ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবের সামনে ছিল আমাদের বাসা। এখন থাকি ইস্ট রিভারের ধারে। মানুষ বুঝি পূর্বাপর নিয়তির চক্রে ঘোরে।
গেন্ডারিয়ায় তোমাদের বাসা কোথায়? জিজ্ঞেস করলে বলতাম, ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবের পূর্ব দিকে। এস্টোরিয়ায় আসার পরে বলি ইস্ট রিভারের কথা। এস্টোরিয়ায় আমাকে সেভাবে কেউ চেনে না। তবে গেন্ডারিয়ায় আমার আব্বাকে প্রায় সবাই চিনত।
রিকশা-সিএনজি, গায়ে গায়ে মানুষ, সরু গলি, ধুলোময় বাতাস, ঝুলে থাকা কারেন্টের তার, চা-ডালপুরির দোকান-সব মিলে আমাদের গেন্ডারিয়া। যার নাম রাখা হয়েছিল গ্র্যান্ড এরিয়া থেকে। এত বড় এলাকায় কোন অংশে আমাদের বাসা জানতে চাইলে বলতাম, ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবের নাম। গেন্ডারিয়ায় এসে ‘মহিত সাহেবের বাসা’ বললেও অনেকেই চিনিয়ে দিতে পারত!
জন্মাবধি দেখেছি আব্বা ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। কখনো নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কখনো সহসভাপতি, কখনো সদস্য কিংবা ফুটবল কমিটির সম্পাদক ইত্যাদি। তবে সভাপতি হওয়া কখনো হয়নি আব্বার। সভাপতি করা হতো এলাকার মান্যগণ্য, আর্থিকভাবে বিত্তশালী মানুষদের, যারা ক্লাবকে বড় অঙ্কের টাকা অনুদান দিতে পারেন।
আব্বা টাকার বদলে দিতেন অফুরন্ত স্বেচ্ছাশ্রম। তার বিনিময়ে কোনো প্রতিদান পাননি তিনি! বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মহানগরী লিগ কমিটিতে ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করা সূত্রে দু-তিনবার হয়তো ব্লেজার পেয়েছিলেন আর ফুটবল মৌসুমের ফ্রি টিকিট-এই টুকুই।
ষাটের দশকে বাগেরহাট পিসি কলেজের ভিপি ছিলেন আব্বা। ওই সময়ে কলেজের দর্শনের এক অধ্যাপক ক্লাসে পড়ানোর সময়ে বলেছিলেন, ‘সিম্পল লিভিং আর হাই থিঙ্কিং’ এর কথা। স্যারের সেই কথাকেই জীবনের আরাধ্য করেছিলেন আব্বা। অথচ ওনার অনেক সহপাঠী ছিলেন অত্যন্ত সফল। আব্বার বাগেরহাট কলেজ-জীবনের বন্ধুরা মাঝেমধ্যে আমাদের পুরান ঢাকার বাসায় আসতেন। সৈয়দ মোহাম্মদ নসরুল্লাহ চাচা ছিলেন যুক্তরাজ্যের কোনো এলাকার মেয়র, আবু সাইদ মোহাম্মদ জহিরুল হক চাচা ছিলেন কবি ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিসিসিপির অধ্যাপক, আল কামাল আবদুল ওয়াহাব চাচা ছিলেন কবি ও ছড়াকার। আরও অনেকে ছিলেন নামকরা ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা। আব্বার মতো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো কেউ ছিলেন না!
ফুটবল সংগঠক হওয়ার আগে আব্বা রাজনীতি করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিরোজপুর শহরে যাদের হত্যার তালিকা করেছিল, সেখানে আব্বার নাম ছিল দ্বিতীয় স্থানে। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ঘরের পাটাতনের নিচে একটা ঘরে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। রাত গভীর হলে বাইরে বের হয়ে খাওয়াদাওয়া ও বাথরুমে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। শরীরের প্রতি এই অনিয়মের জন্য জীবনের বাকি সময় প্রচুর ভুগতে হয়েছে আব্বাকে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে লুকিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন।
সহজ-সরল আচরণের জন্য রাজনীতিতে সফল হতে পারেননি, হয়েছিলেন ক্রীড়া সংগঠক। প্রতি মৌসুমে ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবকে দেখতাম ‘ফাইট’ দিতে ‘রেলিগেশন’ বাঁচানোর জন্য। কোনো দিন কোনো ট্রফি জিততে দেখিনি তাদের। আসলে কোনো ট্রফিই ছিল না আব্বার জীবনে। জীবনভর স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে গেছেন। অলিম্পিক গেমস কিংবা বড় আসরগুলোর শেষে আয়োজকেরা ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্দেশে ধন্যবাদ জানায়, সবাই তখন দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে সম্মান জানায়। যদি কোনো দিন সুযোগ থাকত, পৃথিবীর সেরা ভলান্টিয়ারের পুরস্কারটা আব্বাকে দিতাম।
আব্বার জীবনে ছিল না কোনো বিলাসিতা, ছিল না কোনো আকাক্সক্ষা! ধূপখোলা মাঠে প্রতিবছর গরু-ছাগলের হাট বসত। সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থে ফুটবলারদের বেতন দেওয়া হতো, ক্লাবের চুলায় হাঁড়ি চড়ত। আব্বার সাদা পাঞ্জাবির এক পকেটে থাকত ক্লাবের টাকা, আরেক পকেটে কখনো স্থানীয় মসজিদের কিংবা সমাজকল্যাণ অফিসের টাকা!
আব্বার নিজের টাকা বলতে তেমন কিছু ছিল না। সবাই ওনার কাছে টাকা জমা রাখতেন, কারণ তিনি ছিলেন বিশ্বাসী মানুষ। শুধু টাকা নয়, অনেকে ওনার কাছে কথা জমা রাখতেন। টাকা রাখার জন্য ব্যাংক থাকলেও কথা জমা দেওয়ার জন্য জায়গার ছিল অভাব। আমাদের বাসার উঠান সংলগ্ন বারান্দায় প্রায়ই দেখতাম নানাজন আসত। আব্বা-আম্মাকে নানা সমস্যার কথা বলত। দুজনে সৎ পরামর্শ দিতেন। দুজনেই কখনো একজনের কথা অন্যজনকে বলতেন না। সব সময় মানুষকে মিল করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। মৃত্যুর আগে বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালের আইসিইউতে আব্বা দীর্ঘদিন চিকিৎসারত ছিলেন। ওনার শ্বাসযন্ত্র ভালোভাবে কাজ করত না। শেষের দিকে গলার মধ্যে পাইপ বসিয়ে শ্বাস নিতে হতো বলে কথা বলতে পারতেন না। বরিশাল থেকে আমাদের সমস্ত আত্মীয়স্বজন আব্বাকে দেখতে এসেছিলেন সেই সময়। তাদের দেখলেই আব্বার দুই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে নামত। নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সেই দিনগুলোতে আব্বার কেমন লাগত, কোনো দিন জানা হয়নি আমার। কখনো হবেও না। জন্ম হওয়ার পর থেকে দেখেছি আব্বা ইংরেজিতে ডায়েরি লিখতেন। সব ছেলেমেয়ের জন্মতারিখ বাংলা-ইংরেজি-আরবি সালের হিসাবে লিখে রেখেছিলেন। বছরের শুরুতে ডায়েরি পেতে দেরি হলে খাতায় লিখে রাখতেন, পরে আবার ডায়েরিতে টুকে নিতেন। এতটাই সিরিয়াস ছিলেন আব্বা ডায়েরি লেখার ব্যাপারে। এখন তাতে ধুলো জমেছে। আব্বা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন না যে তার ডায়েরি কেউ পড়বে!
হাসপাতালের শেষ দিনগুলোতে আমার একবারও মনে হয়নি, আব্বাকে একটা ডায়েরি এনে দিই! আসলে এত কিছু বোঝার মতো চিন্তার গভীরতা ছিল না তখন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওনার মস্তিষ্ক পুরোপুরি সচল ছিল। কিন্তু মৃত্যুর আগে এক মাসের বেশি সময় কথা বলতে পারেননি। দরকারি কথাবার্তা ইশারায় অথবা কাগজে লিখে জানাতেন। ডায়েরি থাকলে হয়তো লিখে যেতে পারতেন, মৃত্যু নিশ্চিত জেনে গভীর বেদনাময় সেই অনুভবের কথা, ঠিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারার ভয়ংকর সেই কষ্টের কথা।
মাঝেমধ্যে সন্ধ্যা নামার আগে যখন ইস্ট রিভারের তীরে গিয়ে বসি, অপস্রিয়মাণ দিনের ছায়া দেখতে দেখতে ভাবি, ইস্ট ক্লাবের সামনে আমাদের বাসার কথা। আমাদের একতলা বাড়ি, ঘরের সামনে বড় উঠান, চারপাশে আমগাছ-পেয়ারাগাছ, আব্বা-আম্মা সেখানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন! বিশাল মালবাহী জাহাজ চলে গেলে উথাল-পাথাল ঢেউ ওঠে নদীর বুকে। তেমনি বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস আসে, দুই চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। এই বাবা দিবসের মাসে ২০০৪ সালের ২২ জুন পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আব্বা। তখন বাবা দিবস কী আমরা জানতাম না! কোনো দিন ভালো করে বলা হয়নি, বাবা তোমাকে কতখানি ভালোবাসতাম!