জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান এবং ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছিল, এক বছর পর এসে রাজনীতির মাঠের হিসাব-নিকাশ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার খেলায় তাতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে।
গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও কর্মকাণ্ডে এসেছে অনেক পরিবর্তন, যা দিনে দিনে ‘অনৈক্যের’ রাজনীতিকে স্পষ্ট করে তুলছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ও আগামী জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিন্নমত চর্চা এবং দলগুলোর নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার প্রক্রিয়ায় মাঝেমধ্যেই উত্তাপ ছড়ানো মাঠের রাজনীতি পুরনো রাজনীতির ছায়া হয়ে উঠছে কি-না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
‘৩৬ জুলাই’ পরবর্তী মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কতটা মৌলিক পরিবর্তন এল, তা নিয়ে সন্দিহান রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলছেন, জুলাই আন্দোলনে ‘কর্তৃত্ববাদী শাসন বিরোধী’ যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটা পূরণে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার। সে পরিবর্তনের ‘এজেন্ট’ হচ্ছে রাজনৈতিক দল।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু, নতুন বা পুরাতন দল, কেউই সেভাবে সে পরিবর্তনের পক্ষে সাড়া দিতে পারছে না। সরকার তাদেরকে সেভাবে সহযোগিতা করতে পারছে না।”
আরেক বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, “বলার অপেক্ষা রাখে না যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি-জামায়াত নিজেরাই এমনভাবে ক্ষমতার চর্চা করা শুরু করেছে যে মনে হচ্ছে শুধু মানুষই পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু কোনো প্রক্রিয়ার পরিবর্তন হয়নি।
“নতুন দল হিসেবে এনসিপির বিরুদ্ধেও কম বেশি অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের কাছ থেকে চাঁদা দাবি, যৌন হয়রানিসহ নানা বিষয়ে তাদের একাধিক নেতা আলোচনায় এসেছেন।”
কোনো একটি দলের বিপক্ষে অভিযোগ উঠলে আরেক পক্ষ যে খুশি হয়, তাও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।
গত বছর ১ জুলাই সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারসহ চার দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামের প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়। ৩৬ দিনের আন্দোলনে পরের মাসের ৫ অগাস্ট তারা দেড় দশকের প্রবল প্রতাপশালী শাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটায়।
‘জুলাই অভ্যুত্থান’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই আন্দোলনের সমাপ্তির দিনটিকে আন্দোলনকারীরা ৫ অগাস্ট না বলে ৩৬ জুলাই বলতে পছন্দ করেন।
এই আন্দোলনে বিএনপি, জামায়াতসহ তখনকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও অংশগ্রহণ ছিল। ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষও নেমে এসেছিল রাস্তায়।
এই আন্দোলন ঘিরে ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্টের মধ্যে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলী নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সে সময় ১,৪০০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির তিন দিন পর ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
দায়িত্বগ্রহণের পর ইউনূস সরকার জুলাই-অগাস্টের ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’, আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে ‘অনিয়ম-দুর্নীতির’ বিচারের পাশাপাশি সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
এই সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংলাপ করছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রথম দফা সংলাপের পর এখন তাদের শেষ পর্যায়ের আলোচনা চলছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ, মাঠের রাজনীতিতে নেই তার জোটসঙ্গীরা।
সংস্কার ও নির্বাচনের হিসাবনিকাশে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে তৈরি হয়েছে বৈরিতা।
অভ্যুত্থানের গর্ভের জন্ম নেওয়া নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ঘর গোছানোর পথে মাঝেমধ্যেই বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ আমলের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে বেঁধেছে গৃহবিবাদ। বাম রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও নানা বিষয়ে বিরোধিতা বজায় রেখেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যার বিচারের দাবি এবং সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে সামনের সারিতে এসেছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে নির্যাতন ও নিবর্তনের মুখে থাকা অনেকগুলো রাজনৈতিক দল।
নির্বাচন সামনে রেখে এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় সরকারের সঙ্গে আলোচনার শক্তি হিসেবে বিভিন্ন দলকে কাছে টানার চেষ্টা করছে বিএনপি ও জামায়াত। নির্বাচনের সময় ও সংস্কারের নানা বিষয়ে বিএনপির বিরোধ দেখা গেলেও সরকারের সঙ্গে জামায়াতের মতের মিলই প্রকাশ্য। এক্ষেত্রে জুলাই আন্দোলনের নেতাদের গঠিত এনসিপি আছে জামায়াতের সমান্তরালে।
বিএনপির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থানের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভোটকেন্দ্রিক জোট করার চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত। ইসলামপন্থি দলের ভোট যেন একই বাক্সে পড়ে, সেই পথে এগোনোর কথা বলেছেন দলগুলোর নেতারা।
মাঠে আওয়ামী লীগ না থাকার এই সময়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি জোটের সম্ভাবনা নেই, এনসিপির জন্য দরজা এখনও খোলা আছে।
“আমরা অতীতে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে জোট করেছি। কিন্তু এবার তাদের সঙ্গে জোট করার প্রয়োজনীয়তা মনে করছি না।”
তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীনের মতে, আপাত দৃষ্টিতে বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব দেখা গেলেও এমনটা ভোট পর্যন্ত থাকবে কি-না, সেটা বলতে সময় লাগবে। আওয়ামী লীগ ভোটে এলে এমন পরিস্থিতি নাও থাকতে পারে।
তিনি বলেন, “রাজনীতিতে কিন্তু শেষ বলে কোনো কথা নাই, শেষ মুহূর্তে কার সঙ্গে কে জোট করবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বাড়ছে, সেটা এখনই বলা কঠিন।
“এখন মনে হচ্ছে, জামায়াত এককভাবে ক্ষমতাগ্রহণে আগ্রহী হচ্ছে। সেখানে কখনো এনসিপিকে সঙ্গে নিচ্ছে, আবার এনসিপি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জামায়াতের উপর ভর করে আগাচ্ছে। আপাতত মনে হচ্ছে বিএনপি এবং জামায়াত দূরত্বে অবস্থান করছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভোটযুদ্ধে যদি আওয়ামী লীগ কোনোভাবে আসে, সেক্ষেত্রে তারা আলাদা জোটও করতে পারে, এটা আসলে অনেকগুলো যদি কিন্তু’র উপর নির্ভর করবে।”
আওয়ামী লীগের সামনে কী?
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মাঠছাড়া হয়ে যায় আওয়ামী লীগ; দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ অনেক নেতাকর্মী দেশ ছেড়েছেন, দেশে থাকা অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারান্তরীণ।
দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে দিল্লিতে অবস্থান করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসে লাইভে কথা বললেও এই সময়ের মধ্যে চেহারা দেখাননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব উপস্থিতির পাশাপাশি মাঝে মাঝে নেতাকর্মীদের ঝটিকা মিছিল চলার মধ্যে চলতি বছরের ১২ মে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে ওই নিষেধাজ্ঞার পর একই দিন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ মেনে দলটির নিবন্ধনও স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। এর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দলটিকে জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনও করে সরকার।
জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের দাবির মুখে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুরুতে দাবির পক্ষে কথা না বললেও নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তকে পরে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়ার আগে গত বছরের অক্টোবরে দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়।
এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অন্যান্য আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানে ‘হত্যাকাণ্ডে’ জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের।
‘ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক’ শাসন চালানোর অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে দেশজুড়ে থাকা স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনে কাজ করছে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির দিন ৫ অগাস্টে আগুনে পোড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডি-৩২ নম্বরের বাড়ি গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বুলডোজার দিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনার নানান ‘বিস্ফোরক’ বক্তব্যকে ওই বাড়িতে হামলার কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল সরকার।
আগামী বছরের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের যে আভাস সরকারের তরফে দেওয়া হয়েছে, তাতে আওয়ামী লীগের অংশ নিতে পারবে কি-না, সেটি নির্ভর করছে আদালতের সিদ্ধান্তের উপর। তবে, এর মধ্যে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগকে হিসাবের বাইরে রেখে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে মাঠে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
৭ জুলাই দুই হাজার তরুণের উপর চালানোর একটি জরিপের কথা তুলে ধরে সাউথ এশিয়ান মডেল নেটওয়ার্কিং অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগ ১৫ দশমিক ০২ শতাংশ ভোট পেতে পারে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টি বা রিফাইন আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো নতুন নামে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় কি না, তা এখনও বলার সময় আসেনি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব।
এমন প্রেক্ষাপটে বুধবার এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশ কর্মসূচি ঘিরে দিনভর দফায় দফায় হামলা-সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহর। পরিস্থিতি সামলাতে শেষ পর্যন্ত কারফিউ জারি করতে হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন। এনসিপির অভিযোগ, জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এই হামলা চালিয়েছে।
ক্ষমতায় থাকার সময়ের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা এবং আত্মবিশ্লেষণ না করে উল্টো হুমকি দিয়ে আওয়ামী লীগ তার কর্মী-সমর্থকদের ‘মৃত্যুর মুখে ঠেলে’ দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন।
রাজনীতিতে ফেরার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের যথাযথ উদ্যোগের অভাব দেখার কথা বলছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সব নেতার পলাতক বা গ্রেপ্তার থাকার কথা তুলে ধরে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “গত এক বছরের মধ্যে তারা কীভাবে রাজনীতিতে ফিরে আসবে, সে বিষয়ে নেতৃত্ব কোনো দিশা দেখাতে পারল না।
“এবং এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগের শাসনকালে নানা ধরনের অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি, নির্বাচনকে বিনষ্ট করা- এগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছিল। সেই তীব্র ক্ষোভেরই তো বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এক বছর আগে এবং সরকারের পতনও ঘটেছে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের নিজেদের সময়ে তারা জনগণের মনে যে আঘাত দিয়েছে, সেই বিষয়ে কিছুটা নরম হওয়া এবং নিজেদের আত্মবিশ্লেষণ করে জনসাধারণের কাছে উপস্থিত হওয়া- এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক কর্মকৌশল ছাড়াই তারা বলে যাচ্ছে, ‘আমরা ফিরে আসব এবং সকলকে দেখিয়ে দেব, আমরা ফিরে আসব এবং কেউ রক্ষা পাবে না, দেশ থেকে পালাতে পারবে না’।
“এই কথাগুলিও কিন্তু দেশের রাজনীতিতে অনেক উত্তেজনা তৈরি করছে এবং গোপালগঞ্জের মত পরিস্থিতির পেছনে যে এরও ভূমিকা নাই, তা বলা যাবে না।”
মোজাম্মেল হোসেন বলেন, কাজেই আওয়ামী লীগকে প্রথমত তাদের নিজেদের কৃতকর্ম সম্পর্কে এবং কেন তারা জনসাধারণের এরকম রোষের মুখে, বিক্ষোভের মুখে উৎখাত হয়ে গেল সেটা বিশ্লেষণ করা দরকার। একটা আত্মবিশ্লেষণ, আরেকটা তাদের অনুশোচনা থাকলে সেটা ঠিক করা দরকার এবং জনগণের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য তার রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করা দরকার।
“এই রাজনৈতিক কৌশল ও নেতৃত্ব ঠিক না করে নেতারা পলাতক থাকবেন, আর দেশের ভেতরের তরুণ কর্মী-সমর্থকদের এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন। এটাও কাম্য নয়।”
তৃণমূল ‘বেপরোয়া’, রাষ্ট্রক্ষমতায় চোখ বিএনপির
রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ না থাকায় বিএনপির চোখ এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, যে কারণে শেখ হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনের বড় এই অংশীজন চায়, যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন আদায় করে নিতে। রাষ্ট্র সংস্কার ও জুলাই আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা ধরে রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন দ্রুত দিতে চাপও বজায় রাখতে চাইছে বিএনপি।
সংস্কার প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে কাজের পাশাপাশি বিএনপি ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য মাঠের শক্তিও কয়েকবার দেখিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের দাবি উঠলেও বিএনপি তাতে সায় দেয়নি।
২০২৬ সালের প্রথমার্ধে, অর্থাৎ জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের কথা বলে আসছিল অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকারপ্রধান ইউনূসসহ উপদেষ্টাদের নানা বক্তব্যে আশ্বস্ত না হয়ে নির্বাচনের পথনকশা (রোডম্যাপ) চাওয়ার পাশাপাশি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটের দাবি জানিয়েছিল বিএনপি।
ভোটের তারিখ নিয়ে বিরোধের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী অবস্থান প্রকাশ করে আসছিল বিএনপি; মাঠের শক্তিও দেখাচ্ছিল বিভিন্নভাবে।
এর মধ্যে কোরবানি ঈদের আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনে সময় কিছুটা এগিয়ে এনে আগামী বছরের এপ্রিলে করার ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টা।
জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল তার এই বক্তব্যকে স্বাগত জানালেও বিএনপি আগের অবস্থানেই অনড় থাকে। অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চায় তারা। আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে রোজার মধ্যে নির্বাচনি প্রচার এবং পরে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাকে এপ্রিলে নির্বাচন হওয়ার পথে বাধা বলে তুলে ধরেন দলটির নেতারা। এরপর ১৩ জুন লন্ডনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের সময় নিয়ে দুইপক্ষের ছাড় দেওয়ার আভাস পাওয়া যায়।
ওই বৈঠকের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রোজার আগে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়।
সে ঘোষণায় বলা হয়, সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
রাজনৈতিক উত্তেজনার নিরসনের জন্য ওই বৈঠককে স্বাগত জানালেও কেবল একটি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ভোটের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার সমালোচনা করে জামায়াত ও এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ভোটের দিকে চোখ রেখে কার্যক্রম চালালেও তৃণমূলে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে দেখা গেছে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনকে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, ২০২৪ সালের অগাস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতে অন্তত ৭৩ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
আসকের সর্বশেষ হিসাবে, জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে রাজনৈতিক সংঘাতে ৬৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এই সময়ে আহত হয়েছেন দুই হাজার ৭৭০ জন। আর সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ২৭০টি। এর মধ্যে বিএনপি, তার সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে সংঘাত হিসাব করলে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন।
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর থেকে সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের তিন হাজার ২০০ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে বিএনপির এক হাজার ৮০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে দলটি। এদের ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, কমপক্ষে ৭০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিস, ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিস দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, জুন পর্যন্ত ছাত্রদল এখন পর্যন্ত ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ছয় শতাধিক নেতা-কর্মীকে কারণ দর্শানো নোটিস দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের কমপক্ষে ১০০ জনকে বহিষ্কার ও ১৫০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিস দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যুবদলের শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে যুবদলের লালচাঁদ ওরফে সোহাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়।
ব্যবসায়িক বিরোধ ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সোহাগকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের তরফে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় বিএনপির তিন সংগঠনের ৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
নিষিদ্ধ থেকে অগ্রভাগে জামায়াত
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ব্যাপক বলপ্রয়োগ করে তা দমাতে না পারার মধ্যে ১ অগাস্ট জামায়াতে ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দেওয়া ওই নিষেধাজ্ঞার তেমন প্রভাব আন্দোলনে পড়তে দেখা যায়নি, উল্টো আন্দোলন তীব্রতর হলে পাঁচ দিনের মাথায় বিদায় নিতে হয় শেখ হাসিনার সরকারকে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর সেনা সদরে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর যে বৈঠক হয়, ‘নিষিদ্ধ’ থাকাবস্থায়ই সেই বৈঠকে যোগ দেন জামায়াত আমির শফিকুর রহমান।
সেনাসদরের বৈঠকে কারা উপস্থিত ছিল, ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাওয়া হয়েছিল সেনাপ্রধানের কাছে; উত্তরে শুরুতেই জামায়াত আমিরের কথা বলেছিলেন জেনারেল ওয়াকার।
এরপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার মধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গনে সামনের কাতারে চলে আসে জামায়াত; ৮ অগাস্ট ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও জোরালো অংশগ্রহণ ছিল দলটির। তার ২০ দিনের মাথায় ২৮ অগাস্ট জামায়াতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।
নিষেধাজ্ঞা ওঠার ধারাবাহিকতায় আদালতে আপিলের রায়ে ১২ বছর পর নিবন্ধন ফিরে পায় জামায়াত, ইতোমধ্যে ফেরত পেয়েছে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকও। ২০১৩ সালে হাই কোর্টের এক রায়ে নিবন্ধন হারিয়েছিল দলটি।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ যখন অনিশ্চিত, তখন আগামী নির্বাচনে ভোটের হিসাব-নিকাশের কারণে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে চলে গেছে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াত। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দুটি নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হত, তারা এখন একে অপরের কড়া সমালোচক।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও নির্লিপ্ততার মধ্যে চাঁদাবাজি ও খুন-খারাবির জন্য বিএনপিকে অভিযুক্ত করে আসছে জামায়াত। অন্যদিকে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও ধর্ষণে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের যেসব বক্তব্য, সেই রকম বক্তব্য এখন জোরেশোরেই আসছে বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে।
বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এই বিরোধিতাকে স্বাভাবিক হিসেবে তুলে ধরে এক প্রশ্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাহবুব বলেন, “রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটা নিয়মমাফিক হওয়া উচিত।
“এখন সব সময় যে সবার সাথে সবার বন্ধুত্ব থাকবে, তা নিশ্চিত নয়। বন্ধুত্ব নষ্ট হতেও পারে, রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে। তারা তো একটা দল, একেকটা স্বার্থেই ঐক্যবদ্ধ হয়। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ম মাফিক থাকবে, এটা আমি আশা করি।”
ঘর গুছাচ্ছে এনসিপি, বিতর্কও পিছু ছাড়ছে না
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা নতুন দল এনসিপি গঠন করে দল গুছানোর ব্যস্ত সময় পার করছে।
দলকে সংগঠিত করার অংশ হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থানের বার্ষিকী উপলক্ষে মাসব্যাপী ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছেন সংগঠকরা।
১ জুলাই রংপুরের পীরগঞ্জে জুলাই আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের এই পদযাত্রা কর্মসূচি। দলটির নেতারা ১৫ জুলাই পর্যন্ত পদযাত্রা নিয়ে গেছেন ৩১ জেলায়।
শেখ হাসিনার সরকার পতন আন্দোলনের মিত্র বিএনপির সঙ্গে এখন দূরত্বই দেখা যাচ্ছে এনসিপির। বিভিন্ন বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে তাদের মতের মিল দেখা গেলেও বিএনপির সঙ্গে তাদের বাহাস প্রতিনিয়তই হচ্ছে। অভ্যুত্থানের পরপর জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংগঠিত হওয়ার পর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পদ ছেড়ে দলের হাল ধরেছেন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম; দলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে তার সঙ্গী জুলাই আন্দোলনের আরেক নেতা আখতার হোসেন।
আত্মপ্রকাশের দিনে ঘোষণাপত্র এনসিপি বলেছে, “আমরা মনে করি জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদেরকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে।
“আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।”
এরপর খসড়া গঠনতন্ত্রে এনসিপি বলেছে, ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪—এই তিন ঐতিহাসিক ঘটনার সমন্বয়ে একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বনির্ভর রাষ্ট্র গঠন করতে চায় তারা।
তাদের লক্ষ্য দেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি তারুণ্যনির্ভর বিকেন্দ্রীভূত গভর্ন্যান্সের (শাসন) মাধ্যমে তারা একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার কথাও বলা হচ্ছে।
ভোটের মাঠে লড়তে দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য ২২ জুন নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে এনসিপি তাদের দলীয় প্রতীক হিসাবে ‘শাপলা’ চেয়েছে। এর সঙ্গে বিকল্প হিসেবে ‘কলম’ এবং ‘মোবাইল ফোন’-ও চেয়েছে দলটি।
তবে শাপলা ও দোয়েল বাদ রেখে প্রতীক তালিকা প্রকাশ করেছে ইসি। এনসিপির দুই বিকল্প ‘কলম’ ও ‘মোবাইল ফোন’ প্রতীক হিসেবে চেয়ে আগেই আবেদন করার কথা বলছে বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি (বাজপ) ও জনস্বার্থে বাংলাদেশ।
নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে এনসিপিকে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও দেয়নি ইসি। এনসিপিসহ নতুন যেসব দল নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছে, তাদের কাগজপত্রের ছোটোখাটো ত্রুটি সংশোধনে মঙ্গলবার ১৫ দিন সময় দিয়েছে ইসি।
‘নতুন বন্দোবস্তের’ যে আশা এনসিপি দেখাচ্ছে, সে অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক মাহবুব বলেছেন, “নতুন দলটাকেতো এখনই আর মূল্যায়ন করা যাবে না, সময় লাগবে। কিন্তু তারপরও যে সকল বিষয় আছে, তারা যদি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চা করতে পারে পুরাতন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীতে এবং কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি বন্ধ করতে পারে, তারা যদি সন্ত্রাসী কাজে যুক্ত না হয়, দুর্নীতিতে যুক্ত না হয়, তাদের নতুন বন্দোবস্ত মানুষ বিশ্বাস করবে।
“নতুন বন্দোবস্ত মানে একটা জবাবদিহিমূলক শাসন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা। এসসিপি যদি এই কাজগুলোতে মনোযোগ দিতে পারে এবং জনগণকে সাথে কাজ করতে পারে, তাহলেই নতুন বন্দোবস্ত তারা যেটা অঙ্গীকার করতেছে, যেটা প্রকাশ করতেছে সেটা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি পাবে।”
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলার করে আগুন দেয় এক দল লোক।
আওয়ামী লীগ শরিকরা মাঠচ্যুত, কোণঠাসা জাপায় গৃহবিবাদ
৫ অগাস্টের পর থেকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ অভিধায় রোষে মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগের শরিক ১৪ দলীয় জোটের রাজনৈতিক দলগুলো।
এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
জাতীয় পার্টিও বিপদে পড়েছে। আওয়ামী লীগের মত দলটিকেও নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে অভ্যুত্থানের শরিক কোনো কোনো অংশ।
দলীয় অনুষ্ঠান করতে গিয়ে বার বার বাধার মুখে পড়ে জাতীয় পার্টি। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপেও তাদের ডাকা হয়নি। সব মিলিয়ে রাজনীতিতে একঘরে হয়ে পড়ে জিএম কাদের নেতৃত্বাধীন এ দল।
আওয়ামী লীগের অধীনে তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় পার্টি অংশ নেয় এবং প্রধান বিরোধী দল হয়। এর মধ্য দিয়ে দলটি সংসদের ‘গৃহপালিত’ প্রধান বিরোধী দলের তকমা পায়।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ভিন্ন বাস্তবতায় ভাঙনের মুখে থাকা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং ‘বিদ্রোহী’ নেতাদের দুই পক্ষই দলকে নিজেদের কব্জায় রাখার মরিয়া চেষ্টায় নেমেছেন।
পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের হাঁটছেন অবাধ্যদের ছেঁটে ফেলার পথে। দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মজিবুর রহমান চুন্নুকে ইতোমধ্যে তিনি সব পদ পদবি থেকে ‘অব্যাহতি’ দিয়েছেন।
তাতে সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন অবধারিত হয়ে উঠলেও তার ছোট ভাই জি এম কাদের বহিষ্কারকেই ‘হাতিয়ার’ করেছেন।
ভেতরের খবর হল, জ্যেষ্ঠ নেতাদের তালিকা করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ‘বিদ্রোহীদের’ সঙ্গে ভিড়লে তাদেরও বহিষ্কার হতে হবে।
অন্যদিকে আনিসুল ইসলাম মাহমুদরা নিয়েছেন ভিন্ন কৌশল। তারা মুখে বলছেন, জাতীয় পার্টি আবার ভাঙুক তারা তা চান না। এতদিনের পার্টি তারা ছাড়বেন না। আর ভেতরে ভেতরে তারা সারা দেশের নেতা-কর্মীদের পক্ষে টেনে পার্টি ফোরামে অভ্যুত্থান ঘটাতে চাইছেন।
ঠিকানা/এসআর