আমার স্মৃতিতে বাবা

প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৫, ১১:২৯ , অনলাইন ভার্সন
‘তুমি কভু ফিরলে না, শোনালে না রেখে যাওয়া সুর
আছ কাছে, তবু হায় চলে গেছ কত না সে দূর।’
মানবজীবন ক্ষণস্থায়ী। এই বিশাল ধরণি-পটে একটি ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে কিছু সময়ের জন্য বেঁচে থাকতে পারলে আমরা হই কৃতজ্ঞ, গর্বিত। কারণ একদিন সামান্য ধূলিকণার মতো আমরা মিলিয়ে যাই এই মানবজগৎ থেকে, চলে যাই স্নেহময়ী এই ভুবনের মায়া ছেড়ে এক অপরিচিত ভুবনে। এই আমাদের জীবনধারা, এই আমাদের কালের প্রবাহ। পরিচিত মানুষটি ফেলে যায় কিছু স্মৃতি, রেখে যায় কিছু চিহ্ন, যেগুলোকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকে তার প্রিয় আপনজনেরা।

আত্মীয়তা সূত্রে, পারস্পরিক সাহচর্য অথবা একত্রে বসবাসের ফলে একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের যে পরিচয় ঘটে, বাবার সাথে তেমনটি হবার সুযোগ আমি পাইনি। বাবার সঙ্গে আমার পরিচয় বহুদিন আগে তোলা তার কিছু ছবি, রেখে যাওয়া ব্যবহার্য কিছু জিনিস আর মায়ের মুখ থেকে শোনা কিছু গল্পের মধ্য দিয়ে। আমার জীবনের যেটুকু সময়ে বাবা ছিলেন, সেই সময়ের কথা আমার ভাসা ভাসা মনে আছে। মায়ের কাছ থেকে জানা অনেক দিন আগের কিছু সুখ-দুঃখের ঘটনা আমার হারানো বাবার কথা মনে করিয়ে দেয়।

আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে অনার্স/মাস্টার্স করেছিলেন। তারপর তিনি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি করেন বায়োকেমিস্ট্রিতে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়, পাকিস্তানে। এর মাঝেই আমার মায়ের সাথে তাঁর বিয়ে, সংসার শুরু করাচি শহরে। তারপর স্কলারশিপ নিয়ে তিনি চলে যান সুদূর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই নিউট্রিশনের ওপর তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে তিনি পরিবার নিয়ে ফেরত আসেন।

মায়ের মুখে শুনেছি, খুব ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ ছিলেন বাবা, সহজে রাগ করতেন না। আর খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। নিয়মিত নামাজ কালাম পড়তেন, রোজা করতেন। সবার জন্য মনভরে দোয়া করতেন। খুবই সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন তিনি, নিতান্তই স্বল্প ছিল তাঁর চাহিদা। নিজের জন্য, প্রয়োজনের এতটুকুও বেশি খরচ করতেন না। কিন্তু পরিবারের অন্য সবার জন্য তাঁর চিন্তার অন্ত ছিল না। সবার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আর প্রয়োজনের প্রতি তিনি বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন। সন্তানের মঙ্গল কামনায় তিনি থাকতেন অধীর। আমার বাবা খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। বাবা খুবই পছন্দ করতেন ছুটির দিনে সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যেতে। সিনেমা, পিকনিক, রেস্তোরাঁ অথবা কোনো লং ড্রাইভে যাওয়াÑএসব ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়।

বাবা-মায়ের মমতা আর ভালোবাসায় তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারে সবচেয়ে ছোট সন্তান ছিলাম আমি। আমি সব সময় চাইতাম, বাবা যেন সবচেয়ে বেশি আমাকে ভালোবাসে, আদর করে। প্রতিদিন বায়না ধরতাম, অফিস থেকে ফেরার পথে বাবা যেন আমার জন্য কিছু কিনে নিয়ে আসেন। আমাদের দুজনার খুব প্রিয় একটি অভ্যাস ছিল। রাতের খাবার পর, আমরা ছাদে গিয়ে আকাশে তারা গুনতাম। আমি আকাশপানে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখতাম, গুচ্ছ গুচ্ছ তারা একসাথে পরিবারের মতো একেক জায়গায় জ্বলজ্বল করছে। দৃষ্টিসীমার এক পাশ থেকে শুরু করে গুনতে গুনতে আমি অন্য পাশে যেতাম। মজার ব্যাপার ছিল, দশ-বারোটা তারা গোনার পর আমি খেই হারিয়ে ফেলতাম, কোনটা গুনেছি আর কোনটা গুনিনি। তারা গোনা আর শেষ হতো না। কত দিন এই করতে করতেই বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছি।

পিতৃকন্যার এই আনন্দঘন সম্পর্ক পরে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। হঠাৎ একদিন আকাশ থেকে খসে পড়া তারার মতো, স্নেহ-ভালোবাসার সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে বাবা হারিয়ে গেলেন আমাদের কাছ থেকে। শৈশবের হেসে খেলে কেটে যাওয়া দিনগুলোর মাঝে হঠাৎ একদিন তাঁকে হারিয়ে ফেললাম আমি। আমাদের বাবা চলে গেলেন দূরে, বহুদূরে, এ মর্ত্যলোকের সীমা ছাড়িয়ে, অজানা এক অচিন লোকে।
বুকের মধ্যে প্রচণ্ড একটি চাপ, অসহ্য ব্যথা, অসম্ভব অস্থিরতা-হাসপাতালে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমার একজন মামা ওনার পাশে ছিলেন সে সময়। চলে যাওয়ার সময় বেশি কিছু বলে যেতে পারেননি। শুধু আফসোস করেছিলেন, তাঁর সন্তানেরা আর কখনো বাবা বলে কাউকে ডাকতে পারবে না। জীবনের শেষ মুহূর্তে চোখের সামনে আমাদেরকে দেখে যেতে পারেননি। চলে গেছেন বড় নীরবে, নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে।

সেই বিশেষ দিনটি এখনো আমার চোখে ভাসে। বাড়িভর্তি চেনা-অচেনা অনেক লোক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী। সবার চোখেমুখে তীব্র শোকের ছাপ। মা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে আমি সবার দিকে ব্যাকুল হয়ে তাকাচ্ছি। সেই অপ্রিয় সত্য কথাটি কেউ আমাকে বলছে না। শেষবারের মতো যখন তাঁর মুখখানি দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল, কী শান্ত, স্নিগ্ধ মুখশ্রী। স্মিত হাসি লেগে ছিল তাতে। কী গভীর শান্তিতে তিনি চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আমাদের সংসারের এক অতি প্রিয়জন তাঁর সব প্রিয়জনকে ছেড়ে যাত্রা করেছিল না ফেরার দেশে। কেউ তাঁকে থামাতে পারেনি।
সৃষ্টিকর্তা তাঁর হাতে গড়া প্রতিটি দিনকে শুভ্র, সুন্দর করে পাঠান আমাদের জন্য। ১৯২৭ সালের একটি শুভ দিনে তাঁর আগমন ঘটেছিল এই পৃথিবীর মাঝে। ১৯৭৬ সালের আরও একটি পবিত্র দিনে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, সকলের ভালোবাসাকে সঞ্চয় করে। মাঝে রেখে গেলেন তাঁর হাসি, আনন্দ, কিছু ক্ষণ, কিছু সময়। মানুষকে ভালোবেসে আর মানুষের ভালোবাসা পেয়ে যে জীবনে মৃত্যু আসে, সে জীবন ব্যর্থ নয়, তা সার্থকতায় পরিপূর্ণ।

পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে বাবা তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছিলেন। ২০১৫ সালে দেশে গিয়ে পাবনায় সেই এডওয়ার্ড কলেজ দেখতে গিয়েছিলাম। তার প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে আমি অনুভব করার চেষ্টা করেছি। হয়তো এখান দিয়েই বাবা হেঁটে যেতেন। হয়তো ওখানটাতে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করতেন আর এক সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন। প্রতিবার দেশে গিয়ে যখন বাবার কবর জিয়ারত করি, তাঁর মাথার পাশে বসে দোয়া করি, তখন মনে মনে ভাবি, বাবা, তুমি কি শুনতে পাও? তুমি কি জানতে পারো, তোমার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ কত বড় হয়েছে। আকাশের পানে তাকিয়ে সে আজও তারা গোনে।
বাবা আজ আমাদের মাঝে না থাকলেও ঐ দূর গগন পারে যেথায় নীলের পরে নীল, তারও পরে নীল একাকার হয়ে মিশে আছে, ঠিক তার মধ্যখানটাতে জ্বলজ্বলে একটি তারা হয়ে জ্বলছেন। রাতের আকাশে যার স্বর্গীয় দীপ্তি সমস্ত জগৎকে আলোকিত করে। সেই আলোর পথ ধরে বর্তমানের আমরা এগিয়ে চলেছি আগামীকালের সন্ধানে। যে পথের শেষে একদিন আবার দেখা হবে বাবা, তোমার সাথে।
লেখক : কলামিস্ট, প্রবন্ধকার। টেক্সাস।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078