
১৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী চীন থেকে এক দিন আগেই দেশে ফিরে আসেন। ১৪ তারিখে তিনি নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা (কোটা) পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’ আগুনে ঘি ঢাললে যেমন দপ করে জ্বলে ওঠে, প্রধানমন্ত্রীর এই বিদ্রƒপোক্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে তেমনি ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। উক্তিটি তার ‘স্লিপ অব টাং’ ছিল না অথবা মুখ ফসকে বলে ফেলেননি। তিনি বিশ্বাসের জায়গা থেকে উচ্চারণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধচেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহজাত টান ছিল তার। তবে এই উক্তি তার জন্য কাল হলো। সন্ধ্যায় টেলিভিশনে সংবাদ প্রচারিত হলে সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কোনোরূপ পূর্বঘোষণা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মধ্যরাতে হল থেকে বেরিয়ে এসে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন ও সমস্বরে স্লোগান দিতে থাকেন : ১৮. ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।/কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ পরের দিন (১৫ জুলাই) রাজাকার নিয়ে আরও নতুন স্লোগান তৈরি হয়। সে কথা পরে বলছি।
ছাত্ররা আশা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী চীন থেকে ফিরে তাদের আশার বাণী শোনাবেন, একটা কিছু যৌক্তিক সমাধান দেবেন। কিন্তু ঘটল উল্টোটা। তাদের ধারণা হয়, প্রধানমন্ত্রী ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে তাদের হেয়জ্ঞান ও অপমান করেছেন। ছাত্ররা সমাজের কাছ থেকে গালি নয়, সম্মান প্রত্যাশা করেন। পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সমাজে তাদের তেমন একটা স্থান নেই। ‘ছাত্রজীবন ম্যাটার করে’, হয়তো এমন অবদমিত অনুভূতি তাদের মধ্যে কাজ করছিল। প্রধানমন্ত্রীর অবজ্ঞাভাষণে একদিকে আশাভঙ্গ, অপরদিকে অপমানবোধÑউভয় কারণে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ওই স্লোগানের মধ্যে।
স্লোগানটির জন্মেতিহাস সম্পর্কে আন্দোলনের অন্যতম রূপকার মাহফুজ আলম বলেন, ‘আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমরা স্লোগানগুলো বানাচ্ছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল স্লোগানগুলোকে জাতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। ... আন্দোলনকারীরা যে নিজেদের ‘রাজাকার’ হিসেবে স্লোগান দিল, সেটা কিন্তু ‘রাজাকার’ বলে তাদের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত দেওয়া হয়েছে বলেই।’ ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নে’র সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, “রাতে শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিয়েছে। ... ওই রাতেই সমন্বয়কদের তরফে স্লোগানের খানিকটা পরিবর্তন এনে সেটিকে এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছিল, যাতে শ্লেষের দিকটা আরও স্পষ্ট হয়। তাদের উপস্থিত বুদ্ধিতেই ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানের সঙ্গে ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ আন্দোলনে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।” [প্রথম আলো, ৪-১১-২৪]
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যারা হামলাকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে, তাদের রাজাকার, আলবদর, আলশামস বলা হয়। যুদ্ধ চলাকালে দালালির এবং বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর ’৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যায় জঘন্য কৃতকর্মের জন্য তারা সমাজের চোখে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। ‘রাজাকার’ শব্দটা কালক্রমে গালিতে পরিণত হয়। হুমায়ূন আহমেদ একটি নাটকের সংলাপে ‘তুই রাজাকার’ গালি অর্থেই প্রয়োগ করেছিলেন।
রাজাকার প্রসঙ্গ এখানেই থেমে যায়নি, শিক্ষার্থীদের স্লোগানের বিরুদ্ধে সরকারি মহল থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। একই দিনে (১৫ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, এমনকি সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এ নিয়ে বিদ্রƒপাত্মক ও আক্রমণাত্মক মন্তব্য প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে এক ভাষণে আন্দোলনকারীদের রাজাকার স্লোগান দেওয়াকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও করে না।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আন্দোলন থেকে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা বা আচরণের প্রকাশ ঘটেছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে।” সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লেখেন, ‘যারা নিজেদেরকে রাজাকার বলে পরিচয় দেয়, তাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তস্নাত লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বা সে পতাকা কপালে বেঁধে মিছিল করার অধিকার থাকতে পারে না।’ শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল লেখেন, “যাদের মুখ থেকে বের হয়, ‘আমি রাজাকার’Ñতারা প্রমাণ করছে, তারা এ যুগের ‘সাচ্চা’ রাজাকার। তারা আদালত মানে না, সরকার মানে না, সুতরাং এই রাষ্ট্রদ্রোহীদের পক্ষে এই রাষ্ট্রকে মানা সম্ভব না।” তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত লেখেন, “যারা আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র মাটিকে অপবিত্র করেছে, তাদের প্রতি জানাই ধিক্কার।” ‘এডিটরস গিল্ডে’র সভাপতি মোজাম্মেল হক বাবু স্বাক্ষরিত ও গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ভেতর থেকে নিজেদের রাজাকার ঘোষণা দিয়ে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও একাত্তরের শহীদের আত্মদানের প্রতি অবমাননাকর।’ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরের বীর শহীদদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য দিচ্ছেন, তারা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ করছেন।’ শাবিপ্রবির প্রবীণ ও প্রখ্যাত অধ্যাপক জাফর ইকবাল নিজের একটি ওয়েবসাইটে লেখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আমার মনে হয়, আর কোনো দিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইব না। ঢাবির ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে এরাই হয়তো সেই রাজাকার। আর যে কয়দিন বেঁচে আছি, আমি কোনো রাজাকারের মুখ দেখতে চাই না।’ (প্রথম আলো, ১৬ ও ১৭ জুলাই, ২০২৪)।
এদিকে শিক্ষার্থীরাও তাদের দাবির ব্যাপারে অনড়। তারা সরকারের অভিযোগ, কটাক্ষ ও বিদ্রƒপের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে রাজাকারকেন্দ্রিক আরও কয়েকটি স্লোগান তৈরি করে আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন। যেমন ১৯. ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।’ ২০. ‘তুমি নও আমি নই, রাজাকার রাজাকার।’ ২১. ‘ছাত্ররা যদি রাজাকার, দেশটা তবে কার বাবার।‘ এ সবই ছিল তাদের আক্ষেপ ও অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ। দ্বিতীয়টি বুয়েটের ছাত্রমিছিলের স্লোগান ছিল। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোম ইকোনমিক্সের ছাত্রীদের প্ল্যাকার্ডে লিখিত আকারেও প্রকাশ পায়।
আলোচ্য স্লোগানের আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনাকে প্রথমবার প্রকাশ্যে ‘স্বৈরাচার’ বলে আখ্যাত করা হয়। এর পর থেকে ছাত্রদের এই নির্ভীক ও সাহসী উচ্চারণ আর বন্ধ হয়নি; রাজু ভাস্কর্যের সীমানা অতিক্রম করে নিমেষেই সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী অনেক স্লোগানে স্বৈরাচার শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে। পোস্টার-প্ল্যাকার্ডেও লিখিত হয়াছে। যেমন ২২. ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বৈরাচার পার পাবে না।’ ২৩. ‘স্বৈরাচার স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।’ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আবিদুল ইসলাম খান (ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘ওই রাতে রাজু ভাস্কর্য থেকে স্বৈরাচার শব্দের উত্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ দেয়।’ (প্রথম আলো, ৪-১১-২৪)।
ওই স্লোগান নিয়ে আমাদের আরও কিছু বলার আছে। আওয়ামী লীগের নেতা-পাতিনেতা, এমনকি দলবাজ বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘আত্মস্বীকৃত রাজাকার’, ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মা’, দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি বলে ক্ষান্ত হননি, পাল্টা স্লোগান বানিয়ে লড়াই শুরু করেন। যেমন আলোচ্য স্লোগানের বিপরীতে বলা হয়, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি।’ ২৩ নং স্লোগানের বিপরীতে ‘তোরা যত রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ স্লোগান দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে রাজাকার প্রসঙ্গ চলমান আন্দোলনসহ সার্বিক পরিস্থিতিকে বেশ উত্তপ্ত করে তোলে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ একে সরকার পতনের একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মনে করেন।
ওই স্লোগান সম্পর্কে আমাদের শেষ কথাÑএর ভাব ভাষা সুর ছন্দ অনুকরণ/অনুসরণে পরবর্তীকালে একাধিক স্লোগান রচিত হয়েছে। যেমন ২৪. ‘তুমি কে আমি কে, জেন-জি জেন-জি।’ ২৫. ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প।’ ২৬. ‘বিকল্প কে, আমি তুমি আমরা।’ ২৭. ‘দেশ কার, আমার আপনার সবার।’ ২৫ নং স্লোগানটির রচয়িতা লন্ডনপ্রবাসী চিত্রশিল্পী দেবাশিষ চক্রবর্তী। তিনি জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন ইস্যুতে কার্টুন এঁকে ফেসবুকে পোস্ট করেন। ১৬ তারিখে পোস্টকৃত ওই চিত্রে দেখা যায়, স্লোগানটি হলুদ রঙে তিন সারিতে লেখা হয়েছে, নিচে কালো রঙে অঙ্কিত মিছিলের মধ্যে একজন ছাত্র ডান হাত এবং একজন ছাত্রী বাম হাত উঁচু করে স্লোগান দিচ্ছে; উভয়ের হাত মুষ্টিবদ্ধ। পেছনের ক্যানভাসের রং লাল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকেরা প্রায় বলতেন, দেশে উন্নয়নের জোয়ার চলছে, এই উন্নয়ন ধরে রাখতে হলে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। এরই প্রেক্ষাপটে ২৫ ও ২৬ স্লোগান দুটি রচিত হয়েছে। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার মিছিল সেদিন বোঝাতে চেয়েছেÑস্বৈরাচার নয়, তারাই সরকারের বিকল্প। [চলবে]
ছাত্ররা আশা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী চীন থেকে ফিরে তাদের আশার বাণী শোনাবেন, একটা কিছু যৌক্তিক সমাধান দেবেন। কিন্তু ঘটল উল্টোটা। তাদের ধারণা হয়, প্রধানমন্ত্রী ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে তাদের হেয়জ্ঞান ও অপমান করেছেন। ছাত্ররা সমাজের কাছ থেকে গালি নয়, সম্মান প্রত্যাশা করেন। পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সমাজে তাদের তেমন একটা স্থান নেই। ‘ছাত্রজীবন ম্যাটার করে’, হয়তো এমন অবদমিত অনুভূতি তাদের মধ্যে কাজ করছিল। প্রধানমন্ত্রীর অবজ্ঞাভাষণে একদিকে আশাভঙ্গ, অপরদিকে অপমানবোধÑউভয় কারণে তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ওই স্লোগানের মধ্যে।
স্লোগানটির জন্মেতিহাস সম্পর্কে আন্দোলনের অন্যতম রূপকার মাহফুজ আলম বলেন, ‘আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমরা স্লোগানগুলো বানাচ্ছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল স্লোগানগুলোকে জাতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। ... আন্দোলনকারীরা যে নিজেদের ‘রাজাকার’ হিসেবে স্লোগান দিল, সেটা কিন্তু ‘রাজাকার’ বলে তাদের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত দেওয়া হয়েছে বলেই।’ ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নে’র সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, “রাতে শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দিয়েছে। ... ওই রাতেই সমন্বয়কদের তরফে স্লোগানের খানিকটা পরিবর্তন এনে সেটিকে এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছিল, যাতে শ্লেষের দিকটা আরও স্পষ্ট হয়। তাদের উপস্থিত বুদ্ধিতেই ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানের সঙ্গে ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ আন্দোলনে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।” [প্রথম আলো, ৪-১১-২৪]
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যারা হামলাকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে, তাদের রাজাকার, আলবদর, আলশামস বলা হয়। যুদ্ধ চলাকালে দালালির এবং বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর ’৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যায় জঘন্য কৃতকর্মের জন্য তারা সমাজের চোখে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। ‘রাজাকার’ শব্দটা কালক্রমে গালিতে পরিণত হয়। হুমায়ূন আহমেদ একটি নাটকের সংলাপে ‘তুই রাজাকার’ গালি অর্থেই প্রয়োগ করেছিলেন।
রাজাকার প্রসঙ্গ এখানেই থেমে যায়নি, শিক্ষার্থীদের স্লোগানের বিরুদ্ধে সরকারি মহল থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। একই দিনে (১৫ জুলাই) প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, এমনকি সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এ নিয়ে বিদ্রƒপাত্মক ও আক্রমণাত্মক মন্তব্য প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে এক ভাষণে আন্দোলনকারীদের রাজাকার স্লোগান দেওয়াকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও করে না।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আন্দোলন থেকে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা বা আচরণের প্রকাশ ঘটেছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে।” সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লেখেন, ‘যারা নিজেদেরকে রাজাকার বলে পরিচয় দেয়, তাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তস্নাত লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বা সে পতাকা কপালে বেঁধে মিছিল করার অধিকার থাকতে পারে না।’ শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল লেখেন, “যাদের মুখ থেকে বের হয়, ‘আমি রাজাকার’Ñতারা প্রমাণ করছে, তারা এ যুগের ‘সাচ্চা’ রাজাকার। তারা আদালত মানে না, সরকার মানে না, সুতরাং এই রাষ্ট্রদ্রোহীদের পক্ষে এই রাষ্ট্রকে মানা সম্ভব না।” তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত লেখেন, “যারা আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে স্লোগান দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র মাটিকে অপবিত্র করেছে, তাদের প্রতি জানাই ধিক্কার।” ‘এডিটরস গিল্ডে’র সভাপতি মোজাম্মেল হক বাবু স্বাক্ষরিত ও গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ভেতর থেকে নিজেদের রাজাকার ঘোষণা দিয়ে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও একাত্তরের শহীদের আত্মদানের প্রতি অবমাননাকর।’ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরের বীর শহীদদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য দিচ্ছেন, তারা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ করছেন।’ শাবিপ্রবির প্রবীণ ও প্রখ্যাত অধ্যাপক জাফর ইকবাল নিজের একটি ওয়েবসাইটে লেখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আমার মনে হয়, আর কোনো দিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইব না। ঢাবির ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে এরাই হয়তো সেই রাজাকার। আর যে কয়দিন বেঁচে আছি, আমি কোনো রাজাকারের মুখ দেখতে চাই না।’ (প্রথম আলো, ১৬ ও ১৭ জুলাই, ২০২৪)।
এদিকে শিক্ষার্থীরাও তাদের দাবির ব্যাপারে অনড়। তারা সরকারের অভিযোগ, কটাক্ষ ও বিদ্রƒপের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে রাজাকারকেন্দ্রিক আরও কয়েকটি স্লোগান তৈরি করে আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন। যেমন ১৯. ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।’ ২০. ‘তুমি নও আমি নই, রাজাকার রাজাকার।’ ২১. ‘ছাত্ররা যদি রাজাকার, দেশটা তবে কার বাবার।‘ এ সবই ছিল তাদের আক্ষেপ ও অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ। দ্বিতীয়টি বুয়েটের ছাত্রমিছিলের স্লোগান ছিল। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোম ইকোনমিক্সের ছাত্রীদের প্ল্যাকার্ডে লিখিত আকারেও প্রকাশ পায়।
আলোচ্য স্লোগানের আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনাকে প্রথমবার প্রকাশ্যে ‘স্বৈরাচার’ বলে আখ্যাত করা হয়। এর পর থেকে ছাত্রদের এই নির্ভীক ও সাহসী উচ্চারণ আর বন্ধ হয়নি; রাজু ভাস্কর্যের সীমানা অতিক্রম করে নিমেষেই সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী অনেক স্লোগানে স্বৈরাচার শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে। পোস্টার-প্ল্যাকার্ডেও লিখিত হয়াছে। যেমন ২২. ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বৈরাচার পার পাবে না।’ ২৩. ‘স্বৈরাচার স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।’ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী আবিদুল ইসলাম খান (ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘ওই রাতে রাজু ভাস্কর্য থেকে স্বৈরাচার শব্দের উত্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ দেয়।’ (প্রথম আলো, ৪-১১-২৪)।
ওই স্লোগান নিয়ে আমাদের আরও কিছু বলার আছে। আওয়ামী লীগের নেতা-পাতিনেতা, এমনকি দলবাজ বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘আত্মস্বীকৃত রাজাকার’, ‘পাকিস্তানের প্রেতাত্মা’, দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি বলে ক্ষান্ত হননি, পাল্টা স্লোগান বানিয়ে লড়াই শুরু করেন। যেমন আলোচ্য স্লোগানের বিপরীতে বলা হয়, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি।’ ২৩ নং স্লোগানের বিপরীতে ‘তোরা যত রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ স্লোগান দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে রাজাকার প্রসঙ্গ চলমান আন্দোলনসহ সার্বিক পরিস্থিতিকে বেশ উত্তপ্ত করে তোলে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ একে সরকার পতনের একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মনে করেন।
ওই স্লোগান সম্পর্কে আমাদের শেষ কথাÑএর ভাব ভাষা সুর ছন্দ অনুকরণ/অনুসরণে পরবর্তীকালে একাধিক স্লোগান রচিত হয়েছে। যেমন ২৪. ‘তুমি কে আমি কে, জেন-জি জেন-জি।’ ২৫. ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প।’ ২৬. ‘বিকল্প কে, আমি তুমি আমরা।’ ২৭. ‘দেশ কার, আমার আপনার সবার।’ ২৫ নং স্লোগানটির রচয়িতা লন্ডনপ্রবাসী চিত্রশিল্পী দেবাশিষ চক্রবর্তী। তিনি জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন ইস্যুতে কার্টুন এঁকে ফেসবুকে পোস্ট করেন। ১৬ তারিখে পোস্টকৃত ওই চিত্রে দেখা যায়, স্লোগানটি হলুদ রঙে তিন সারিতে লেখা হয়েছে, নিচে কালো রঙে অঙ্কিত মিছিলের মধ্যে একজন ছাত্র ডান হাত এবং একজন ছাত্রী বাম হাত উঁচু করে স্লোগান দিচ্ছে; উভয়ের হাত মুষ্টিবদ্ধ। পেছনের ক্যানভাসের রং লাল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকেরা প্রায় বলতেন, দেশে উন্নয়নের জোয়ার চলছে, এই উন্নয়ন ধরে রাখতে হলে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। এরই প্রেক্ষাপটে ২৫ ও ২৬ স্লোগান দুটি রচিত হয়েছে। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার মিছিল সেদিন বোঝাতে চেয়েছেÑস্বৈরাচার নয়, তারাই সরকারের বিকল্প। [চলবে]