Thikana News
০৯ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
বিবিসির প্রতিবেদন

শেখ হাসিনার নির্দেশেই প্রাণঘাতী দমন-পীড়ন, অডিও ফাঁস

শেখ হাসিনার নির্দেশেই প্রাণঘাতী দমন-পীড়ন, অডিও ফাঁস সংগৃহীত
বাংলাদেশে গত বছরের ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রাণঘাতী দমন-পীড়নের অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপের ভিত্তিতে এমন দাবি উঠেছে, যেটি যাচাই করেছে বিবিসি আই।

মার্চ মাসে অনলাইনে ফাঁস হওয়া এই অডিওতে হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি তার বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে “মারণাস্ত্র ব্যবহারের” অনুমতি দিয়েছেন এবং বলেন, “যেখানে পাবে, সেখানেই গুলি করবে।”

বাংলাদেশে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অনুপস্থিত অবস্থায় বিচার চলছে শেখ হাসিনার এবং প্রসিকিউটররা এই রেকর্ডিংকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে যাচ্ছেন।

জাতিসংঘের তদন্ত অনুযায়ী, গত গ্রীষ্মে ওই দমন-পীড়নে প্রায় এক হাজার ৪০০ জন প্রাণ হারান। হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন এবং তার দল আওয়ামী লীগ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বলেন, এই টেপে ‘‘অবৈধ কোনো উদ্দেশ্য বা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের পরিকল্পনা’’ প্রমাণিত হয় না।

ফাঁস হওয়া অডিওতে শেখ হাসিনা এক অজ্ঞাত সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলেন এবং এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ, যেখানে সরাসরি গুলি চালানোর আদেশের কথা বলা হয়েছে। গত গ্রীষ্মে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এটি ছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা।

৫ আগস্ট ছিল সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন, সেদিন আন্দোলনকারীরা ঢাকায় হাসিনার বাসভবন ঘেরাও করলে তিনি হেলিকপ্টারে পালিয়ে যান।
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের তদন্তে ঢাকার এক পুলিশী হত্যাকাণ্ড নিয়ে আগে অজানা অনেক তথ্য উঠে এসেছে। ওই তদন্তে দেখা যায়, পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি।

অডিও কলটি ১৮ জুলাই ঢাকার গণভবনে অবস্থানরত অবস্থায় করা হয়েছিল বলে একটি সূত্র জানায় বিবিসিকে। কলের সময়, সামাজিক মাধ্যমে পুলিশি গুলির ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

পুলিশের নথি অনুযায়ী, কলের কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকাজুড়ে সামরিক মানের রাইফেল মোতায়েন এবং ব্যবহার করা হয়।
এই কলটি বাংলাদেশের ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) রেকর্ড করেছিল বলে জানা গেছে, যা সরকারিভাবে যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ করে।

অডিওটি কারা ফাঁস করেছে তা স্পষ্ট নয়। তবে গত এক বছরে শেখ হাসিনার বেশ কিছু কল অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে, যদিও সবগুলোই যাচাই হয়নি। ১৮ জুলাইয়ের কলটি বাংলাদেশের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হাসিনার পরিচিত কণ্ঠের সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চিত করে।

বিবিসি স্বাধীনভাবে যুক্তরাজ্যের ফরেনসিক অডিও বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান ইয়ারশট-এর সহায়তায় কলটির সত্যতা যাচাই করে। তারা বলেন, এতে কোনো কাটাছেঁড়ার প্রমাণ মেলেনি এবং এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও অত্যন্ত কম।

ইয়ারশট আরও জানায়, কলটি সম্ভবত স্পিকারে চালানো ফোনালাপ রেকর্ড করে ফাঁস করা হয়েছে। অডিওতে ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি (ইএনএফ) পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত দেয় রেকর্ডটি আসল।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পরামর্শ দেওয়া ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বলেন, “এই রেকর্ডিংগুলো শেখ হাসিনার ভূমিকা প্রমাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—এগুলো স্পষ্ট, সঠিকভাবে যাচাই করা হয়েছে এবং অন্যান্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত।”

আওয়ামী লীগের মুখপাত্র বলেন, “বিবিসির উল্লেখ করা টেপটি আসল কি না, তা আমরা নিশ্চিত করতে পারি না।”
শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক সরকার ও পুলিশ কর্মকর্তারাও এ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত। মোট ২০৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৩ জন এখন পুলিশ হেফাজতে।

বিবিসি আই শত শত ভিডিও, ছবি ও নথিপত্র বিশ্লেষণ করেছে, যেখানে দেখা যায়, ৩৬ দিনের আন্দোলনে কীভাবে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ চালায়।

বিশেষ করে ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫২ জন নিহত হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পুলিশি সহিংসতার মধ্যে অন্যতম। আগের প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩০।

বিবিসির তদন্ত অনুযায়ী, সেনাবাহিনী এলাকা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। তারা ৩০ মিনিট ধরে চলমান আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পাল্টা প্রতিরোধে অন্তত ছয় পুলিশ সদস্য নিহত হন এবং যাত্রাবাড়ী থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ পুলিশের এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, ওই সময়কার সহিংসতার জন্য ৬০ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, তৎকালীন পুলিশের কিছু সদস্য অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগে জড়িয়ে পড়েছিল, যা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। বাংলাদেশ পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়েছে গত মাসে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি গণহত্যা ও সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে উসকানি, ষড়যন্ত্র এবং গণহত্যা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে।

বাংলাদেশের অনুরোধের সত্ত্বেও ভারত এখনও শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠায়নি। মানবাধিকার আইনজীবী ক্যাডম্যান বলেন, তার দেশে ফিরে বিচার মোকাবিলার সম্ভাবনা কম। 
আওয়ামী লীগ বলছে, তাদের নেতাদের কেউ এই সহিংসতার জন্য দায়ী নয়।

এক বিবৃতিতে দলটি জানায়, আওয়ামী লীগ স্পষ্টভাবে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করছে যে, দলের সিনিয়র নেতারা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন।

‘‘তৎকালীন সিদ্ধান্তগুলো ছিল যথাযথ, সদিচ্ছা থেকে নেওয়া এবং প্রাণহানি কমানোর উদ্দেশ্যে।’’

জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনকেও দলটি প্রত্যাখ্যান করেছে, যেখানে বলা হয়েছে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কর্মকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ হতে পারে।

বিবিসি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মন্তব্য জানতে চাইলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বাধীন সরকার জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখনও পরিষ্কার নয়, আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না।

ঠিকানা/এসআর

কমেন্ট বক্স