ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে জামায়াত-বিএনপি এবং তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেতৃত্বাধীন কর্মী-সমর্থক ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে উৎখাত করেছিল। অভাবনীয় ও অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে তারাই এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে আত্মকলহে লিপ্ত। তাদের ভাষায়ই তারা দেশে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা থেকে উত্তরণ অতি জরুরি হলেও তারা পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তারা সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠানের জরুরি তাগিদও বোধ করছে। তাতেও ফল আসছে না। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগহীনতাও উদ্বেগজনক।
আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিতাড়িত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ। তাদের সহযোগী ১৪ দলীয় জোটও লাপাত্তা। ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনীতির মাঠে ছড়ি ঘোরাচ্ছে বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি ইসলামি দল, বামধারার কয়েকটি দল এবং নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আওয়ামী লীগকে উৎখাতে এসব দল একসঙ্গে আন্দোলনে নামলেও বর্তমানে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলছে।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে অত্যন্ত তাৎপর্যময় কিছু ঘটনা ঘটেছে। যার অন্যতম হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ পরিকল্পনা। কারো মতে, ড. ইউনূসকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছে, তাদের বিশেষ উদ্দেশ্য ও স্বার্থ চরিতার্থ করতে তাদেরই সৃষ্ট পরিকল্পিত নাটক। ড. ইউনূসের পদত্যাগ পরিকল্পনা যে ক্ষমতাসীনদের নিজেদের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ বিরোধেরই বহিঃপ্রকাশ, তা উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্যেই প্রতিভাত হয়। প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ প্রসঙ্গে সৈয়দা রিজওয়ানার খোলামেলা মন্তব্য, কেউ দায়িত্ব পালন করতে না পারলে তার সেই দায়িত্বে থাকা প্রাসঙ্গিক নয়।
ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে এনেছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। বিশ্লেষকদের মতে, বিষয়টি এমন নয় যে শিক্ষার্থীরা আবেদন-নিবেদন করলেন আর ড. ইউনূস দেশ রক্ষায় তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। আগে থেকেই গভীর বোঝাপড়া ও সুপরিকল্পিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ড. ইউনূসকে বেছে নেওয়া হয় এবং তিনিও তাতে এগিয়ে আসেন। পেছনে ছিল ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক মহাশক্তি। তবে অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক শক্তির অব্যাহত বৈরী ভূমিকা ইউনূস সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভূত হচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাষ্ট্রক্ষমতায় সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন সেনাবাহিনী প্রধান। ক্ষমতায় বসার পর দেশের রাজনৈতিক-আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্যসহ সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনকই ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়।
এ অবস্থায় বৈষম্যবিরোধীদের প্রধান নেতা নাহিদ ইসলাম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশবাসীকে জানান, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগের কথা ভাবছেন। অন্যদিকে সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, মাহফুজুর রহমান ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সরকার থেকে সরে যাওয়ার কথা জোরালোভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই উপদেষ্টারা জাতীয় বা স্থানীয় কোনো মহলে তেমন একটা পরিচিত নন। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটার প্রেক্ষাপটে তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ, অপসারণ দাবি জোরালো হয়ে আসে।
এদিকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অটল। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেও নির্বাচনের দাবি উঠেছে। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধীদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টি বিএনপির মতো দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে নয়। তারা নির্বাচন যতটা সম্ভব বিলম্বিত করতে চায়। তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার কেবল নির্বাচন দেওয়ার জন্য আসেনি, তাদেরকে জুলাই ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য সকল বাধা উপেক্ষা করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ বা অপসারণও চায় না তারা। জামায়াতে ইসলামী কিছুটা সময় নিয়ে হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। তারা মনে করে, নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ দিলে সব সংশয় সমস্যার সমাধান হবে। একই সঙ্গে তারা বিগত সরকারের বিচার ও সংস্কারকাজ সম্পাদনেরও সুস্পষ্ট রোডম্যাপ চায়।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নানা গুজব, বিভিন্নমুখী কথাবার্তা, প্রচার-প্রচারণার অবসান ঘটাতে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সাথে আলোচনায় মিলিত হয়। তিন বাহিনীর প্রধানেরাও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দেশবাসীকে গুজবে কান না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে গুজবের ডালপালা প্রসারিত না হলেও গুজব পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। অবাধ, সুষ্ঠু, সবার অংশগ্রহণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে বলেও অনেকে মনে করতে পারছেন না। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দেবে। ক্ষমতার দ্বান্দ্বিক এই বিরোধ সামনে বড় রকমের সংঘাতও ডেকে আনতে পারে।