প্রবাসী ও রেমিট্যান্স শব্দ দুটো বাংলাদেশে খুবই আলোচ্য বিষয়। প্রবাসীদের বলা হয় রেমিট্যান্স-যোদ্ধা। যোদ্ধাদের যেমন প্রথম অপারেশন কিংবা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা মনের কোঠায় জমা থাকে, আমারও ঠিক তেমনই জীবনের প্রথম পাঠানো রেমিট্যান্সের স্মৃতি আজও মনে আছে। সেটা ছিল নভেম্বর ১৯৮২ সাল।
বড় ভাইয়ের চিঠি পেলাম। অনেক সংবাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংবাদ আব্বা হজে যাওয়ার নিয়ত করে ফেলেছেন অর্থাৎ তিনি এ বছরই হজে যাচ্ছেন। ১৯৮২ সালে হজ হয়েছিল সম্ভবত অক্টোবর মাসে।
আমাদের বাবা ১৯৫২ সালে সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে পুলিশ অফিসার হিসেবে তার চাকরিজীবন শুরু করেন। টানা ৩০ বছর চাকরি করে ১৯৮২ সালের মার্চে তিনি অবসর নেন। ব্যস্ত জীবন থেকে হঠাৎ অবসরে আসার পর তিনি মনস্থির করলেন, ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হজ অর্থাত আল্লাহর ঘর জিয়ারতে মক্কা শরিফ যাবেন। ওই সময় হজের জন্য অত কঠিন নিয়মকানুন কিংবা এত ধরনের চার্জ বা ফি ছিল না, যা বর্তমানে হজে জনপ্রতি ৮/১০ লাখ টাকার প্রয়োজন। তখন ৩০/৩৫ হাজার টাকায় পাঁচ-ছয় সপ্তাহ মক্কা-মদিনা ঘুরে স্বাচ্ছন্দ্যে হজ সম্পূর্ণ করা যেত। আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা করে তিনি প্রস্তুতি শুরু করেন। খালিস নিয়তে কোনো ভালো কাজের ইচ্ছা করলে আল্লাহ কোনো না কোনো ব্যবস্থা করে দেন। যথানিয়মে পাসপোর্ট বানানো, হজ ভিসার আবেদনের প্রস্তুতি শুরু হলো।
আমরা আট ভাইবোনকে বড় করে মধ্যবিত্ত পরিবারের সকল চাহিদা পূরণ করে, ৩০ বছর সরকারি চাকরি শেষে একজন প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসার অবসরে যাওয়ার পর তার সমস্ত সঞ্চয় জমা করে মোট পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া গেল। প্রয়োজন আরও ২৫/৩০ হাজার টাকার।
বড় ভাই বেচারাও ১৯৭৯ সালে মাস্টার্স সম্পূর্ণ করে তেমন কিছুতেই লাগতে পারেননি। মেজো ভাই ও আমি আমাদের নিজেদের চেষ্টায় সবে মাত্র এক বছর হলো প্রবাসে এসেছি। আব্বার হঠাৎ কখনো টাকার প্রয়োজন হলে ওনার এক ভাগনির কাছ থেকে কর্জ করতেন, ব্যবসার কারণে ওনাদের অবস্থা ভালো ছিল। তাই যথানিয়মে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ করে হজে রওনা দিয়ে দিলেন। আমি বড় ভাইয়ের চিঠি পাওয়ার পরদিনই ফোন করে বললাম, চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমার হাতে কিছু টাকা আছে পাঠিয়ে দিচ্ছি, ওখান থেকেই আপার টাকা ফেরত দিয়ে দিয়ো। পরদিনই আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের মাধ্যমে দুই হাজার ইউএস ডলারের ড্রাফট বানিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। তখন এক ইউএস ডলার ছিল ১৮ টাকা। ওই প্রথম রেমিট্যান্সের খাতা খুলেছিলাম, যা আজও খোলা আছে।
এখন অবশ্য টাকা পাঠানো অনেক সহজ। তখন প্রবাসীদের বড় অভিযোগ ছিল ডাকে পাঠানো ড্রাফট বা চেক খোয়া যাওয়ার। আমারও এক বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। ১৯৯০ সালে বড় ভাইয়ের ছেলে দুই বছর হওয়াতে ২০০ ইউএস ডলারের ড্রাফট বানিয়ে কানাডা পোস্টের রেজিস্ট্রি চিঠিতে পাঠাই। দু-তিন সপ্তাহ পর ফোনে বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলে বললেন, চিঠি-ড্রাফট কিছুই পাননি। আমি টরন্টো ডাউন টাউনে ব্যাংক অব মন্ট্রিয়লে, যেখানে ড্রাফট বানিয়েছিলাম, তাদের জানাই। ব্যাংক তিন মাস সময় চাইল তদন্তের জন্য। রেজিস্ট্রি চিঠির নিখোঁজের খবরও অভিহিত করি কানাডা পোস্টকে। তারাও ছয়-আট সপ্তাহ সময় চাইল, যদি ঠিকানা ভুল থাকে চিঠি ফেরত আসবে এই আশায়। আড়াই মাস পর ব্যাংক ফোন করে ব্রাঞ্চে আসার অনুরোধ করে। যাওয়ার পর ওই ড্রাফট সিঙ্গাপুরে ক্যাশ করার ফটোকপি আমাকে দেখায়। আমি বললাম, আমার ভাই সিঙ্গাপুর যায়নি এবং এই সইও তার নয়। তখনই ব্যাংক ২০০ ইউএস ডলার আমাকে দিয়ে দিল। এদিকে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের কোনো সাড়া না পেয়ে কানাডা পোস্ট রেজিস্ট্রেশন চিঠি হারিয়ে যাওয়ায় ৪০ ডলারের চেক পাঠাল, সেই সঙ্গে দুঃখ ও ক্ষমা প্রার্থনা করে এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্য। যদিও ড্রাফট বানাতে পাঁচ ডলার ও চিঠি রেজিস্ট্রেশনে পাঁচ ডলার মোট ১০ ডলার খরচ হয়েছিল, পেলাম ৪০ ডলার।
প্রতিটি সমস্যার মধ্যেই আছে সমাধান। ১৯৮০ সালের দিকে যখন আমরা কলেজছাত্র, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলেই একযোগে সবাই বলতাম জনসংখ্যার সমস্যা। ছোট্ট দেশ, মানুষ গিজগিজ করছে। তখন ছিলাম আমরা আট কোটি মানুষ, আজ প্রায় আঠারো কোটি। এক কোটির ওপর আমরা প্রবাসী নামধারী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। এই প্রবাসীদের প্রতিবছর পাঠানো ২০-২৫ বিলিয়ন ডলারই আজ বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। আমার স্যালুট সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোটি প্রবাসী রেমিট্যান্স-যোদ্ধা ভাইবোনদের প্রতি। আল্লাহ সবাইকে নিরাপদে সুস্থ ও শান্তিতে রাখুন।



নকীব-ই-কিবরিয়া


