ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সফরসূচির দিনক্ষণ এখনো স্থির হয়নি। তবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তার ঢাকায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি, দলের বিশিষ্ট নেতাদের দেশে ফিরে আসার প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু হবে। আগামী দু-তিন মাসের মধ্যেই তারা পর্যায়ক্রমে দেশে ফিরে আসবেন।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে লক্ষণীয় অবনতি ঘটে। আনুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত সিল করা না হলেও দুই দেশের মধ্যে মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহন প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এক বছরেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। তবে ক্রমে উন্নতি হচ্ছে। সরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ভারতবিরোধী শক্তির প্রকাশ্য ভারত-বিরোধিতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েই নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতা পরিহার করে চলার নীতি নিয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে সন্তুষ্ট ভারত সরকার অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের পরম বিশ্বস্ত হাসিনা সরকারকে হটানোর পর দুই দেশের সম্পর্কে এতটাই অবনতি ঘটে যে বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাইকমিশন, উপহাইকমিশনগুলো থেকে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক বছর হতে চলল, এখনো ভারতীয় কঠোরতায় নমনীয়তা আসেনি। তবে কূটনৈতিক সূত্র আভাস দিয়েছে, আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমিতভাবে হলেও ভিসা দেওয়া শুরু করবে। বর্তমানে রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভিসা দেওয়া হচ্ছে, কিছুদিন আগেও যা পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তিন মাস আগেই বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। ভারতের দিক থেকে প্রত্যুত্তরে কিছু জানানো হয়নি। কূটনৈতিক সূত্রে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে অতি সম্প্রতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নমনীয়তার আভাস পেয়েছে। এ ব্যাপারে কিছুদিনের মধ্যেই আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা যায়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ ব্যাপারে তারা সরকারের ওপর চাপও সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নামে দায়ের করা গ্রেফতারি পরোয়ানা ভারতে পাঠানোর দাবিও করছে তারা। তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করারও দাবি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের এসব দাবির ব্যাপারে জামায়াত ও এনসিপির প্রত্যাশা অনুযায়ী কঠোর নীতি গ্রহণ করছে না। এতে তারা অসন্তুষ্ট হলেও সরকার নির্বিকার।
এদিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি যেমন বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতর পর্যায়ে নেওয়ার নানামুখী চেষ্টা করছে, বিএনপির মধ্যেও সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখছেন, যা ভারতীয়দের আস্থা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হচ্ছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরার ঘটনা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে যে অবনতি হয়েছিল, সাম্প্রতিক সময়ে তা কেটে গেছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিএনপিকে তাদের বিকল্প, বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করে। জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতবিরোধী বক্তব্য, অবস্থান রাখলেও সব ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ততটা কঠোর ও অনমনীয় নয়। যে কারণে বিএনপির প্রতি ভারতীয় নমনীয়তার বিরুদ্ধে তারা কথা বলছে না। জামায়াতের সঙ্গেও ভারতের ভালো বোঝাপড়া ও বৃহত্তর সমঝোতা রয়েছে।
বিএনপির নেতৃস্থানীয় সূত্রে আভাস দেওয়া হয়েছে, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের ব্যাপারে ভারতীয়রাসহ সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক শক্তিগুলো আস্থাশীল। ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান, চীন ও পশ্চিমা শক্তিও বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সম্পর্ক নতুনভাবে স্থাপন করছে। বিএনপিকে ভারতীয় বলয়মুক্ত রাখা হলেও পারস্পরিক স্বার্থেই উভয়ের সম্পর্কে দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। এ বিবেচনা থেকেই বিএনপি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতর স্তরে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ বছর অভ্যন্তরীণ ঘাটতি মেটাতে ভারত থেকে কমপক্ষে ২০ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করতে হবে। ভারত কৃষিপণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে হাহাকার পড়ে যাবে। ভারতীয় উচ্চতর পর্যায়ে এ রকম চিন্তাভাবনার কথা প্রভাবশালী উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে জানতে পেরে সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে। ফলে অপরিণত, তরুণ শিক্ষার্থীদের দাবি থেকে সরকারকে সরে আসতে হয়েছে। সব দিক মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছে।