এবিএম সালেহ উদ্দীন
পৃথিবী এক বিষাদময় সময় পার করছে। মানুষ মানুষের প্রতি এতটা নির্দয় ও পাশবিক (!) হয়ে ওঠার বীভৎস চিত্র পৃথিবী কি আর কখনো দেখেছে?
মানবসভ্যতার আগে ও পড়ে মানববিধ্বংসে মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার জন্য এমন মারণাস্ত্রের ব্যবহার খুব বেশি হয়নি। জার্মানির হিটলার কিংবা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার ভয়ংকর মারণাস্ত্র প্রয়োগকারী আণবিক বোমার পর ইসরায়েলি শাসকদের মতো এমন নির্দয়, পাশবিক ও হিংস্র হত্যাযজ্ঞের ঘটনা খুব একটা বেশি পাওয়া যাবে না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা কিংবা পরাজিত করার জন্য যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু ইসরায়েলের বেলায় সেটি নয়। সে শুধু মারতেই পারে; গড়তে পারে না, ধ্বংস ঘটিয়ে যায়। অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে বছরের পর বছর অবরুদ্ধ রেখে নির্দয় ও নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি হন্তারক শাসক আবারও প্রমাণ করল, ‘জোর যার মুল্লুক তার।’ হিংস্র শাসক ও আগ্রাসী ইসরায়েল কোনো মানবিকতার ধার ধারে না। তার ভেতর মানবিকতার সুস্থ বিবেকবোধ নেই।
বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজায় শতাব্দীর বর্বরতম নির্মম মানববিধ্বংসী আগ্রাসন চলছে। নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার উগ্র-উন্মাদনায় আগ্রাসী ইসরায়েল নৃশংস গণহত্যার অবতারণা ঘটিয়েছে। চলমান পৃথিবীতে ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনকে পুরোপুরি দখল করার ঘৃণ্য প্রয়াসে চরম পাশবিকতা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত সংখ্যার ঠিকানায় মানববিধ্বংসী শাসক হিটলারের নৃশংসতার কিছু বিষয় উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে ইসরায়েলি শাসক নেতানিয়াহুর যুদ্ধংদেহী মানববিধ্বংসী কার্যক্রম আরও নির্মম, আরও ভয়ংকর! এ ধরনের হিংস্র শাসকের নজির পৃথিবীতে বেশি নেই।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসন, গণহত্যা এবং অমানবিক হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবি ও নিন্দায় সমগ্র পৃথিবী উত্তাল, বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, জার্মানিসহ সমগ্র পৃথিবীতে যুদ্ধ বন্ধের দাবি উঠছে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অমানবিক আগ্রাসন ও একতরফা যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠছে। সর্বত্র লক্ষকোটি মানুষের বিক্ষোভ মিছিল ও গগনবিদারী স্লোগানে ইসরায়েলের আগ্রাসী যুদ্ধ বন্ধ করার জোর দাবি জানানো হচ্ছে। বিশ্বের সকল দেশ ও রাষ্ট্র, এমনকি খোদ ইসরায়েলেও যুদ্ধবিরোধী মিছিল হচ্ছে। ইসরায়েলের শান্তিকামী জনগণ সে দেশের হন্তারক প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করছেন। সবার দাবি একটাই : ‘এখনই যুদ্ধ বন্ধ করো। আমরা আর কোনো যুদ্ধ দেখতে চাই না। শান্তি চাই।’
ইসরায়েলের অমানবিক হামলা থেকে শরণার্থী শিবির, হাসপাতাল, সেবাকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, গির্জা, উপাসনালয় কোনো কিছুই বাদ পড়ছে না। যেখানে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে, সেখানেই মারণাস্ত্রবিশিষ্ট বোমা হামলা চালানো হচ্ছে। যদিও জাতিসংঘসহ সকল দেশ ও প্রতিষ্ঠান ফিলিস্তিনের জনগোষ্ঠীকে নির্মূল অভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছে। সবার অভিমত, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার অসহায় নারী-শিশুসহ গণমানুষের সকল আশ্রয়স্থল, এমনকি হাসপাতালগুলোতে বর্বরোচিত ইসরায়েলি হামলা অবশ্যই অমানবিক এবং অবশ্যই যুদ্ধাপরাধের মধ্যে গণ্য হবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ‘গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনা যুদ্ধাপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারে।’ জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স হ্যান্ডলে দেওয়া এক পোস্টে এসব কথা বলা হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে গত ৩১ অক্টোবর মঙ্গলবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। এরপর ১ নভেম্বর বুধবার সেখানে দ্বিতীয়বারের মতো বোমা হামলা চালানো হয়েছে। যেখানে শত শত লোকের প্রাণহানি ঘটেছে।
ইতিমধ্যেই আল-জাজিরা সংবাদমাধ্যম থেকে আরও জানানো হয়, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৬ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং অব্যাহত বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজার ২২ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ১০৪ জন শিশু এবং ২ হাজার ৬৪১ জন নারী। গাজা উপত্যকায় হামলায় ইতিমধ্যে আহত হয়েছেন ২৫ হাজার ৪০৮ জন ফিলিস্তিনি।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ওই হামলায় ইসরায়েলের ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ মারা যান। সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার বোমাবর্ষণ ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। ভয়ংকর বোমা হামলা এবং একই সঙ্গে উপত্যকাজুড়ে স্থল অভিযানও চালানো হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনের আর কোনো নিরাপত্তা থাকল না।
সহস্র বছরের ফিলিস্তিনের গাজা শহরটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার নেশায় নিরীহ মানুষের ওপর বোমা হামলা ও ভয়ংকর মারণাস্ত্র প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে গাজার ১৫ লাখ বাসিন্দা তাদের বাসস্থান হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, বিদ্যুৎ, ফুয়েল, খাদ্যাভাব ও তীব্র পানির সংকটে মহাবিপর্যয়ের মধ্যে অসহায় মানুষের আর্তনাদ। খাদ্য ও বস্ত্রের অভাবে প্রচণ্ড শীত এবং বৃষ্টিতে দুঃখ-কষ্ট ও বিভীষিকাময় বিষাদভরা আর্তনাদ তাদের! আহতদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ইসরায়েলের আগ্রাসন এবং ফুয়েলের অভাবে সকল হাসপাতাল বন্ধপ্রায়। ইসরায়েল কর্তৃক সকল চেকপোস্ট ও বর্ডার বন্ধ করে দেওয়ার ফলে কোনো ত্রাণসামগ্রী আসতে পারছে না। শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম চরম বিভীষিকাময় পরিস্থিতি!
নারী-শিশুসহ লাখ লাখ ফিলিস্তিনি নাগরিক নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে মানবেতর দিন যাপন করছে। সভ্যতার এ কোন পরিণতি? সভ্যতার উষালগ্ন থেকে যেমন মানবতার যাত্রা শুরু, তেমনি মানববিধ্বংসের বহুবিধ পাশবিকতার বীভৎস বহুবিধ চিত্রের কলঙ্কজনক ইতিহাসেরও ক্রমাগত পরিবৃদ্ধি ঘটে চলেছে।
মানবধ্বংসের উন্মত্ত উন্মাদনার এক বর্বরতম চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণে বর্তমান পৃথিবী। বিগত দিনের মহাপ্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মরণঘাতী করোনাভাইরাসের মধ্যেও পৃথিবীর নানা প্রান্তে পাশবিকভাবে মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতা দেখেছি। তবে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিষ্ঠুরতম কার্যক্রমে ইসরায়েল নামক দেশটি বর্তমানে ফিলিস্তিনের জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য যেভাবে মানববিধ্বংসের ভয়ংকর পাশবিকতা চালিয়ে যাচ্ছে (!), তার নজির বেশি পাওয়া যাবে না।
সবাই জানেন, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে পাশবিক ও নিষ্ঠুরতম রাষ্ট্র ইসরায়েল। ইতিহাস সাক্ষী, আজ থেকে ৭৫ বছর আগে পৃথিবীর নানা প্রান্তের গণধিক্কৃত ইহুদি যুদ্ধবাজদের জড়ো করে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ মিলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনতম ইতিহাসের ঐতিহ্যগাথা ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের এক প্রান্ত ঘিরে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রটির উদ্ভব ঘটানো হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের পর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে খুব একটা সমস্যা না থাকলেও আস্তে আস্তে ইসরায়েলি শাসকদের প্রকৃত মুখোশ উন্মোচিত হতে থাকে। যার ফলে ৭৫ বছর যাবৎ ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। কেউ জানে না, এই অমানবিক আগ্রাসন ও নিষ্ঠুরতম মানববিধ্বংসী যুদ্ধের শেষ কোথায় এবং কখন হবে এর অবসান।
সত্যি পৃথিবী এক বিষাদময় সময় পার করছে। তাই তো বলি, ‘মানুষগুলো মানুষ নেই। উগ্রতার উন্মত্ত নেশায় সে অনেক বেপরোয়া! ধ্বংসের উন্মাদনায় সে যেভাবে হিংস্র হয়ে উঠেছে! কিছুতেই তাকে থামানো যায় না। কোনো দাবানল কিংবা বৃষ্টিপতনেও নয়। কেননা বিবেকের ইমারতগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে!’
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক