রাজনৈতিক অঙ্গনে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায় হওয়ার বিষয়ে বিএনপি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসীও। একইভাবে আওয়ামী লীগও দলীয় প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে ভোট অনুষ্ঠান করতে পারবে বলে খুবই আত্মবিশ্বাসী। দুটি দলই মনে করছে তারা সফল হবে, ফলে যে যার মতো কৌশল করে মাঠে অবস্থান করছে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার বড় ধরনের কর্মসূচির পর গত এক বছর ধরে চলা রাজনৈতিক পরিবেশই পাল্টে গেছে। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পরদিন ২৯ অক্টোবর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। এরপর বিএনপি ও রাজপথে থাকা আরেক আলোচিত দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রথম দফায় ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। দুই দিন বিরতি দিয়ে ফের ৫ ও ৬ নভেম্বর অবরোধ কর্মসূচি পালন করে দলটি। দুই দফায় পাঁচ দিনের অবরোধ শেষে ৬ নভেম্বর সোমবার আবারও সারা দেশে দুই দিনের সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ৮ নভেম্বর বুধবার ভোর ছয়টা থেকে শুরু হয়ে ১০ নভেম্বর শুক্রবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ চলবে। বিএনপির পাশাপাশি গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপিসহ অন্যান্য দল ও জোটও যুগপৎভাবে একই কর্মসূচি ঘোষণা করে। জামায়াতে ইসলামীও পৃথকভাবে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ দিয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, তফসিল ঘোষণার তারিখ জানার চেষ্টা করছেন তারা। সে অনুযায়ীই কর্মসূচি আসবে। যেদিন তফসিল ঘোষণা করা হবে, তার আগের কয়েক দিন দলের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে তৃণমূলেরও মতামত নেওয়া হয়েছে। তারাও আরও কঠোর কর্মসূচি চান। দেশব্যাপী একই সঙ্গে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচির প্রস্তাব রয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এদিকে এক দফা দাবি আদায়ে চূড়ান্ত ধাপের চলমান আন্দোলনের মধ্যেই দেশজুড়ে ধরপাকড় আর মামলায় জর্জরিত বিএনপির নেতাকর্মীরা। প্রতিদিনই দলটির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতাকর্মী আটক হচ্ছেন। তা ছাড়া নির্বাচন ঘিরে বিএনপিকে ভাঙতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নানামুখী তৎপরতা চালানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নেতাকর্মীরা। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো নেতাকে টাকা-পয়সা বা নির্বাচনে জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভনসহ নানা ধরনের সুবিধার কথা বলা হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। তবে দলের মধ্যে ভাঙনের ষড়যন্ত্র ও পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তিত নয় বলে জানিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বরং তাদের এক দফা দাবি আদায়ে চূড়ান্ত আন্দোলন নিয়েই তারা এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মোট মামলা হয়েছে সোয়া শর বেশি এবং একজন সাংবাদিকসহ মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। এর মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বিলকিস আক্তার জাহান শিরীন, কেন্দ্রীয় নেতা জহির উদ্দিন স্বপনসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও বেশ কয়েকজন নেতার বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। তৃণমূলের অবস্থাও একই।
একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই এখন বাসায় ঘুমাতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে ‘ডু অর ডাই’ মনোভাব নিয়েই আন্দোলন করছেন তারা। তাই কঠোর আন্দোলন থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দৃঢ় মনোবল রয়েছে। তারা গ্রেপ্তার হলে মাঠে থেকেই হতে চান। নেতারা আরও জানান, তফসিলের আগেই দাবি আদায় করতে চান তারা। এ নিয়ে তৃণমূলের কাছ থেকে চাপ রয়েছে। কারণ তাদের ধারণা, তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। তখন দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন টেনে নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। তাই যা করার তফসিলের আগেই করতে হবে। সে প্রস্তুতি তাদের রয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপিকে আর বের হতে দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। বিএনপির নেতাদের একটি অংশ কারাগারে, আরেকটি অংশ আত্মগোপনে। দলটিকে এ অবস্থায় রেখেই নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, আওয়ামী লীগের এই নীতির সমালোচনা হলেও তাতে তারা কান দেবেন না। এমনকি বিদেশি কারও চেষ্টা, চাপ কিংবা অনুরোধও আমলে নেবেন না। বিএনপিকে এ অবস্থায় রেখেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি অনেকটাই সন্ধ্যায় কিছু যানবাহন পোড়ানোতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিএনপির ‘সক্ষমতা’ আরও কমে যাবে। তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল ভোটের প্রস্তুতি শুরু করলে অবরোধের কোনো প্রভাব থাকবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে প্রস্তুতি এবং সরকারের প্রতি তাদের যে আনুগত্য, তাতে নির্বাচনের দিনও বড় কোনো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কম। ক্ষমতাসীন দলের সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্বাচন আটকে দেওয়ার জন্য দেশের ভেতর থেকে যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও চাপ থাকার কথা, তা দেখছে না আওয়ামী লীগ। ফলে ভোট অনুষ্ঠান নিয়ে এখন বাড়তি কোনো ঝুঁকি অনুভব করছেন না ক্ষমতাসীনেরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজপথে দুই পক্ষ মুখোমুখি হলে তা দেশের জন্য শুভ হবে না। বিরোধী দলের কর্মসূচি চলাকালে ধরপাকড় হয়, সহিংসতা হয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে অজানা আতঙ্ক দেখা দেয়। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা একে অপরকে দোষী দাবি করে বক্তৃতা করছেন। রাজনীতিকদের বাইরেও সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে মনে করেন না। পরিস্থিতির উন্নয়নে আলাপ-আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করার পরামর্শ এলেও নিজ নিজ অবস্থানে অনড় উভয় পক্ষ। শেষ পর্যন্ত সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সংকটে পড়বে দেশ, এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন বিশ্লেষকেরা।