ধামাইল নাচ

প্রকাশ : ২২ মে ২০২৫, ১২:৩৯ , অনলাইন ভার্সন
সৃষ্টির শুরুতে যখন মানুষ ইশারায় কথা বলত, তাকে নাচের অংশ বললে যেমন খুব ভুল হবে না, তেমনি মুখের ভাষার আগে নাচের জন্ম, এতেও কোনো ভুল নেই।
নৃত্য শব্দটি সাধারণত শারীরিক নড়াচড়ার প্রকাশভঙ্গিকে বোঝায়। এ প্রকাশভঙ্গি সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। গীতবাদ্যের ছন্দে অঙ্গভঙ্গির দ্বারা মঞ্চে চিত্রকল্প উপস্থাপনের ললিত কলাই নাচ। নাচ শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখে। অঞ্চল ভেদে কিছু বাংলা গান এবং নাচের আধিক্যতা দেখা যায়। তেমনি একটি জনপ্রিয় নাচ হচ্ছে ধামাইল। ধামাইল গান ও ধামাইল নাচ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের বিশেষ করে সুনামগঞ্জে প্রচলিত একজাতীয় কাহিনি সংবলিত মূলত নারীদের আচারকেন্দ্রিক বাংলা লোকগান এবং লোকনৃত্য, যা এই অঞ্চলসমূহের লোকসাহিত্যের একটি অংশ। ‘ধামা’ শব্দ থেকে ‘ধামাইল’ শব্দটির উৎপত্তি; এর অর্থ আবেশ বা ভাব। আবার আঞ্চলিক ও কথ্য হিসেবে এর অর্থ উঠোন। বাড়ির উঠোনে এই গান-নাচের আয়োজন করা হয় বলে একে ‘ধামাইল গান ও নাচ’ বলে। ধামাইল (ধামালি) মূলত নারীদের আচারকেন্দ্রিক নাচ-গান। সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলায় হিন্দু মেয়েরা ব্রত, পালা-পার্বণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এবং জন্ম, বিয়ে প্রভৃতি সামাজিক উৎসবে ঘটা করে ধামাইল নাচ-গান করে থাকে। বাড়ির খোলা আঙিনায় ২০-২৫ জন নারী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এরূপ কৃত্যানুষ্ঠান প্রদর্শন করে। সুরের দিক থেকে ভাটিয়ালি ঠাটের অন্তর্গত হলেও এতে দীর্ঘ টান বা মীড়ের দোলা নেই। করতালি দ্বারা গানের তাল রক্ষা করা হয়, স্বতন্ত্র বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। নাচের পদক্ষেপে বিশিষ্টতা আছেÑসামনে মাথা নিচু করে ও উপরে মাথা তুলে ঝুঁকে পর্যায়ক্রমে করতালি দেওয়া হয়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় করতালিকে ‘থাপরি’ বলে। করতালির সঙ্গে সমতা রেখে সামনে ও পেছনে পদক্ষেপ বদল করে বৃত্তাকার ঘূর্ণনে নাচতে হয়।
ধামাইল নাচ-গান পরিবেশনে পেছনের পায়ের সম্মুখভাগ মাত্র মাটি স্পর্শ করে, গোড়ালি থাকে উপরে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ডান ও বাম পায়ের বদল ঘটাতে হয়। ধামালি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক আদি রসাত্মক গান। গানের নমুনা :
১.
যমুনা পুলিনে শ্যাম নাগরি ত্রিভঙ্গ,
এমন মধুর মুরলী ধনি দহিতেছে অঙ্গ।
আয় ললিতে, আয় বিশাখে/ শ্যামকে এনে দে।
যায় যদি রাইর কুলমান পাই যদি তারে,
আমার মন হইয়াছে উড়াল পাখি/ প্রাণে প্রেম তরঙ্গ ॥
এটি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কথোপকথনমূলক লোকগীতি। একে ‘কৃষ্ণ ধামাইল’ বলে। রাধাকৃষ্ণের প্রেম ছাড়া পার্থিব বিষয় নিয়েও ধামাইল গানের প্রচলন আছে। একে ‘লৌকিক ধামাইল’ বলে।
২.
আজ কেন রে যৈবন তুই
মিছে পাগল করিস রে, হায়।
ধোপ কাপড়ে কালির ফোঁটা, মাধব
যাবে যৌবন, রবে খোঁটা।...
আড়ায় যেমন ময়না রে পোষে,
ও মাধব, ছুটে গেলি আর না আসে। আড়ায় যেমন ময়না রে পাখি,
ও মাধব, তাই দেখি প্রাণ বেঁধে রাখি ফরিদপুর।
উত্তরবঙ্গে ঘটনার বর্ণনা, পাত্র-পাত্রীর আলাপচারিতা, উক্তি-প্রত্যুক্তি সংবলিত লৌকিক ধারার ধামালি গান আজও প্রচলিত আছে।
ধামাইল প্রাচীন ধারার লোকসংগীত। পণ্ডিতগণ মনে করেন, চৌদ্দ শতকের কবি বড়ু চণ্ডীদাস লোক-প্রচলিত ধামালি ও ঝুমুর গানের আঙ্গিক থেকে প্রেরণা লাভ করে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচনা করেন। রঙ্গ-কৌতুক বা চাতুরী অর্থে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ধামালি শব্দের ব্যবহার আছে। ‘ধামালি বুলিতে কাহ্নে দিহলি আস। বাসলী শিরে বন্দী গাইল চণ্ডীদাস।’ (দানখণ্ড) ষোলো শতকে দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লাইলী-মজনু’ কাব্যে নাচ-গান অর্থে ‘ধামাল’ শব্দের ব্যবহার আছে। ‘বালেমু সুবদনী দোহঁ মিলি নিরজনিখেলত রঙ্গে ধামাল।’ (পৃ. ৯৮) সতেরো শতকে কাজী দৌলত ‘সতীময়না লোর-চন্দ্রানী’ কাব্যে একই অর্থে ‘ধামালি’ শব্দের ব্যবহার। এসব উক্তি ধামালি গান-নাচের প্রাচীনতা ও জনপ্রিয়তাকে সূচিত করে। ২০২৩ সালের ২৬ মে জাতীয় ধামাইল দিবস পালনের দাবি জানিয়ে সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ধামালি চুনারুঘাট’ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি দিয়ে জাতীয় ধামাইল দিবস পালন করে। প্রতিবছরই সিলেটের বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে ‘রাধারমণ স্মরণ দিবস’ ও ‘জাতীয় ধামাইল দিবস’ পালন করে। এ উপলক্ষে সংগঠনটির সভাপতি, লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক অ্যাডভোকেট মোস্তাক আহাম্মদ বাহার নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে ভারতের আসামের ‘সম্মিলিত লোকমঞ্চ, শিলচর’ আন্তর্জাতিক ধামাইল দিবস পালন করে। আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে, আমাদের যা একান্ত নিজস্ব সম্পদ, তা যেন আপন গৌরবের মহিমায় বেঁচে থাকুক যুগ যুগ ধরে। সবাইকে ধামাইল দিবসের শুভেচ্ছা।    
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041