গণভবন ফ্যাক্টর শেষ কবেই। দেশের বর্তমান সিগন্যাল উত্তর-দক্ষিণে নয়। যমুনা-বঙ্গভবনেও নয়। যেখানে ক্ষমতার লক্ষীন্দর, সেখানেই যাবতীয় যোগাযোগ-সংযোগ রেখে চলছেন রাজনীতির চালাক-চতুররা। কেউ দলেবলে, কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে। দেশে
দেশে যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের কোনো দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচনের ভালো-মন্দ প্রতিক্রিয়া দিতে মানা করা হলেও বাংলাদেশে ব্যতিক্রম।
ঢাকার রাজনীতিকেরা ছুটছেন মার্কিন দূতাবাসের ছোট-মাঝারি কর্মকর্তাদের পেছনেও। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন তো শিডিউলই দিতে পারছেন না। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা কখনো দলীয়, কখনো ব্যক্তিগতভাবে বসছেন তার সঙ্গে। স্বয়ং প্রধান বিচারপতিও। আলামত, বর্তমান-ভবিষ্যৎসহ নেপথ্য নানা গোমরের আলোকেই তাদের এ মতিগতি। ব্যবসায়ীসহ পেশাজীবী প্রতিনিধিরাও সুযোগ হাতছাড়া করছেন না।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের গ্যারান্টির পরও বিভিন্ন দল ও নেতাদের এ মার্কিন চক্করের ফের সংশ্লিষ্টদের বেশ জানা। ঐকমত্য, সংস্কার, বিচার, নির্বাচনপদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে বাগড়ার রহস্যও পুরোপরি গোপন থাকছে না। নির্বাচন বানচাল, পেছানো বা নির্বাচন হলেও শেষ দিকে নাটকীয়ভাবে বয়কটের গোপন অ্যাজেন্ডা রয়েছে কয়েকটি দলের। জামায়াত-এনসিপিসহ কয়েকটি দলের এ-সংক্রান্ত ব্যাপক হোমওয়ার্ক শেষ প্রায়। এসব গোমর মাড়িয়ে বিএনপি ক্ষমতায় চলে গেলে এক বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে না দেওয়ার সøটও প্রস্তুত করা আছে তাদের।
জামায়াতে ইসলামী এরই মধ্যে সমাজের ভেতর আরেকটি সমাজ বানিয়ে ফেলেছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তারা কয়েকটি জরিপ ছড়িয়ে রাজনীতির ময়দানে আচ্ছা রকমের বিভ্রান্তি ছড়াতে সক্ষম হয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনও পার্পাসিভ সার্ভে বাজারজাত করেছে। সংশ্লিষ্টরা যা আশা করেন বা যে ধরনের ফলাফল দেখতে চান, সেদিকে লক্ষ রেখে জরিপের নকশা করা গত বছর কয়েক ধরে দেশে দেশে বেশ প্রচলিত। বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক-ব্রেইন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৩১ দশমিক ৫৬ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করে। সুজনের জরিপে বলা হয়েছে, দেশে ৭১ শতাংশ মানুষ সংসদের উচ্চকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে (পিআর) আসনবণ্টনকে সমর্থন করে। সুজনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ঐকমত্য কমিশনের সদস্য। এই কমিশন নিজেরাই পিআর পদ্ধতির পক্ষে। শুধু পিআর পদ্ধতি নয়, ঐকমত্য কমিশনের প্রায় সব কটি প্রস্তাবের সঙ্গেই জরিপের উত্তরদাতারা কমবেশি একমত পোষণ করেছেন। এসব প্রস্তাবে সমর্থন জোগাড় করছে নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। সোশ্যাল মিডিয়া এমনকি মূলধারার কোনো কোনো মিডিয়া এসব জরিপ লুফে নিচ্ছে। এতে এগুলোর রিচ-ভাইরাল ব্যাপক। এর মাঝেই আবার রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে নতুন এপিসোড। বিদেশি দূতাবাস-কমিশন থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি নামিয়ে ফেলার ঘটনাও এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ এ প্রতিনিধিকে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে জনগণের একটা বড় অংশ। আইনি পথে সেই সুযোগ না থাকলেও চাপ সৃষ্টি করে সরানোর সুযোগ আছে। উদাহরণও আছে। কিন্তু তা না করে তাকে ঘিরে একটি নাটকীয়তা তৈরির গেমটি আপাতত সফল।
নানা দিকে ভজঘট পাকানোই এসবের মূল উদ্দেশ্য। বিএনপির সালাহউদ্দিন, মির্জা আব্বাস, মির্জা ফখরুল শেষ করে আরও বড় জায়গা তারেক রহমানকে কটাক্ষ করে বলা হয়েছে, জনগণের পালস ধরতে না পারলে অনলাইনে পড়ে থাকতে হবে, বিদেশে পড়ে থাকতে হবে। ড. ইউনূস লন্ডনে সিজদা করে ওহি নিয়ে এসেছেন-এমন মন্তব্যেও ছাড় দেওয়া হয়নি। সেনাবাহিনীকে ঘিলুতে বুদ্ধি রাখার পরামর্শমূলক টিপ্পনীও বাদ যায়নি। এসবের নেপথ্যে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড়দের এসেসমেন্ট বেশ জোরদার। গত বছরের টিমে বিদেশি পাসপোর্টধারী খেলোয়াড় ছিল না, এত আঞ্চলিক ইস্যুও ছিল না। এবার চোখের সামনে নতুন টিমে একের পর এক বিদেশি খেলোয়াড় আনায় কিছুদিন বিএনপি শরিক থাকলেও এখন ঝিমুনিতে পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে কোনো ব্যক্তি দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না, কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন না, সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট-জুলাই সনদের এসব তিতা সুপারিশ বিএনপিকে গিলতে হচ্ছে। শহীদের রক্তের বদলা ও শেখ হাসিনার ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন নয়-জামায়াত নেতাদের এমন বিপ্লবী কথায় দ্বিমত জানাতে পারছে না বিএনপি। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের গ্যারান্টি দেওয়ার পরও সংস্কার ও বিচার শেষ না করে নির্বাচন হলে আগের পরিস্থিতি ফিরে আসবে-প্রধান উপদেষ্টার এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়াও দিতে পারছে না। এনসিপির নতুন করে আগে গণপরিষদ-নতুন সংবিধান, পরে নির্বাচনের দাবি জোরদার করার পেছনেও বেশ রহস্য। এর মাঝে প্রেস সচিব জানিয়ে দিয়েছেন, এ পর্যন্ত সংস্কার কমিশনের ৩৬৭ সুপারিশের মধ্যে ৩৭টি বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। এ ধরনের আয়োজনে বিএনপি বহু ক্ষেত্রে ধোঁয়াশায় পড়ে যাচ্ছে। বলতে বা প্রশ্ন করতেও পারছে না। আবার হালও ছাড়ছে না। গোমর আছে তাদের হাতেও। তথ্যের দিক থেকে অন্যদের চেয়ে পিছিয়েও নয়। দেশের নিকটবর্তী মিয়ানমারকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের গুছিয়ে আনা পদক্ষেপের দিকে সতর্ক নজর বিএনপির।
যুক্তরাষ্ট্র প্রণীত বার্মা অ্যাক্ট, মিয়ানমারের পরিস্থিতি, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন গ্রুপের তৎপরতা এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য প্রভাব তাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে। জটিল এ বাস্তবতাকে কেবল দলীয় দ্বন্দ্ব বা ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটেও দেখতে হচ্ছে। গোটা দক্ষিণ এশিয়াই এক অনিবার্য ঝুঁকির দিকে এগোচ্ছে। এর কেন্দ্রবিন্দু বা এপিসেন্টার হচ্ছে বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চল। সীমান্তবর্তী এই অঞ্চল সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, বঙ্গোপসাগরে সামরিক শক্তির উপস্থিতি-সবকিছু মিলে এই অঞ্চলকে ঝুঁকির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিতে। বার্মা অ্যাক্ট বাংলাদেশের জন্য সুযোগ আনবে, না বিপদ হবে-এখনো তা ঝাঁপসা। হয় বাংলাদেশ বার্মা অ্যাক্টকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাবে, নয়তো ছারখার হবে। এ দুয়ের মাঝামাঝি কোনো অবস্থা নেই। এরই মধ্যে নতুন করে বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় রাখাইন সীমান্তে আরও প্রায় অর্ধলাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের রাখাইনে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় তাদের এ অবস্থান। সীমান্তে সশস্ত্র আরাকান আর্মির ঘোরাফেরার তথ্যও বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর। মিয়ানমারে বাংলাদেশের আগেই আগামী ২৮ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশন।
মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের দুই সপ্তাহ পর এ ঘোষণা এল। ধাপে ধাপে আয়োজিত নির্বাচনে অংশ নিতে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিসহ ৬০টি দল নিবন্ধন করেছে। এর মধ্যে ৯টি দল সারা দেশে প্রার্থী দেবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম। ২৮ ডিসেম্বরের পরের ধাপগুলোর ভোট কবে হবে, তা এখনো জানানো হয়নি। ২৮ ডিসেম্বরের এ নির্বাচনই হবে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রথম গণতান্ত্রিক ভোটের কার্যক্রম। এর আগে নির্বাচনের পরিকল্পনা করা হলেও সামরিক সরকারের অনাগ্রহে তা বারবার পিছিয়েছে। এখন আর নির্বাচনে আগের মতো গরজ নেই দলগুলোর। রাখাইন রাজ্যে ভোট ঠেকানোর হুমকি দিয়ে রেখেছে আরাকান আর্মি। সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, নির্বাচনে বাধাদানকারীদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। নির্বাচন সামনে রেখে পাশের দেশের এ বাতাস বাংলাদেশের জন্য প্রতিবেশী হিসেবে সুখকর নয়।



ঠিকানা রিপোর্ট


