দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে গত এক বছর ধরে নানা নাটকীয়তা করেছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে তারা দিনের পর দিন ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। এমনকি একপর্যায়ে তারা রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে গত আগস্টে ভারত সফরে যান জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তার কিছুদিন আগে ভারত সফর করে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল। এর পর থেকে জি এম কাদের আওয়ামী লীগের সমালোচনা বন্ধ করে দেন এবং গণমাধ্যম থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন। অবশেষে নানা নাটকীয়তা ও অনিশ্চয়তা তৈরি করে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পেয়ে ২৬৫ আসনে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। তখন দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু আওয়ামী লীগের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে সরকার গঠন করার মতো পরিস্থিতি তৈরিরও আভাস দেন।
কিন্তু সরকার গঠন দূরে থাক, সমঝোতার আসনগুলোর সব কটিতেও জয় পায়নি জাপা। সমঝোতার ২৬টির মধ্যে ১১ আসনে জয় পেয়েছে, হেরেছে ১৫টিতে। তবে ছাড়ের বাইরে একটি আসনেও জিততে পারেননি দলটির কোনো প্রার্থী। আওয়ামী লীগের ছাড় না পাওয়া ২৩৯ আসনের মধ্যে সব কটিতেই ভরাডুবি হয়েছে। এই ২৩৯টির মধ্যে প্রায় ২২০ আসনে জামানত হারিয়েছে জাপা। এমনকি সমঝোতার ২৬ আসনে অন্তত তিনজন জামানত হারিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচিত হয়েছেন রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, চট্টগ্রাম-৫ আসনে কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পটুয়াখালী-১ আসনে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, ফেনী-৩ আসনে প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, বরিশাল-৩ আসনে গোলাম কিবরিয়া, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে একেএম সেলিম ওসমান, কুড়িগ্রাম-১ আসনে একেএম মোস্তাফিজুর রহমান, সাতক্ষীরা-২ আসনে মো. আশরাফুজ্জামান আশু এবং বগুড়া-২ আসনে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন ঢাকা-১৮ আসনে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য শেরীফা কাদের, নীলফামারী-৩ আসনে রানা মোহাম্মদ সোহেল, নীলফামারী-৪ আসনে আহসান আদেলুর রহমান, রংপুর-১ হোসেন মুকবুল শাহরিয়ার, কুড়িগ্রাম-২ আসনে পনির উদ্দিন আহমেদ, গাইবান্ধা-১ আসনে শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গাইবান্ধা-২ আসনে আব্দুর রশিদ সরকার, বগুড়া-৩ আসনে নুরুল ইসলাম তালুকদার, পিরোজপুর-৩ আসনে মাশরেকুল আজম, ময়মনসিংহ-৫ আসনে সালাহউদ্দিন আহমেদ, ময়মনসিংহ-৮ আসনে ফখরুল ইমাম, মানিকগঞ্জ-১ আসনে জহিরুল ইসলাম রুবেল, হবিগঞ্জ-১ আসনে আব্দুল মুনিম চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে মো. আবদুল হামিদ এবং চট্টগ্রাম-৮ আসনে মো. সোলায়মান আলম শেঠ।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা বা জোট করে অংশগ্রহণ করা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, এবারই জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বনিম্ন আসন পেয়েছে। দল প্রতিষ্ঠার পর কোনো নির্বাচনে তারা এত কম আসন পায়নি। ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পদত্যাগের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৩৫টি আসনে জয় পায় জাপা। ১৯৯৬ সালে ৩৩টি ও ২০০১ সালে ১৪টি আসনে জয়ী হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠন করলে সে সময় সমঝোতার ভিত্তিতে ২৯টি আসনে ছাড় পেয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২৭টিতে জয়লাভ করে দলটি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে জাপা নির্বাচন করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাপা ৩৩টি আসনে জয়ী হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে ২৩টি আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল হয়। ক্ষমতার আশপাশে থাকতে গিয়ে সুবিধাবাদের যে রাজনীতি করছে, এতে ধীরে ধীরে দলটি রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে জাপা যে ফলাফল করেছে, তাতে অনেকেই একে জাপার কফিনে শেষ পেরেক হিসেবে দেখছেন।
জাপার নেতাকর্মীরা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ মিলে দলকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, অংশ নেবেন না ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে গেলেন। শেষ মুহূর্তেও চেয়ারম্যান বললেন, ‘ভিক্ষার আসন চাই না।’ নেতাকর্মীরাও নেতাদের কথায় প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে যা করেছেন নেতারা, তাতে জাতীয় পার্টি বলে আর কিছু রাখেননি। এটি এখন জি এম কাদেরের পকেট পার্টি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জাপার এই ভরাডুবির পেছনে দলের বিভক্তি ও সাংগঠনিক দুর্বলতাই দায়ী। এরশাদের অনুপস্থিতিতে যোগ্য নেতৃত্ব না থাকা ও তৃণমূলের সঙ্গে নেতাদের যোগাযোগ না থাকার মূল্য চুকাতে হয়েছে আসন হারিয়ে। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও জাপার দুই প্রধান নেতা জি এম কাদের ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ দ্বন্দ্বে জড়ান। ফলে রওশন ও তার অনুসারীরা নির্বাচনে অংশ নেননি। রওশন থাকলে সরকার জাপাকে আরও কিছু আসনে ছাড় দিত। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার ২৬ আসনে সমঝোতা করার বিষয়টি জাপায় অস্বস্তি তৈরি করে। এর ফলে জাপা নেতারা ভয় পেয়ে যান, বাকি আসনে সুষ্ঠু ভোট হবে না এবং জাপার পরাজয় নিশ্চিত।
বিশ্লেষকেরা আরও মনে করছেন, গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে গিয়ে জাপার কোনো বিকাশ ঘটেনি। তারা দল না হয়ে একটা সুবিধাবাদী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। জাপার নেতারা সরকারের সঙ্গে থেকেও বিরোধী দলের আসনে বসা নিয়েও মানুষ বিরক্ত ছিল। জাপা সংসদে থেকেও জনগণের পক্ষে কোনো কার্যকর ভূমিকা না রাখায় ভোটাররা ক্ষুব্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গবেষণা সেল ও থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবী ও পরামর্শক থাকলেও জাপার কোনো গবেষণা সেল নেই, উচ্চশিক্ষিত নেতাকর্মী নেই, এমনকি বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত এমন কোনো শুভাকাক্সক্ষীও নেই। ফলে দিনে দিনে দল হিসেবে তারা ঝুঁকিতে পড়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় বলেন, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলকে কোরবানি দিয়েছেন। মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে সুবিধা দিতে গিয়ে দলকে ডোবানো হয়েছে। ৩০০ আসনে অংশ নেওয়ার কথা বলে ফরম বিক্রি করে পরে ২৬ জন কেন সমঝোতা করলেন। ৯১ সালে এর চেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকার পরও জাপা ভালো ফলাফল করেছিল। এবারও সেই প্রত্যাশা ছিল। জাপা চেয়ারম্যান ও মহাসচিব এই ভরাডুবির জন্য দায়ী।
জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে জাপার প্রস্তুতি ভালো ছিল না। নির্বাচনের আগে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে যে দ্বিধা ছিল, তা দলের খারাপ ফলাফলকে ত্বরান্বিত করেছে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে যাওয়ার পর এর চেয়ে ভালো ফলাফল সম্ভব ছিল না। ফলে এই ফলাফলকে আমি কাক্সিক্ষতই মনে করব।