল হক সাহেব পরলোকগমন করেন। তার জানাজায় তৎকালীন দেড় লাখ মানুষের ঢাকা শহরে কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন।
 

কমেন্ট বক্স