বিপ্লবের পর ঘরে ঢুকেছিলাম একজোড়া পোড়া জুতো পায়ে,
মায়ের মুখ অন্ধকার,
সে বুঝতে পারেনি, তার ছেলে মানুষ হলো, নাকি
আরও একটা পাথর!
আমরা একসময় একসাথে ছিলাম-
আটজন, দশজন, পঁচিশজন-কারও কাঁধে বন্দুক, কারও বুকে কবিতা,
কারও মুখে আগুন, কারও চোখে নোনা নদী...।
বিপ্লবের সময়,
মৃত্যু ছিল একটি সহজ ছুটি, আর ভয় ছিল না আমাদের শরীরের কোনো স্থায়ী বাসিন্দা।
তখন আমরা বিশ্বাস করতাম
শুধু গুলি নয়,
ভালোবাসাও শত্রুর বিরুদ্ধে একটি ধারালো অস্ত্র।
তারপর...।
বিপ্লব হলো,
নেতা উঠলেন মঞ্চে,
বুক ফেটে চিৎকার করলেন-
‘আমরা জিতে গেছি!’
পেছনে পড়ে রইল যে, সে আমার ভাই,
তার শরীরে শত্রুর ঘামের গন্ধ ছিল না,
শুধু অন্য রকম প্রশ্ন ছিল তার মুখে।
প্রথম ভুলটা সেখানেই হলো।
শত্রুরা তখন আর বুট পরে আসেনি,
ওরা এসেছিল অফিসারের হেসে-চলা মুখে,
চুক্তিপত্রে,
দলীয় সংবর্ধনায়,
আত্মজীবনীতে লেখা
‘আমিও একদিন ছিলাম বিপ্লবী’ কথাটার আড়ালে।
আমরা বুঝিনি,
পরাজিত শত্রুরা মরে না, তারা রং বদলায়Ñ
কখনো ফুল হয়ে, কখনো কাঁটা হয়ে ফোটে।
দ্বিতীয় কারণটা আরও গভীর, আরও একাকী।
বিপ্লবের পর আমরা ঘরে ফিরলাম,
বোনের চোখে দীর্ঘদিনের ভয়,
ভাইয়ের কাছে অচেনা ভাই,
রাতের খবরে আমাদের মুখ নেই-
সেখানে শুধু অভিযোগ আর অনুযোগ।
একদিন
এক বিপ্লবী বলেছিল,
‘চাচা, আমার বোনের স্কুল-ফি বাকি।
আমি আর পারছি না মিছিলে যেতে।’
আরেকজন-
একজন শিল্পপতির সাথে বৈঠক করে এল,
কারণ তার ঘএঙ চালাতে ফান্ড দরকার।
বিপ্লব আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাল না,
আমরাই ফাটল ধরালাম বিপ্লবের গায়ে।
আজকাল আমি একা হাঁটি,
একটা রুক্ষ, ধুলোমাখা, জ্যামের শহরে-
যেখানে বিপ্লবের কথা বললে লোকে হাসে,
আর ভালোবাসার কথা বললে বলে,
‘বয়স হলো না তোমার?’
এখন মাঝে মাঝে মনে হয়-
বিপ্লবটা আসলে কোনো দিন হয় না।
যা হয়, তা কেবল এক দিনের ঝড়,
তারপর শুরু হয় এক দীর্ঘ গরম দিন,
যেখানে আমাদের সবার বুকে ভয়, চোখে বিরক্তি,
আর হৃদয়ে-এক ভয়াবহ শূন্যতা।
আমি জানি,
বিপ্লবের চেয়ে বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখা অনেক বেশি কঠিন।
তাতে রক্ত নয়,
সময় লাগে, আত্মত্যাগ লাগে এবং অসম্ভব ধৈর্য-
যা আমাদের নেই।
তুমি যদি কোনো দিন আমার কবরে আসো,
দেখবে একটা ছোট্ট লেখা খোদাই করা-
‘এখানে শুয়ে আছে সেই মানুষ,
যে বিপ্লবের পরে মানুষ থাকতে চেয়েছিল-
কিন্তু পারেনি।’
শেষ অবধি, বিপ্লব হলো, মরেও গেল-
শুধু রেখে গেল তার ছায়াটা।
যেখানে অলসবেলায় কেউ ঘুমিয়ে পড়ে,
আর কেউ কবিতা লেখে।