স্মৃতিতে সিরাজুল আলম খান

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৩, ১১:২০ , অনলাইন ভার্সন
কামরুল আহসান হেলু


সেপ্টেম্বর, ১৯৬২। আমি তখন ঢাকা শহরের তেজগাঁও রেলস্টেশনের নিকটবর্তী মার্কিন সমর্থিত টেকনিক্যাল হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। মার্কিন সমর্থিত বলেই আমাদের ক্রীড়া শিক্ষক ফুটবল, ভলিবলের পাশাপাশি মার্কিন মুল্লুকের জনপ্রিয় খেলা ‘বেস বল’-এর নিয়ম-কানুনও শেখাতেন মাসে অন্তত দু’দিন। বয়সে ছোট হলেও পড়ুয়া পিতার অত্যন্ত প্রিয় তৎকালীন ৮ পৃষ্ঠার ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর কারণে শহরে বা দেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাবলীর দিকে আমিও ছিলাম কম-বেশি আকৃষ্ট। সরকারি চাকুরে অরাজনৈতিক পিতার জাতীয়তাবাদী চেতনা ও উচ্ছ্বাসের কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমিও মোটামুটি প্রভাবান্বিত ও সচেতন। সরকারবিরোধী ‘ইত্তেফাকের’ কল্যাণে ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইউব খান জারিকৃত সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাভাষী রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে ঢাকাস্থ ছাত্র সমাজের অস্বস্তি ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে রাজনৈতিক অঙ্গন ততোদিনে কিছুটা হলেও উত্তপ্ত। তেমনি পরিস্থিতিতে হঠাৎ একদিন বেলা ১১টা বাজতেই স্কুলের ঘণ্টি প্রচণ্ড শব্দ করে বেজে উঠলো! অথচ ছুটি হবার কথা বিকেল পাঁচটায়। উৎসুক হয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি মাইল দেড়েক দূরের পলিটেকনিক ইন্সটিউটের বড় ভাইয়া চীৎকার করে, বলতে গেলে বকা-ঝকা করে সব ছাত্রকে ক্লাস থেকে বের করে দিচ্ছেন।

ভয়ে ভয়ে শিক্ষকের দিকে তাকাতেই তিনিও কেমন যেনো চোখের ইশারায় সম্মতি দিলেন। দিনটি ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সাল। জীবনে এই প্রথম সংঘবদ্ধ-সুশৃঙ্খল দু’লাইনের মিছিলে আমিও অংশ নিলাম। আরো মিনিট দশেক পর পার্শ্ববর্তী বেসরকারি পলিটেকনিক হাইস্কুলের কয়েকশ ছাত্রের যোগদানে লম্বা হয়ে ওঠা ঐ বিশাল মিছিল চললো শাহবাগের দিকে। সে যুগের বিজ্ঞানভিত্তিক স্কুলের শিক্ষকদের কড়া শাসনের বাইরে হঠাৎ করে আসতে পেরে নিজেকে কেমন যেনো বাঁধছাড়া ও মুক্ত বলেই মনে হলো। মিছিলটি আরো এগিয়ে গিয়ে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির কাছে আসতেই একজন তরুণ ছাত্র নেতা মিছিলটির অগ্রভাগকে থামিয়ে দিলেন। তারপর চীৎকার করে জানালেন যে, কিছুক্ষণ আগেই ছাত্রদের অন্য একটি মিছিলের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণে একজন ছাত্র নিহত এবং বহু আহত হয়েছেন। তারই আহ্বানে আমাদের মিছিলটি অচিরেই থেমে গিয়ে পরিণামে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। 

রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়া বাসগুলোতে ছোট ছোট ছাত্রদের উঠিয়ে দিয়ে তিনি ড্রাইভারদের অনুরোধ করলেন ফার্মগেটে নামিয়ে দিতে। কিন্তু আমরা কিছু দুষ্টু ছেলে বাসে না উঠে সেই তরুণ ছাত্রনেতাকে অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়লাম। এভাবেই আমাদের পরিচিতি ঘটলো তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর সাহসী সাধারণ সম্পাদক, সুদক্ষ অর্গানাইজার ও স্বাধীনচেতা সিরাজুল আলম খানের সাথে। এরপরও ছাত্র আন্দোলন এগিয়ে চললো আরো কয়েক সপ্তাহ এবং অবশেষে আরবি অক্ষরে বাংলাভাষা লেখার সরকারি চক্রান্তে বিচারপতি হামিদুর রহমান রচিত ‘শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন আইউব-মোনায়েম সরকার। 

এ আন্দোলনের সূত্র ধরেই পরবর্তীতে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে আমরা গুটি কয়েকজন দেখতে দেখতে বয়স ১৪/১৫ হবার আগেই কট্টর রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হলাম। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রলীগের তৎকালীন সংগ্রামী সভাপতি ওবায়দুর রহমানসহ অন্যান্য নেতা ও কর্মীদের মাঝে আমাদের চাহিদা বেড়ে গেলো। আমরাও ক্রমেই লেখাপড়ার বদলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকেই বেশি করে ঝুঁকে পড়লাম।

অবশ্য তখনও লাখ দেড়েক মানুষের ঢাকা শহরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কোনো সঠিক ধারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। দেশের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অরাজনৈতিক মানুষ তখনও পাকিস্তানি ঐক্য-সংহতি, তথা ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনের নামে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে বাঙালি মুসলমানদের মগজে ঢুকে যাওয়া তীব্র ধর্মীয় উচ্ছ্বাস ও আবেগে আপ্লুত বিরাট সংখ্যক জনগণের পাকিস্তান-প্রীতির নমুনা দেখে আমার পিতাসহ সচেতন বাংলাভাষীরা অবশ্যই বিচলিত হতেন। অবশ্য পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই অবাঙালি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানদের বাঙালি স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত থাকা সর্বভারতীয় বাঙালি নেতা, ১৯৪১ সালেই মুসলিম লীগ থেকে সরে যাওয়া শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে এককালের কঠোর পাকিস্তানপন্থী নেতা বলে পরিচিত মাওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী সাহেবরা মিলিত হয়ে ১৯৫৪ সালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে এক ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে গণবিরোধী মুসলিম লীগের ‘অপতৎপরতা’কে সাময়িকভাবে হলেও লাইনচ্যূত করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

এর আগেই ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি চেতনায় বড় রকমের ধাক্কা খেয়ে হতচকিত ধর্মভীরু বাঙালিরা দল হিসেবে মুসলিম লীগ ও তার নেতাদের কর্মকাণ্ডকে যতটা না দায়ী করেছিলেন, তার তুলনায় তারা কিন্তু ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রটিকে তেমনভাবে দায়ী করেননি। ক্ষমতাসীন নেতারাই দায়ী, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান দায়ী নয়- এমনি একটি চেতনায় আবদ্ধ ছিলেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার বিপুল সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙলি জনতা। তাই ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর থেকেই যারা ছাত্রলীগ বা আওয়ামী রীগের সক্রীয় নেতা বা কর্মী ছিলেন, তারা ভালো করেই জানেন যে, ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের আগ পর্যন্ত ঢাকা শহরেও পাকিস্তানবিরোধী কথাবার্তা বলা কি পরিমাণ ভয়ঙ্কর দেশবিরোধী ‘মহাপাপ’ বলে বিবেচিত হতো।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেরে বাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে প্রচণ্ড মার খেয়েও চরম প্রতিক্রিয়াশীল, বাঙালির স্বার্থ ও সংস্কৃতিবিরোধী সামরিক জেনারেলদের কল্যাণে পাকিস্তানপন্থীদের ব্যাপক প্রপাগান্ডার মুখে পূর্ব বাংলার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সত্যি সত্যি ষাটের দশকের শেষ প্রান্ত পর্যন্তই ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্রটির মোহে মোহান্বিত ছিলেন। সেই মোহ, সেই নিদ্রা, সেই ‘পাকিস্তানি যাদুর বাক্স’ ভাঙতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের যে তরুণ মানুষটি সবচেয়ে বেশি প্রাণপণে চেষ্টা করে গেছেন ১৯৫৭/৫৮ সাল থেকেই স্কুল-কলেজের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে এবং পরে আরো বেশি দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে খেয়ে না খেয়ে, প্রতি ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৪/৫ ঘণ্টা ঘুমিয়ে, তুখোড় সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে সমগ্র পূর্ববাংলা চষে বেড়িয়ে- তিনিই ছিলেন মহান, নিঃস্বার্থ জাতীয়তাবাদী ছাত্র ও শ্রমিক নেতা, সেই ’৬২ সাল থেকেই আমার শিক্ষক-রাজনৈতিক গুরু সিরাজুল আলম খান।

সিরাজ ভাই ১৯৫৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে গণিতশাস্ত্রের ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বাস করতে শুরু করেন। এদিকে ১৯৫৮ সালে প্রথমে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরের বছরগুলোতে পর পর দু’বার সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী তুখোড় ছাত্রনেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সিরাজুল আলম খানের অতুলনীয় সাংগঠনিক তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে তাকেই ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনয়ন দান করেন। একই বছর ছাত্রলীগের সভাপতির গুরুদায়িত্বে ছিলেন মাদারীপুরের দুঃসাহসী ছাত্রনেতা কেএম ওবায়দুর রহমান। 

স্বল্পভাষী সিরাজুল আলম খান সব কর্মীসভায় জাতীয়তাবাদী চেতনাকে অত্যন্ত যুক্তিযুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারলেও বড় বড় জনসভার মঞ্চগুলোতে তাকে তেমন দেখা যেতো না। মাঝেমধ্যে মঞ্চে উঠে দু’চারটা স্লোগান দিয়েই সিরাজ ভাই মঞ্চ থেকে সরে যেতেন। 
এ ব্যাপারে আমার (লেখক) সাথে তিনি প্রায়ই রসিকতা করতেন। কারণ আমিও উনার মতো মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ব্যাপারে মোটেও পারদর্শী ছিলাম না। যা হোক, অপূর্ব সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী সিরাজ ভাই পুরো ষাটের দশক ধরেই তার মনে সুপ্ত থাকা স্বাধীনাতর জ্বলজ্বলে চিন্তা-চেতনাকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করে ছাত্রলীগের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার ছাত্র-যুব-তরুণ সমাজের মনোজগতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আকস্মিক মহাপ্লাবনের সুমহান ক্ষেত্রটিকে প্রস্তুত করে পাকিস্তান-প্রীতির শেষ শেকড়টিকে সাফল্যের সাথে সমূলে উৎখাত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। 

সিরাজ ভাই ১৯৪৭ সাল থেকেই ধর্মীয় জাতীয়তার নামে রক্তচোষা জোঁকের মতো চেপে বসা অবাঙালি প্রভুদের নিদারুণ শোষণ-শাসন, অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে মহাপ্রতিরোধ, মহাবিদ্রোহ, মহাডঙ্কা, মহাপ্রলয়-এর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ব চিন্তাশীল রণনায়ক, রণকৌশলী এবং যুবনেতা-যুবনায়ক-যুব সেনাপতি হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এদিকে সচেতন বাঙালি সমাজের উচ্চতর আসনে বসা গুটিকয়েক জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনাদারী সিএসপি অফিসারসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ তথা বুদ্ধিজীবীদের সাহায্যে রচিত স্বায়ত্ত্বশাসনের ‘ম্যাগনা কার্টা’ ৬ দফা দাবির আড়ালে স্বাধীনতার দাবিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে, গন্ডায় গন্ডায় ভীত-সন্ত্রস্ত এবং লক্ষ্যচ্যূৎ, গতিহীন, কম-বেশি পাকিস্তানের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মেরুদন্ডহীন বিশাল সংখ্যক বাঙালি রাজনীতিবিদদের বিপরীতে জাতীয় পর্যায়ে দুর্জয় সাহসী, বিধাতা প্রদত্ত এক অপূর্ব ও অভাবনীয় বজ্রকণ্ঠ নিয়ে জন্ম নেয়া তৎকালীন সময়ের অভূতপূর্ব জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, বিদেশি বেনিয়া অবাঙালি জেনারেলদের হাজারো হুমকি-ধামকি-চক্রান্ত এবং তথাকথিত ‘আগরতলা মামলা’র নামে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সর্বাত্মকভাবে ধ্বংস করার সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্রসহ হাজারো বাঁধাকে উপেক্ষা করে বাংলার পথে-প্রান্তরে, নগরে-বন্দরে, মারাত্মক শোষণ ও নির্যাতনের মুখে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে ঝিমিয়ে পড়া দিশেহারা কোটি কোটি জনগণের মন-মানসিকতায় বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্যতাবোধ, যুগে যুগে বিদ্রোহের অগ্নি উপাখ্যানের গৌরবময় চেতনার পথ ধরে হিমালয়সম সুকঠোর আত্মপ্রত্যয়ে বিশ্বাসী নেতা জাতিকে প্রয়োজনে সর্বাত্মক স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্র তথা জঙ্গি চেতনায় উজ্জীবিত করে গেলেন ১৯৬৬-উত্তর তৎকালীন পরাধীন পূর্ব বাংলায়।

অতঃপর সে বছরই ৭ জুুনের রক্তক্ষয়ী ৬ দফা দিবসের পরে সব বড় বড় আওয়ামী ও ছাত্রলীগ নেতাদের দীর্ঘকালীন কারাবাসের যুগে মূলত নেতৃত্বহীন ৬ দফা আন্দোলনকে আত্মগোপনে থাকা একমাত্র ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান বলতে গেলে একাই টিকিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর ধরে। ঢাকা শহরে তার আত্মগোপনের যে কয়টি আস্তানা ছিল, তারই একটি ছিল আমারই ব্যক্তিগত উদ্যোগে, আমারই ব্যবস্থাপনায় কোন এক সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক বন্ধুর দোকানের পেছনের ঘুঁপচি ঘরে। সেসব দিনগুলোতে বাড়িতে বাড়িতে টেলিফোন সহজলভ্য না হলেও আমাদের বাড়িতে টেলিফোন থাকায় গভীর রাতে গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে আমাদের বাড়ির উঁচু দেয়াল টপকে আমার পিতার রুমে থাকা টেলিফোন থেকে দেশের বিভিন্ন শহরে লুক্কয়িত নেতাদের সাথে যোগাযোগ করতেন। ঘণ্টা দু’য়েক কথা বলে দিনের আলো ফুটবার আগেই আমি তাকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে গোপন আস্তানায় ফেরৎ নিয়ে যেতাম। এ সময় ‘দাদা’ নামে পরিচিত হওয়া সিরাজ ভাই দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকলেও রাতের অন্ধকারে আপাদমস্তক চাদরে মুড়ে তার ইতালিয়ান ‘ল্যামব্রেটা’ মোটর সাইকেলটি নিয়ে সারা শহরের গুপ্ত সেলগুলোর সাথে যোগাযোগ করতেন। কোনো কোনো রাতে বাড়ির কাউকে জানিয়ে আমিও এ সময় তার সাথে গভীর রাতের সঙ্গী হতাম। ৬ দফা আন্দোলন শুরু হবার আগে আওয়ামী লীগের তেমন কোন শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন ছিল না। 
তাই সিরাজ ভাই সম্পূর্ণ একাই ঢাকা শহরের দূরবর্তী এলাকাগুলোর ছোট-বড় সব কটি শিল্প শহরে প্রতি সপ্তাহেই ঢুঁ মারতে শুরু করলেন। অধিকাংশ শ্রমিক নেতাই তখন ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাদের রাজনৈতিক গতি-মতি বা আদর্শ তেমন জোরালো ছিল না। সিরাজ ভাই সে সুযোগে প্রথমে বিভিন্ন এলাকার শ্রমিক নেতাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে জাতীয়তাবাদী চেতনা তথা ৬ দফা আন্দোলনের ‘পাঠশালা’ বিস্তৃতির প্রয়াস ঘটালেন। তৎসময়ের আদমজী পাটকলে তাকে প্রথমে সাহায্য করলেন শ্রমিক নেতা আজীজুল হক ও পরে বিশালবপু জনপ্রিয় সায়দুল হক সাদু। 

পোস্তগোলায় শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান ও মেসবাহ উদ্দীন, ডেমরা শিল্প অঞ্চলে আবদুল মান্নান এবং তেজগাঁও শিল্প এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভূঁইয়া- যিনি পরবর্তীকালে রক্তক্ষয়ী ৭ জুনের ‘হরতাল’ দিবসে তার নিজ এলাকায় ইতিহাস সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন আইউব-মোনায়েম গোষ্ঠীর মসনদে কম্পন সৃষ্টি করতে সমর্থ হন। মোট কথা, যে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ঢাকা শহরে বা আশেপাশে কোন সংঘবন্ধ শ্রমিক সংগঠন ছিল না, মাত্র ৬ মাস পরেই সে রাজনৈতিক দলেরই অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে ‘জাতীয় শ্রমিক লীগ’ আকস্মিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। যেভাবে ৬ দফা আন্দোলনের এক বিরাট সহায়ক শক্তি হিসেবে দাপটের সাথে আবির্ভূত হয়েছিল, তার পেছনের সব কৃতিত্ব ছিল মাত্র একজন নিঃস্বার্থ, আত্মগোপনে থাকা ছাত্রনেতাÑ যার নাম ছিল সিরাজুল আলম খান এবং যিনি ছিলেন আমাদের মতো পোড় খাওয়া ক্ষুদে কর্মীদের সব অনুপ্রেরণার একমাত্র উৎস।

পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে জেলের বাইরে থাকা চাঁদপুরের সর্বজনবিদিত জননেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী সে বছরগুলোতে আওয়ামী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে কোন রকমে টিকিয়ে রেখে মাঝেমধ্যে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দলের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করতেন। কিন্তু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, চির লুক্কায়িত দাদার নেতৃত্বে আমরা গোটা বিশেক কট্টরপন্থী কর্মী রাতের ঢাকায় ঘুমানোর সময় পেতাম না। বলতে দ্বিধা নেই যে, শুধুমাত্র রাজনীতির কারণেই লেখাপড়ার প্রতি যথার্থ মনোযোগ না দেয়ায় ট্যাকনিক্যাল স্কুলের ছাত্র হিসেবে ফিজিক্স, কেমেস্ট্রিসহ নানা বিজ্ঞান বিষয়গুলো আমরা মাথায় মোটেও ঢোকাতে পারিনি। পরিণামে আমার সেই স্কুল জীবনেই দু’বার ফেল করলে আমার এক ক্লাস নিচে পড়া তৎকালীন ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ কামাল আমার এক বছর আগেই মেট্রিক পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। সে অবস্থায় আমাকেও বাধ্য হয়ে লেখাপড়ার দিকে মন দিতে হয় এবং পরের বছরই আমি নিজেও ঢাকা কলেজেই ভর্তি হয়ে যাই। পরবর্তীকালে আমরা দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে আবারো রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। যা হোক, ৬ দফা আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে আওয়ামী কেন্দ্রীয় নেতাদের দল বেঁধে জেলে ঢোকানোর পরে একমাত্র সিরাজ ভাই-ই দলের গোপন সাংগঠনিক তৎপরতাকে দৃঢ়তার সাথে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তারই দূরদর্শীতার কারণে শুধুমাত্র শ্রমিক লীগই নয়, বরং সাথে সাথে জাতীয় কৃষক লীগ এবং জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক দল নামক দুটি অঙ্গ সংগঠনকেও তিনিই এককভাবে গড়ে তুলেছিলেন সেই চরম দুর্দিনের বছরগুলোতেও। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের ৬৫/৭০ পেরিয়ে যাওয়া সিনিয়র নেতাদের অনেকেরই ঢাকার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে অকুতোভয় সিরাজ ভাইয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং তারই পরামর্শ ও বদান্যতার ফলে এদের অনেকেই ছাত্রলীগের সম্পাদক/সভাপতি এমনকি ডাকসুর ভিপি পর্যন্ত হয়েছিলেন। এদের কেউ কেউ মফস্বলের স্কুল-কলেজগুলোতে এক আধটু উদ্দেশ্য বা আদর্শবিহীন রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে জড়িত থাকলেও ঢাকা শহরের রাজনীতি তথা ৬ দফা আন্দোলনের ধারেকাছেও ছিলেন না। অবশ্যই এদের একটি বড় অংশ তখনও নাবালক হিসেবে মায়ের কোলে বসে হয়তো দুধ খেয়েছেন। এদের বেশির ভাগই আসলে নেতা-পাতি নেতা হয়েছেন ১৯৬৯ সালে ১১ দফা আন্দোলনের সময় ‘বাতাস ঘুরে গেলে’Ñ সুযোগসন্ধানী হিসেবে ক্ষমতা এবং মালপানি কামানোর আশায়। এদের আসর রূপ আমরা দেখতে পেয়েছিলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই, যখন তারা দল বেঁধে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া হাজার হাজার বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা অর্থাৎ একান্তই রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিগুলো দখল করে রাতারাতি লাখপতি-কোটিপতি ও শিল্পপতি হয়ে বসলেন সম্পূর্ণ বিনা বাধায়- বিনা বিবেকে। 

অথচ আমাদের প্রিয় ‘দাদা ভাই’ সারাজীবনে ভুলেও টাকা-পয়সা, লাইসেন্স-পারমিট, চোরাচালানী, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার ইত্যাদি জঘণ্য সব অপরাধের রাজনীতির সাথে কখানোই জড়িত ছিলেন না। তিনি সে বছরগুলোতে প্রায়ই বলতেন যে, ‘যারা দেশকে ভালোবাসার নামে রাজনীতি করে আবার ‘প্রতিদান’ খুঁজে বেড়ায়Ñ সুযোগ পেলেই ফায়দা লুটে নেয়Ñ তারা সত্যিকার অর্থে কখনোই দেশপ্রেমিক ছিলেন না, বা হতেও পারেন না এবং ভবিষ্যতেও হবেন না।’ 

দেশের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটি আজীবন ঘর-বাড়ি বা ঠিকানাবিহীন এক ছন্নছাড়া মানুষ হিসেবে জনগণের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে গেলেন। আমি শুধু সেইসব ক্ষমতায় থাকা ‘সিনিয়র’ নেতাদের কথাই ভাবছি, যারা ষাটের দশকে এই সিরাজ ভাইয়ের হাতেই দীক্ষা নিয়ে রাজনীতি শিখে কিংবা তারই সমর্থন পেয়ে বড় বড় পদে উন্নীত হয়ে পরবর্তীকালে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ নানা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং এখনও ক্ষমতায় টিকে আছেন- তাদের একজনও এই মহান নিঃস্বার্থ আত্মটির মৃত্যুর পর তার জানাজায় পর্যন্ত আসার প্রয়োজন মনে করলেন না! হীনমন্যতা আর কাকে বলে? 

‘অকৃতজ্ঞতা’র জন্যে ‘নোবেল পুরস্কার’ দেয়া হয় কিনা- তা আমার জানা নেই। তবে দিলে আমরা বাঙালিরা যে প্রতি বছরই গন্ডায় গন্ডায় পুরস্কারটি পেয়ে বসতাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অকৃতজ্ঞ জাতির অকৃতজ্ঞ-সুবিধাবাদী-লজ্জাহীন-বিবেকহীন সন্তান হিসেবে অন্তত এই একটি ব্যাপারে আমরা হতাম ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ নিঃসন্দেহে প্রতি বছরই।

শেষ করার আগে ১৯৭১ সালের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কলে তারই একক চেতনার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, সর্বশ্রেষ্ঠ ভালোবাসা, সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শনÑ তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ বলেই আজকের মতো শেষ করলাম।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041