দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এবারের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অন্য যেকোনো বারের চেয়ে বিদেশিদের চাপ ছিল লক্ষণীয়। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নানামুখী উদ্যোগ ও ‘আস্থাহীনতার’ কারণে কূটনৈতিক বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু হলো নতুন বছর। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়, তা নিশ্চিত করতে চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পর নির্বাচন প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নও। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপিয়ান কমিশনের দুই সংসদ সদস্য কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়ে আহ্বান জানান, যেন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ইউরোপও ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়।
আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর এমন কঠোর অবস্থানের মধ্যেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে বলে সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে দেশি-বিদেশি মহলকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ছাড় দিয়েছে দলটি। বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও জাতীয় পার্টিসহ ছোট ছোট অনেক দলকে নির্বাচনে আনতে সক্ষম হয়েছে ক্ষমতাসীনরা। নতুন কিছু দলও নির্বাচনী মাঠে রয়েছে। শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচনে যত দলই অংশগ্রহণ করুক না কেন, টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছেÑএটা প্রায় নিশ্চিত। তাই সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগের নানা প্রয়াস সত্ত্বেও দ্বাদশ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
কয়েক বছরের তুলনায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উত্তালই ছিল বলা চলে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো প্রায় সারা বছরই সরকারবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে গেছে। অক্টোবরের শেষ দিকে বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে হওয়া সহিংসতার পর টানা ছয় সপ্তাহ হরতাল, অবরোধ করেছে বিএনপি। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস, ট্রেনে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনায় অন্তত আটজন মারা গেছেন। এমন রাজনৈতিক অস্থিরতা আগামী বছরেও চলমান থাকার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, নতুন বছরে বিরোধী দলের অবস্থান যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচন ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে গত বছরের চেয়ে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু হলো নতুন বছর। মার্কিন ভিসানীতির পর এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহটাই হবে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিশেষ করে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দেখার বিষয় হচ্ছে, বিদেশিরা এ নির্বাচন কতটা স্বীকৃতি দেয় এবং তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়। নির্বাচন-পরবর্তী যেকোনো বৈশ্বিক চাপ কূটনৈতিকভাবে সামাল দেওয়াটাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকেরা আরও বলছেন, র্যাবের মতোই যেকোনো নিষেধাজ্ঞাই সুদূরপ্রসারী। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আওতায় কোনো নিষেধাজ্ঞা এলে তাতে অনেক কিছুই ঘটে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি হলে পরিবারের সদস্য এবং তার ওপর নির্ভরশীলদের সেই ঘানি টানতে হয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠান হলে তার ফরোয়ার্ড লিঙ্কিং এবং ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কিং দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। অর্থাৎ ওই শিল্পের বিনিয়োগ, কাঁচামালের আমদানি এবং প্রস্তুতকৃত মালামালের বাজারজাতকরণ সিস্টেম ব্লক হয়ে যায়। এরই মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে ঘোষিত ভিসানীতির প্রয়োগ শুরুর কথা জানিয়েছে ওয়াশিংটন। নাম-ঠিকানা প্রকাশ না করা হলেও ভিসানীতির আওতায় রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে পেশাজীবী পর্যায়ে দেশের বিভিন্নজনের দীর্ঘমেয়াদি ভিসা বাতিল এবং অনেকের ভিসার আবেদনই আটকে গেছে। কাজেই এটা একটা বড় চ্যালঞ্জে। এর বাইরে ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে সরকারপক্ষ মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মিত্ররা দেশের নির্বাচন নিয়ে যে সক্রিয়তা দেখিয়েছে এবং তাদের যে প্রত্যাশার কথা বিভিন্ন সময়ে জানিয়ে এসেছে, তার ইতিবাচক জবাব পাবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে বছরের শুরুটা চরম কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু হলেও নির্বাচনের পর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এটি ততটা প্রকট হবে না।
নির্বাচনবিষয়ক বিশ্লেষক ও বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিকÑসুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে আওয়ামী লীগ আগের দুই নির্বাচন থেকে ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানের হতে হলে সব বড় রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা, নির্বাচনে জয় পাওয়া নিয়ে প্রার্থীর অনিশ্চয়তার মতো বিষয়গুলো উপস্থিত থাকতে হয়। এগুলোর উপস্থিতি যেহেতু নেই, তাই নির্বাচনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।