বিজয়ের চেতনা এবং তরুণ প্রজন্ম

প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:৫০ , অনলাইন ভার্সন
বিজয়ের চেতনা একটি জাতির আত্মপরিচয়ের শক্তি। এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় নয়, বরং একটি জীবন্ত প্রেরণা, যা প্রত্যেক নাগরিকের অন্তরে গেঁথে থাকে। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তরুণ প্রজন্মের কাছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজকের তরুণেরা সেই বিজয়ের চেতনা থেকে কতটা অনুপ্রাণিত হচ্ছে? তারা কীভাবে বাস্তব জীবনে এই চেতনাকে ধারণ করছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই, ইতিহাসের শিক্ষা এবং বর্তমান প্রজন্মের বাস্তবতা মাঝে মাঝে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
বিজয়ের চেতনা : আমাদের মূল ভিত্তি : 
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি অদম্য সংগ্রামের কাহিনি। সাত কোটি মানুষের ঐক্য, আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেই বিজয়ের চেতনা শুধু ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার গল্প নয়, এটি একটি জাতির আত্মমর্যাদা, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং অধিকারের দাবি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তরুণেরাই ছিলেন সামনের সারির যোদ্ধা। এদের সাহস এবং আত্মত্যাগে জাতি পেয়েছিল নতুন সূর্যের আলো। কাজেই বিজয়ের চেতনা তরুণ প্রজন্মের জন্য নতুন কিছু নয়। এটি তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার। কিন্তু বাস্তব জীবনে তরুণেরা কীভাবে এই চেতনা ধারণ করছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
তরুণ প্রজন্ম : চেতনার বাস্তব প্রয়োগ
আজকের তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির যুগে বাস করছে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গ্লোবালাইজেশনের জোয়ারে তাদের জীবন অনেক বেশি গতিশীল। তবে এই গতিশীলতার মধ্যে বিজয়ের চেতনা কতটা প্রাসঙ্গিক?
১. অতীতের সঙ্গে দূরত্ব : আজকের অনেক তরুণই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে সঠিক ধারণা রাখে না। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র থাকলেও তা শুধু পরীক্ষার পড়া হয়ে রয়ে যায়। বাস্তব জীবনে তাদের মনে বিজয়ের চেতনার গভীরতা তৈরি হয় না। যখন তরুণেরা ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলে, তখন তারা স্বাধীনতার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। এই সংযোগহীনতা শুধু ঐতিহাসিক জ্ঞানের অভাব নয়, বরং জাতীয় পরিচয়ের সংকট তৈরি করে।
২. অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত : কিছু তরুণ সমাজের নানা অবক্ষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্তি, দুর্নীতি, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় তাদের মধ্যে বিজয়ের চেতনা ধারণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় তরুণেরা জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিল, সেখানে আজ কিছু তরুণ সমাজের ক্ষতি করছে। এর পেছনে রয়েছে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব এবং মূল্যবোধের সংকট। তবে এই অবক্ষয় সব সময় বিদ্যমান ছিল না। অতীতে তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কঠিন পরিস্থিতি সামলেছে, সমাজের সকল দিক থেকে একত্রিত হয়েছিল। তখন যে চেতনা তাদের মধ্যে ছিল, তা ছিল সৎ, সংগ্রামী এবং আত্মত্যাগী। আজও আমরা চাই, আমাদের তরুণেরা সেই চেতনা থেকে শিক্ষা নিক এবং এগিয়ে আসুক সমাজের পরিবর্তন ও উন্নয়নের জন্য।
বিজয়ের চেতনার প্রয়োজনীয়তা
তরুণ প্রজন্মকে বিজয়ের চেতনায় উজ্জীবিত করার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক। তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা এবং ঐতিহাসিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
একটি জাতি তখনই উন্নতি করে, যখন তার নাগরিকেরা সঠিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয় এবং একে অপরকে সহযোগিতা করে। বিজয়ের চেতনা একটি জাতির উন্নতি এবং ঐক্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমাদের তরুণদের এই চেতনা বুঝতে হবে, যাতে তারা জাতির ভবিষ্যৎ গঠন করতে সক্ষম হয়।
উদাহরণস্বরূপ একজন তরুণ, রাশেদ, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার পিতামাতার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে সে বড় হয়েছে। তার জীবনের লক্ষ্য ছিল একটি স্টার্টআপ তৈরি করা, যা স্থানীয় কৃষকদের পণ্য সরবরাহের একটি প্ল্যাটফর্ম হবে। রাশেদ তার বিজয়ের চেতনা থেকে শিখেছিল যে সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই সফলতা আসে।
রাশেদের উদ্যোগ আজ স্থানীয় কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেছে। এটি বিজয়ের চেতনাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার একটি দৃষ্টান্ত। তার মতো তরুণদের প্রয়োজন, যারা স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে এবং তা সমাজে বাস্তবায়ন করে।
এ ছাড়া বিজয়ের চেতনাকে তরুণদের মধ্যে আরও বিস্তৃত করার জন্য সমাজের অনেক ধরনের সৃজনশীল উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন উৎসবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তুলে ধরা যেতে পারে, যা তাদের মধ্যে জাতীয় গর্বের অনুভূতি জাগাতে সহায়তা করবে।
শিক্ষা এবং নেতৃত্ব
তরুণ প্রজন্মের কাছে বিজয়ের চেতনা পৌঁছে দেওয়ার প্রথম ধাপ হলো সঠিক শিক্ষা। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে সৃষ্টিশীল আলোচনা এবং কাজকর্ম দরকার। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক নাটক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে।
এভাবে শিক্ষামূলক কার্যক্রম তরুণদের মধ্যে বিজয়ের চেতনাকে প্রসারিত করতে সাহায্য করবে। এটি তাদের শুধু ইতিহাসের ওপর নয়, বরং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ওপরও দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে সক্ষম করবে।
তরুণদের মধ্যে একটি চেতনার উদ্রেক করা, যাতে তারা নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করে, দেশের জন্য কাজ করে, তা আজকের প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের শক্তি, নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি এবং দায়িত্ববোধ তৈরি করলেই তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে।
প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার
আজকের তরুণেরা প্রযুক্তিতে পারদর্শী। এই দক্ষতাকে ব্যবহার করে তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ডিজিটাল আকারে সংরক্ষণ এবং প্রচার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা নিয়ে তৈরি করা একটি অ্যাপ, যেখানে গল্প, ছবি এবং ভিডিওর মাধ্যমে তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারবে। ইতিহাস নিয়ে একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রজেক্টও করা যেতে পারে, যেখানে তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা নিজেদের চোখে দেখতে পাবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব নিয়ে প্রচারণা চালানো যেতে পারে, যা তরুণদের মধ্যে এটি সম্পর্কে আরও সজাগতা এবং গর্ব সৃষ্টি করবে।
পরিবার এবং সমাজের ভূমিকা
তরুণদের মধ্যে বিজয়ের চেতনা জাগ্রত করতে পরিবার এবং সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানো এবং তাদের মধ্যে দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করা। এ ছাড়া সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের মাদক, সন্ত্রাস এবং অপরাধ থেকে রক্ষা করতে। তাদের জন্য একটি নিরাপদ এবং সৃজনশীল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
বিজয়ের চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করতে হলে সমাজের প্রতিটি স্তরে উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে। মিডিয়া, স্কুল, পরিবারের উদ্যোগে তরুণেরা যদি সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা পায়, তাহলে তারা আগামীর নেতৃত্বে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
শেষ কথা
বিজয়ের চেতনা তরুণ প্রজন্মের জন্য শুধু একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা নয়, এটি একটি জীবনের দর্শন। তরুণেরাই জাতির ভবিষ্যৎ এবং তাদের মধ্যেই বিজয়ের চেতনার সঠিক প্রয়োগ আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যদি আমরা তরুণদের সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে পারি, তাহলে তারা সমাজের পরিবর্তনশীল শক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে। বিজয়ের চেতনা তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে এবং তারা একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041