Thikana News
১৭ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

শৈশবে স্নেহশীল, কৈশোরে কঠোর শাসক পিতা

শৈশবে স্নেহশীল, কৈশোরে কঠোর শাসক পিতা



 
আব্বা, আমি যেখানেই যাই, চাঁদটা কেন আমার সাথে সাথে যায়?
-কারণ তুমি জ্যোৎস্না।
আমার দুটো নামই আব্বা রেখেছেন। যদিও আমাকে ডাকতেন ‘জুছু-আম্মু’ বলে। ছোটবেলার স্নেহশীল বাবাকে টিনএজ বয়সে পড়তেই আমি কড়া শাসক হয়ে যেতে দেখি। নিজেকে তখন মোগল বন্দী রাজকুমারী ‘জেবুন্নেসা’ বলে মনে হতো।
একদম ছোটবেলায় প্রতিদিন বিকেলে আব্বা অফিস থেকে বাসায় এলে আমি তাঁর সাথে শহরে ঘুরতে যেতাম। একদিন বেশ ঝড় হলো, আব্বা আর বাড়ি আসেন না। অনেকক্ষণ পর বেশ কিছু লোক আব্বাকে নিয়ে বাসায় এল, তাঁর হাতে ব্যান্ডেজ, অ‍্যাকসিডেন্ট করে হাত ভেঙে গেছে। আমার আব্বা ছিলেন শৌখিন এবং আধুনিক। তাঁর জন্ম বরিশাল হলেও বড় হওয়া এবং লেখাপড়া করেছেন খুলনায়। ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গেলে দাদা মই দিয়ে আব্বাকে নারিকেল গাছে উঠিয়ে দিতেন, নিচে ছড়িয়ে দিতেন খড়ের গাদা। তারপর মই সরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘এবার নেমে আয়।’ আর তখন নামতে গিয়ে আব্বা গাছ থেকে পড়ে যেতেন।

শিক্ষা বোর্ডের অফিসার হওয়ার সুবাদে বরিশাল এলাকার অনেক মাস্টার-প্রফেসর আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। পরীক্ষার সিজন হলে তো ছাত্ররা এবং তাদের বাবা-মায়েরাও আসতেন। তাঁদের ধারণা, শিক্ষা বোর্ডে চাকরি করলে বোধ হয় পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিতে পারে। এ সময় বিকেলবেলা আমরা আব্বার পিয়নের চাকরি করতাম। কেউ কলিংবেল বাজালেই আমাদের বলতে হতো, কে, কোথা থেকে এসেছেন। তারপর ঘরে গিয়ে আব্বাকে বলতাম! পরীক্ষার জন্য তদবির করতে এসেছে এমন লোকদের আমাদের মিথ্যা বলতে হতো যে আব্বা বাসায় নেই। তারা আবার খালি হাতে আসত না; যার এলাকার যা বিখ্যাত মিষ্টি, ফলমূল, মাছ, হরিণের মাংস, মধু এসব নিয়ে আসত! এবং আব্বা বাসায় নেই বলার পরও এগুলো জোর করে দিয়ে যেত। তখন আব্বা বের হয়ে এসে তাদের ওপর বেশ রাগ করতেন। বলতেন, ‘এসব কেন এনেছ? বাড়ি চলে যাও, আর এখন থেকে ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করো, তাহলে পরবর্তী বছর ভালোভাবে পাস করে যাবে।’ আমরা তখন বুঝতাম না, যারা আমাদের জন্য এত মজার খাবার নিয়ে আসে, আব্বা কেন তাদের সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করেন।

আব্বার ক্লোজ বন্ধু, কাউখালী কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বোর্ডের কাজে যশোরে এলে আব্বা তার ভাঙা হাত নিয়ে তার সাথে সিনেমা দেখতে যান! আমরা তখন আরও দুটি ছোট ভাইবোন থাকায় আব্বা-আম্মা আলাদা করে বাসার পাশে মণিহার, নিরালা সিনেমা হলে যেতেন। মনে আছে,     সুচিত্রা-উত্তম সেনের ছবি দেখতে তারা একসাথে ক্যান্টনমেন্ট সিনেমা হলে যেতেন... তখন আমরাও সাথে যেতাম। আমার জ্ঞান হতেই আমাদের বাড়িতে ফুলগাছ দেখেছি... ছোটবেলায় আমরা কানে ফুল গুঁজে পরি পরি খেলতাম! আর বড় হয়ে আমি রোজ ফুলগাছ কিনতাম। হোস্টেল থেকে ফিরে এসে দেখতাম, গোলাপ-বেলি গাছগুলো ফুলে ভরে আছে... আব্বা গাছগুলোর যত্ন নিতেন।
বেশ ছোটবেলায় একবার আব্বার অফিস থেকে সুন্দরবনে পিকনিকে যাওয়ার আগের দিন আব্বা শ‍্যাম্পু কিনে আনলেন, যাতে চুলে শ্যাম্পু করে যাই। সব সময় ঈদে আমার দুটো জামা কেনা লাগতই। একবার দোকানে এক চুড়ি দেখে বাসায় এসে সেটার জন‍্য মন খারাপ করি। আব্বা বললেন, কাল এনে দেবেন! আমি তখন কান্না শুরু করে দিয়ে বলি, কাল ওগুলো বিক্রি হয়ে যাবে। আব্বা তখন রাতেই মার্কেটে গিয়ে সেই চুড়ি কিনে আনলেন... দোকান তখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বাসায় কখনো ভালো খাবার না থাকলে আমি খেতাম না... আব্বা রেস্টুরেন্ট থেকে তখন খাবার নিয়ে আসতেন। আমাদের পাড়ায় সবাই বলত, ‘জোছনার আব্বা যতবার বাইরে যায়, কখনো খালি হাতে বাসায় আসে না!’

যশোরে তখন একটাই চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ছিল। অল্প আলোর শীতল ঘরের আলো-আঁধারিতে আব্বা প্রায়ই আমাদের কাঁটা চামচে খাওয়া শেখাতেন। তখন প্রতি শীতে যশোর শহরে ঈদগাহ ময়দানে মাসব্যাপী এক্সিবিশন হতো... প্রতি সপ্তাহে দু-এক দিন আমরা যেতামইÑসার্কাস দেখতাম, খেলনা কিনতাম, রাইডে চড়তাম, পানির ওপর ভাসমান রেস্তোরাঁয় খেতাম। তারপর বাড়ি আসার আগে টিকা আন্টির স্টলে আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে গিয়ে টিকা দেওয়া হতো। কারণ অন্য সময় টিকা আন্টি পাড়ায় ঢুকলেই সব ছেলেমেয়ে যে যেভাবে পারত পালিয়ে যেত... কেউ কেউ চিলেকোঠার কার্নিশে আশ্রয় নিত, কেউ পুকুরে ঝাঁপ দিত। আমরা সব ছোটাছুটি করে পালিয়ে যেতাম, কিন্তু এক্সিবিশন ময়দানে তো পালানোর কোনো পথ ছিল না, অগত্যা সুই ফোটাতেই হতো।

রোজ সকালে আমাদেরকে রেডি করে তারপর আব্বা নিজেও অফিসে চলে যেতেন। আমাদের স্কুলের কাপড় আয়রন করা, সাদা কেডসগুলোকে পরিষ্কার ধবধবে রাখার কাজটা আব্বা করতেন। দুপুরে বাসায় এসে আমাদের তিন ভাইবোনকে একসাথে নিয়ে ভাত খেতে বসতেন। সে সময় বাসায় কুরুক্ষেত্র চলত, কারণ আমাদের মাছ, উচ্ছে ভাজি আর শাক দিয়ে ভাত খেতে হতো, আর আমার ছোট ভাইটা কিছুতেই এসব খাবে না, আর আব্বাও না খাওয়ায়ে ছাড়বে না।

আব্বার অফিসে স্পোর্টসের সময় আব্বা-আমি দুজনই তিনটা ইভেন্টে জিততাম। আমাদের বাড়ির শোকেসে ভরা ছিল সেই সব পুরস্কারসামগ্রী। শিক্ষার ব্যাপারে আব্বার ছিল না কোনো কম্প্রোমাইজ। আমার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া আম্মাকে বিয়ের পর আমরা তিন ভাইবোন হয়ে গেলে তারপর তাঁকে আবার পড়াশোনা করান। মাস্টার এসে আম্মাকে পড়িয়ে যেতেন, আর আব্বা অফিস থেকে বাসায় এলে সারা দিনের কাজ শেষে আম্মা রাত জেগে টেবিলের ওপর ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতেন। আমার ছোট ভাইটা তখন কেবল কথা বলা শুরু করছে। কেউ যদি বলত, তোমার আম্মা কী করে? সে পড়ে বলতে পারত না, বলত, আম্মা পাদে!

আমার পাঁচ খালা, চাচাদের এবং চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোনদের প্রতে‍্যকের লেখাপড়ার প্রতি ছিল আব্বার সজাগ দৃষ্টি। পরীক্ষার আগে তাদেরকে আমাদের যশোরের বাড়িতে এনে মাস্টার দিয়ে এবং দিনের অধিকাংশ সময় পড়ার টেবিলে বসিয়ে রেখে আব্বা তাদেরকে পড়তে বাধ্য করতেন। আমার ছোট বোন ছিল আমাদের তুলনায় একটু গাধা, আব্বা ওকে ডারু বলে ডাকতেন। আব্বা নিজে ওকে এমনভাবে পড়িয়েছেন যে সে অঙ্কে, ইংলিশে লেটার মার্কস নিয়ে পাস করেছে। কম্পিউটার বের হওয়ার প্রথম দিকে সবাই যখন বাইরে কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গিয়ে শিখে আসত, আব্বা তখন আমাদের বাসায় কম্পিউটার কিনে দিয়েছেন।

ক্লাস নাইনে উঠলে এক ছেলে আমাকে একটা চিঠি দেয়... আমি বিছানার ওপর সেই চিঠি মেলে যেই না পড়তে বসেছি, অমনি আব্বা-আম্মা ঘরে ঢুকে খপ করে সেটি নিয়ে নেন...। শুনেছিলাম, ছেলেটির হাতের লেখা সুন্দর, কিন্তু আমার আর দেখা হইনি। ছেলেটি আমার বিয়ে হওয়ার পরও বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত, আর মানুষের কাছে আমার ভালো-মন্দ খোঁজ নিত। আমরা বন্ধুরা ওকে মজনু ডাকতাম, কিন্তু তার সাথে আমার কখনো কথা হয়নি, কারণ তখন থেকে আমার জীবন সীমাবদ্ধ হতে শুরু করে। আমি একা কোথাও যেতে পারতাম না, স্কুল হতে দেরি করে আসা যেত না, স্কুলের পিকনিকে যেতে পারতাম না। সমস্ত সাবজেক্টের টিচাররা বাসায় এসে পড়িয়ে যেতেন আমাকে। এ ছাড়া আব্বার কাছে আসা বিভিন্ন সাবজেক্টের টিচাররাও আমাদের বাসায় আতিথ‍্যকালে আমাকে তাঁদের নোট দিয়ে বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতেন। বাসায় টাইপরাইটার শিক্ষক এসে টাইপিং স্পিড হাই করে দিলেন। আব্বাই ছিলেন আমার কবিতা লেখা, ছবি আঁকার প্রথম মুগ্ধজন। তাই বাসায় একজন আর্ট টিচারও রেখে দেন। এসএসসি পাসের পর আমাকে আর যশোরে না রেখে বরিশাল মহিলা কলেজে ভর্তি করিয়ে হোস্টেলে রেখে দেন। তখন যশোর হতে বরিশালগামী মধুছন্দা বাসে দু-এক দিন পরপর আমার পছন্দের খাবার মিষ্টি, গলদা চিংড়ি, গরুর ভুনা, পাউরুটি, বিস্কুট সব পাঠিয়ে দিতেন। যেদিন বাসা হতে পাঠানো ভালো খাবার থাকত না, সেদিন আমি হোস্টেলের সামনের রেস্টুরেন্ট হতে তেহারি কিনে খেতাম। সেই তেহারির স্বাদ এতই মজাদার যে আমি একসাথে দুটো আনিয়ে রাখতাম, দুপুরের জন‍্যও। আমার বেহিসাবি অভ্যাসের জন‍্য কিছুদিন পরপর টাকা শেষ হয়ে যেত, আর আব্বা লোক মারফত মাসে কয়েকবার টাকা পাঠিয়ে দিতেন। ইন্টারমিডিয়েটের পর আমাকে পাওয়ার জন‍্য পরিচিত এক ছেলে আব্বার কাছে চিঠি লেখে। সেই ছেলেকে আগে আব্বা পছন্দ করলেও তার বাংলা লেখায় কয়েকটা বানান ভুল থাকায় আব্বা তো রেগে অগ্নিশর্মা। এক বাকে‍্য তিনি সেই ছেলেকে প্রত‍্যাখ্যান করলেন। সেই ছেলে আমার পরিবারের সবার কাছে, পাড়ার সবার কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে... কিন্তু আব্বার মন টলাতে পারেনি। আব্বা ডিফেন্সের একজনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেন। কিন্তু সেই ধনী-সুদর্শন প্রেমপ্রত‍্যাশী এতটাই সিরিয়াস ছিল যে আমি হঠাৎ একদিন প্রবাসী ছেলের বিয়ের প্রস্তাবে একাই রাজি হই। আম্মাকে বললাম, যেভাবে হোক আব্বাকে বোঝাতে হবে, কারণ দেশে বিয়ে করা আমার জন‍্য মোটেই নিরাপদ নয়! কিন্তু আব্বা আর নানা মোটেই রাজি নন। কারণ তখনো আমি পানি ঢেলে পর্যন্ত খাই না। আমার মশারি টাঙিয়ে দিতে হয়... আমি বিদেশে গিয়ে কী করব, সে চিন্তায় আব্বা শয‍্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তিনি উঠে দাঁড়াতে পারেন না। তারপর সিদ্ধান্ত হয়, আমার পড়াশোনা শেষ না হওয়া অবধি আমাকে বিদেশে পাঠাবেন না, আর এই শর্তেই বিয়ে হয়। বিয়ের পর সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত আমি একা চলাফেরা করার স্বাধীনতা পাই। তখন সেটা ছিল আমার মুক্তির আনন্দ। তিন বছর হলো আব্বা নিজেই এখন চাঁদ হয়ে গেছেন... কোথাও নেই, তবু যেন আমার কোষের প্রতিটা বিভাজনে আছেন। তাঁর সমগ্রটাই যেন আমি। কোভিডের আগে শেষবার যখন দেশে যাই, আসার আগে আব্বা বলেছিলেন, আর হয়তো দেখা হবে না। ভাবি নাই, সতি‍্যই সেটা হবে। চার বছর ডায়ালাইসিস শেষ। আব্বা চলে গেছেন হার্টফেল করে! তবে আব্বা দেখে গেছেন, তাঁর সন্তানেরা প্রবাসে সম্মানজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একজন ডায়াগনস্টিক মেডিকেল সনোগ্রাফার হিসেবে আমি যখন আব্বার বয়সী রোগীর হার্টের ইকোকার্ডিওগ্রাম করি, তখন তাঁদেরকে আমি আব্বার মতোই সেবা করি আর আফসোস করি, তাঁর এত তাড়াতাড়ি না চলে গেলেও হতো।
 

কমেন্ট বক্স