জাবির কপালে ফের কলঙ্কের তিলক

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ১১:১৭ , অনলাইন ভার্সন

১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিক ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন’ করে  বিশ্ববিদ্যালয়কে কালি লেপন করেছিলেন। ওই ঘটনায় সারা দেশে তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে। ওই ঘটনার ২৬ বছর পর দেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম সূতিকাগার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কপালে ফের কলঙ্কের তিলক আঁটলো। এবারের ঘটনায়ও নাম এল ছাত্রলীগের। ৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে বহিরাগত এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ভুক্তভোগী নারীর স্বামী মামলা করলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের এক নেতাসহ তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ক্যাম্পাসে উত্তাল পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ ছয় শিক্ষার্থীর সনদ স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুরসহ চার আসামির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঘটনার পর থেকে জড়িতদের বিচারের দাবিতে টানা তিন দিন ধরে মানববন্ধন, মশাল মিছিলসহ বিক্ষোভে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এ ঘটনার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিচার দাবি করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও। ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট ১৮ নাগরিক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের ধিক্কার।
৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাত সাড়ে নয়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল-সংলগ্ন জঙ্গলে দলবদ্ধ ধর্ষণের এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন মূল অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান এবং তার সহযোগী একই বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসানুজ্জামান, ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাগর সিদ্দিকী ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন। পলাতক আছেন ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত মো. মামুনুর রশিদ এবং স্বামীকে আটকে রাখায় সহায়তা ও মারধর করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মুরাদ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। বাকিরা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও মীর মশাররফ হোসেন হল কমিটির পদপ্রত্যাশী।
বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের। গত ১৫ বছর ধরে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে আর সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে সংগঠনটি। সংঘাত-সংঘর্ষ, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই, ধর্ষণ-অপহরণ, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, শিক্ষক পেটানো, চাঁদাবাজি এমন কোনো অপকর্ম নেই যা ছাত্রলীগ করেনি। এমনকি সংগঠনের নেত্রীদের পদ-পদবি দেওয়ার নামে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে রাত কাটাতে বাধ্য করার অভিযোগও প্রায়ই খবর হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান আর নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রসংগঠনটির নাম শুনলেই এখন মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ মানেই যেন আতঙ্কের নাম, ছাত্রলীগের নেতা মানেই যেন ভীতিকর কোনো ব্যক্তি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংগঠনটি বারবার বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলছে সরকারকে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এতই বেপরোয়া যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত একসময় সংগঠনটির সাংগঠনিক অভিভাবকের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন।
ঘটনার পরদিন ৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে আশুলিয়া থানায় সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন সদ্য পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পাওয়া ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস ও ট্রাফিক উত্তর বিভাগ) মো. আবদুল্লাহিল কাফী। তিনি বলেন, ভুক্তভোগী নারী ও তার স্বামী আশুলিয়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে একই বাসায় পাশাপাশি কক্ষে ভাড়া থাকতেন মামুনুর রশিদ। শনিবার মোবাইল ফোনে ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বামীকে মামুন জানান, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে তার পরিচিত মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কিছুদিন থাকবেন। পরে তিনি ওই ব্যক্তিকে ক্যাম্পাসে এসে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ভুক্তভোগীর স্বামী ক্যাম্পাসে এলে হলের একটি কক্ষে মোস্তাফিজ ও মুরাদের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। একপর্যায়ে মামুন ভুক্তভোগীর স্বামীকে জানান, সাভারের একটি ইলেকট্রনিকসের দোকানে তারা কিছু টাকা পাবেন, তবে দোকানি টাকা দিতে চাচ্ছেন না। ওই টাকার বিনিময়ে ভুক্তভোগীর স্বামীকে বাসার জন্য টিভি, ফ্রিজসহ অন্যান্য আসবাব নিতে বলেন এবং সমপরিমাণ টাকা মামুনকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিছুদিন ক্যাম্পাসে থাকবেন বলে ভুক্তভোগীর স্বামীকে মামুনের কাপড় নিয়ে ক্যাম্পাসে আসার জন্য স্ত্রীকে বলতে বলেন। স্বামী তার স্ত্রীকে ক্যাম্পাসে ডেকে আনেন। রাত নয়টার দিকে ওই নারী ক্যাম্পাসে আসেন। ভুক্তভোগীর স্বামী, মামুন, মোস্তাফিজ ও মুরাদ মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে আসেন। একপর্যায়ে মুরাদ ভুক্তভোগীর স্বামীকে হলের এ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে নিয়ে বেঁধে ফেলেন ও মারধর করেন। পরে মোস্তাফিজ ও মামুন ওই নারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল-সংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ওই নারী ও তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘটনার বিচারের দাবিতে প্রথমে তারা আশুলিয়া থানায় এবং পরে সাভার মডেল থানায় যান।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও জানান, এ ঘটনায় সাভার মডেল থানা ও আশুলিয়া থানার পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত শুরু করে। তিনি বলেন, আসামিদের পালিয়ে যাওয়ায় সহায়তা করার অভিযোগে তিনজনকে ক্যাম্পাস থেকে আটক করা হয়। সাভার থানা এলাকা থেকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানকে আটক করা হয়। মামলা হওয়ার পর তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পলাতক আসামি মুরাদ ও মামুনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
ভুক্তভোগী ওই নারী বলেন, ‘মামুন আমাদের বাসায় ভাড়া থাকত। পূর্বপরিচিত হওয়ায় সে প্রথমে আমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর তার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে যেতে বললে আমি ক্যাম্পাসে যাই। তার সঙ্গে মোস্তাফিজ ছিল। তখন তারা আমার স্বামী জঙ্গলের অন্য দিক থেকে আসবে বলে আমাকে হলের পাশের জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে গেলে তারা আমাকে ধর্ষণ করে।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ধর্ষণের ঘটনার বিচারের দাবিতে তিন দিন ধরে বিক্ষোভ, মশাল মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী অদিতি ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষার জায়গা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এমন এক জায়গায় এমন ঘটনা পুরো দেশের জন্য লজ্জাজনক। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা এমন, সেখানে মানুষ হওয়ার কোনো উপাদান নেই। ফলে দেখা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ গণধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এটা পুরো শিক্ষার্থী সমাজের জন্য লজ্জাজনক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা বলেন, ‘আমরা সবাই এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি। আমরা সবাই একত্র হয়েছি, এই অন্যায়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে নৈতিকতা শেখায়, ধর্ষক তৈরি করে না। অথচ আজ তাদের নৈতিক অবক্ষয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে হলে জিম্মি করে তার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গজব নাজিল হওয়া উচিত, আমাদের সবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া উচিত। এই সভ্যতার বিশ্ববিদ্যালয় কোনো দরকার নেই। এই ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যত দিন প্রশাসনের মদদে এই ক্যাম্পাসে অছাত্র, অবৈধ ছাত্র অবস্থান করবে, ছাত্রলীগ নামধারী অছাত্ররা নিয়োগ-বাণিজ্য করবে, চাঁদাবাজি করবে, তত দিন এই ক্যাম্পাস থেকে অপরাধ দূর করা সম্ভব নয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাব্বির আলম বলেন, ‘ঘটনা শুনে রাতেই হলে যাই। জড়িতদের মধ্যে যারা হলে ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘রাতে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের নিয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলে যাই। যারা অভিযুক্তকে পালাতে সহযোগিতা করেছে, হল প্রশাসনের সহযোগিতায় রুমে রুমে তল্লাশি চালিয়ে তাদের পুলিশে সোপর্দ করেছি। এ ছাড়া মূল অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছি।’
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078