রক্ত ঝরার ১৬ জুলাই ফিরে এলো। কোটা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’। পুলিশের গুলিতে নিহত পীরগঞ্জের সন্তান। সারাদেশে আরও ৫ জন শহীদ। পরদিন দেশে-বিদেশে ‘গায়েবী জানাজা’। তাতেও ‘পুলিশ-বিজিপি’র প্রতিহতকরণ পদক্ষেপ। ফলশ্রুতিতে ছাত্র-গণ আন্দোলন চাঙ্গা হলো। পুরো দেশের আন্দোলনকামী তরুণরা ‘আবু সাঈদ’ হলো। বুলেটের সামনে বুক পেতে দেয়ার সাহসী দৃষ্টান্ত।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ছাত্র। পঞ্চম, অষ্টম, ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েটে চোখকাড়া ফলাফল। সরকারি বৃত্তিতে কাটছিলো মেধাসিক্ত শিক্ষাজীবন। সেই মেধা প্রকাশের সুযোগ বন্ধ প্রায়। কোটা প্রথায়- ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকার। তাই প্রতিহতকরণে প্রতিরোধ কর্মসূচি। পুলিশের সামনে বুক উঁচিয়ে জানায় প্রতিবাদ। জিঘাংসা-জাগানো পুলিশ ছুড়ে দেয় গুলি। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আবু সাঈদ।
আবু সাঈদের মায়ের কাছে সরাসরি প্রশ্ন। কখন, কীভাবে জানলেন হত্যাকান্ডের কথা?
আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম মুখ খুললেন। বললেন, বাটন ফোনেই প্রথম খবর পাই। সময় তখন বিকাল ৩টা। কে একজন খবরটা দিলো। জানালো যে আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ। পুলিশের গুলি খাওয়ায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আমার বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। কারণ ৬ ভাইয়ের সবচেয়ে ছোট সে। টিউশনি করে নিজে চলতো। পরিবারেও মাসে মাসে টাকা দিতো। কিন্তু টাকা-পয়সার আলাপ পরে। ধীরে ধীরে জানলাম ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। তাকে আর ফেরানোর কোন উপায় নাই। পরে বাসার উঠোনে এলো রক্তমাখা লাশ হয়ে।
আবু সাঈদের বাবার কাছেও একই প্রশ্ন।
মকবুল হোসেন : জমি-জমার কাজে বাইরে ছিলাম। বাসায় ফেরার পথে কিছুটা শুনলাম। একজন ফোনে বললো- টিভি দেখেন। নায়কের মতোন বুক পেতে দিয়েছে সন্তান। বীরের মতো জীবন দিয়েছে সে। সংবাদটি শুনে পাগল হওয়ার অবস্থা। আমরা গরিব মানুষ, বাসায় কোন টিভি নাই। আমি বাইরে বেরিয়ে গেলাম। রাস্তার এক চা-দোকানে টিভি চলছিলো। সেখানে গিয়েই বিশাল পর্দায় পুরোটাই দেখলাম। দোকানদার গরম চা দিয়েছিলো মায়া দেখিয়ে। আমি তাতে ছায়া দেখছিলাম আবু সাঈদের। চোখ থেকে টপ টপ জল পড়লো উত্তপ্ত চায়ে। আমি বুঝলাম আমার হাত-পা কাঁপছে।
শহীদ আবু সাঈদ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ একাধিকবার। ২০২৪-এর অক্টোবরে গেলাম বাবনপুর গ্রামে। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্বশুরালয় পীরগঞ্জ। স্বামী ড. ওয়াজেদ আলী মিয়ার সমাধি সেখানে। ‘জয় সদন’ নামে পারিবারিক বাড়িও আছে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এলাকার সদ্য সাবেক এমপি। নোয়াখালির মেয়ে বৃহত্তর রংপুরের ‘অতিথি এমপি’। বিষয়টি মন্দের ভালো হলেও সমালোচনাই অধিক।
বাবনপুর এলাকাটি আবু সাঈদের কারণে ‘হঠাৎ আলোড়িত’। ৮ আগস্ট ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান হন ড. ইউনূস। রাজধানীর বাইরে প্রথম সফরটি করেন পীরগঞ্জে। বিশেষ হেলিকপ্টারে নেমে সড়কপথে যান বাবনপুরে। বাড়ির সামনেই শহীদ আবু সাঈদের সমাধি। প্রতিদিন মানুষ সেখানে পুষ্পমাল্য অপর্ণ করছে। দোয়া-দরুদ-ফাতেহাও পাঠ করছে। আলোকচিত্রে বা সেলফিতে স্মৃতিময় করছে ভ্রমণ।
দেশের অধিকাংশ সরকারি দফতর-প্রধানরা শ্রদ্ধা জানিয়েছে। উচ্চ ক্ষমতাবানরা রংপুর গেলে বামনপুরও যাচ্ছেন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সাঈদের বাবা-মাকে দর্শন দেন। ফলে টিনের চালের বাড়িটিতে এখন মিনি অট্টালিকা। এটাচ্ড টয়লেট-অলা সুপরিসর দালান। আবু সাঈদের নামে ‘মিনি জাদুঘর’। মজার বিষয়- ফ্রেমে বাঁধানো নিবেদিত কবিতা। দেশ-বিদেশ থেকে পাঠানো সৌখিন কবিদের লেখা। আবু সাঈদের বীরত্ব খচিত বলিদানের ওপর লেখা। সাঈদের পরিবার যত্ন করে দেওয়ালে গেঁথে রেখেছে। কবিতার প্রতি এমন শ্রদ্ধা-অনুরাগ ভালো লাগলো। জানিনা সৌভগ্যবান আধাডজন কবি সে খবর রাখেন কিনা।
আবু সাঈদের সমাধিতে ড. ইউনূস, বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি
কেউ হেলিকপ্টারে, কেউ গাড়িতে, কেউ পায়ে হেঁটে
ক্ষমতা গ্রহণের ৩য় দিনেই ড. ইউনূস বামনপুরে। হেলিকপ্টারে পীরগঞ্জ হয়ে ৭ কিলোমিটার গাড়িতে। বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর যান গাড়িতে। সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে অভিযাত্রা। আবু সাঈদ পরিবাকে দেন ৩ লাখ টাকা। পর পর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে যায় জামায়াতে ইসলাম। আমির ডা. শফিকুর রহমান চমক দেখান। ড. ইউনূস স্টাইলে তিনি যান হেলিকপ্টারে। সাঈদের পরিবারে হাতে দেন নগদ ৬ লাখ টাকা। টিনের বাড়িটি পাকা করে দেওয়ার অঙ্গীকারও করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নব-সংগঠন ‘এনসিপি’। বাবনপুরে আনুষ্ঠানিক অভিযাত্রা ২০২৬-এর পয়লা জুলাই। ‘জুলাই আন্দোলনের’ স্মারক কর্মসূচি সেটি। দেশের ৬৪ জেলায় পদযাত্রার উদ্বোধন করা হয়। শহীদ আবু সাঈদের সমাধি থেকে কার্যক্রমের শুরু। পদযাত্রা করলেও গাড়িবহর ঢুকেছিলো বাবনপুরে।
সাঈদ পরিবারের প্রিয় রাজনীতিক এইচএম
এরশাদ ॥ প্রিয় গায়ক আব্বাসউদ্দিন
আক্টোবরে সাঈদ পরিবারে যাই ‘আব্বাসউদ্দিন একাডেমি’ সহকারে। কারণ ‘আব্বাসউদ্দিনের ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি বিশেষ পছন্দ। আবু সাঈদ হত্যার তিনমাসও যায়নি। পরিবার সদস্যদের শোকের মাতম কাটেনি। তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্যে ‘আব্বাসউদিন একাডেমি’ উদ্যোগ নেয়। কৃতী শিল্পীরা শোনায় মন মাতানো সঙ্গীত। ছিলেন সহিদুল সরকার, মন্নুজান ঝর্ণা, মালা জেসমিন প্রমুখ।
আবু সাঈদের পিতা প্রবীণ মকবুল হোসেন। আমাদের আগমনবার্তা শুনে বাইরে থেকে ফিরলেন। বললেন, প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছিলো। পরে মনোয়ারা বেগমকে বিয়ে করেন। দুই ঘর মিলে ৬ ছেলে ৩ মেয়ে।
প্রশ্ন করলাম এতোদিন কাকে ভোট দিয়েছেন? উত্তরে বললেন ঠিকমতো ভোটই হয়নি। তো কারে আর দিবো? তবে আমাদের প্রিয় নেতা ছিলো এরশাদ। উনি মারা যাওয়ায় ভোটকেন্দ্রে আর যাই না।
ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের জন্মতিথি ২৭ অক্টোরর। নীলফামারী জেলার ডোমারে ছিলো সাংস্কৃতিক উৎসব। আমন্ত্রণ পেয়ে যোগ দেন আবু সাঈদ পরিবার। সাঈদ-মাতা মনোয়ারা বেগমসহ আমি তা উদ্বোধন করি। তিনি বলেন, সন্তান হারানোর পর প্রথম বাইরে বেরুলাম। ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি লোকসঙ্গীত শুনে প্রাণ জুড়ালাম। উল্লেখ্য, সাঈদ-ভ্রাতা আবু হোসেন, রমজান আলীও অতিথি ছিলেন।
সরকারি চাপে বসুন্ধরার চাকরি
ছাড়েন সাঈদ ভ্রাতারা
৫ আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের পর নতুন সুযোগ। শহীদ আবু সাঈদের বোন সুমি চাকরি পেলো। বেগম রোকেয়া ‘বিশ্ববিদ্যাল’য়ে মাঝারি পদে পদায়ন। বসুন্ধরা গ্রুপ চাকরি দিয়েছিলো রংপুর অফিসে। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন-সহ মিডিয়া গ্রুপ। সহোদর আবু হোসেন রমজান আলী যোগ দিয়েছিলো। কিন্তু তিন মাসের মাথায় দুজনই ‘রিজাইন’ করে। এবিষয়ে আবু হোসেন বলেন, বিষয়টি গোপন। সরকারপক্ষ চায়নি আমরা বসুন্ধরায় যুক্ত থাকি। তাই চাকরি ছেড়ে এখন কৃষিকাজ করছি।
শহীদ আবু সাঈদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়
করেও করলোনা সরকার
বরাবর কৃতী ছাত্র ছিলো শহীদ আবু সাঈদ। জন্ম ২০০১-এ, বাবনপুর, পীরগঞ্জ। স্কুলে জিপিএ-৫, ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্ত। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ১২তম ব্যাচ। পীরগঞ্জে ‘শহীদ আবু সাঈদ বিশ্ববিদ্যালয় করছিলো সরকার। সাবেক উপ-উপদেষ্টা প্রফেসর আমিনুল ইসলাম ঘোষণাও দেন। পীরগঞ্জে আবু সাঈদ ফাউন্ডেশনের উন্মোচন অনুষ্ঠানে। শিক্ষাপ্রেমিক আবু সাঈদের ভক্তরা এতে খুশি হন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়েছে।
এনসিপি বুঝিনা রাজনীতি
বুঝিনা, ড. ইউনূস বুঝি.....
জুলাই আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের সমাধিতে ‘এনসিপি’। অনেকের ধারণা পরিবারটি নতুন দলে নাম লেখাবে। কিন্তু না, সিন্ধান্ত নিয়েছে নিরপেক্ষ থাকার। প্রসঙ্গক্রমে পরিবারের বক্তব্য পরিস্কার। বলছে এনসিপি বুঝিনা, রাজনীতি বুঝিনা, একমাত্র ড. ইউনূসকে বুঝি। তিনি আমাদের কথা দিয়ে কথা রেখেছেন। সব সময় খোঁজ খবর রাখেন। বিশ্বমঞ্চে আবু সাঈদের ভূমিকা মেলে ধরেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারে উত্তরবঙ্গের কোনো উপদেষ্টা নেই। ড. ইউনূস স্বয়ং তা পালন করছেন। শহীদ পরিবার হিসেবে আমরা ওনার সাহারা পেয়ে আসছি। ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ প্রবর্তনের মাধ্যমে চিরঋণী করে রেখেছেন।