আব্বার চলে যাওয়া

প্রকাশ : ১২ জুন ২০২৫, ১১:৩০ , অনলাইন ভার্সন
ইদানীং আব্বার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। হার্টের সমস্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শ্বাসকষ্ট। কিন্তু সিগারেট খাওয়াটা ছাড়তে পারছেন না। এই এক জায়গায় এসে যেন সব যুক্তি-তর্ক একেবারে মিথ্যা হয়ে যায়। অথচ আমরা সবাই বুঝি এসবকিছুর পেছনে সিগারেটের একটা ভূমিকা রয়েছে। কেবল আব্বাই বুঝতে রাজি নন। বুঝাতে গেলে রেগে যান। অতএব, আমরা এখন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। ইদানীং বিছানায় শুয়ে আর ১০ জন মানুষের মতো বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমাতে পারেন না- প্রায় সারা রাত বালিশে ‘ঠেশ দিয়ে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি আমার বাসায়। ডাক্তার দেখানোর কথা বলেই নিয়ে এসেছি। আব্বার ইচ্ছা তিনি ডা. খালিক সাহেবকে দেখাবেন। সিলেট শহরে তখন ডা. খালিককে সকলে এক বাক্যে চিনেন। প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। কিন্তু ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করার আগেই ঢাকা থেকে আমার ছোট ভাশুরকে আমাদের (স্বামী/স্ত্রী) দুজনকে কালকেই যেন ঢাকায় যাই এমন তাগিদ দিয়ে ফোন করেছেন। ছোট ভাই আমেরিকার নিউ ওরলিন্সে থাকেন। কলেজে শিক্ষকতা করেন।

কিন্তু বেশ কিছুদিন হয় তার ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এবার দীর্ঘদিন পর দেশে কিন্তু রাজি হলেন না তিনি। যখন দুই মাসের ভ্রমণ সূচী শেষ করে সিলেট থেকে বিদায় হয়ে ঢাকায় গেলেন আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে- হাতে মাত্র এক সপ্তাহ আছে। সেই রকম এক সময়ে তিনি আজকেই ফোন করে জানিয়েছেন ঢাকায় এক মহিলাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে অতএব বিয়েটা শেষ করে যেতে চান। অথচ আব্বাকে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম ডাক্তার দেখানোর জন্য ‘এই অবস্থায় আমার খালু সিলেট শহরের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরীকে আব্বার জন্য খালেক সাহেবকে যাতে দেখানো যায় তার অনুরোধ জানিয়ে ওইদিন রাতের ট্রেনে ঢাকায় রওনা হলাম আমরা। পরের দিন রাতে ভাসুরের বিয়ে- না গেলে খারাপ দেখায় অথচ মনটা পড়ে রইল বাসায়। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ- তখন ল্যান্ড ফোন ছাড়া আজকের মতো মোবাইল ফোনের কোন সুবিধা ছিল না। তারপরও বিয়ে বাড়ির কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাসায় ফোন করে আব্বার খবর নিচ্ছি। আম্মা বললেন মার্চ এর তিন তারিখ ডা. খালিক সাহেব আব্বাকে দেখার জন্য আমাদের বাসায় আসবেন। অর্থাৎ আগামী পরশু। 

দুই তারিখ বিয়ের কাজ শেষ হয়েছে আমরাও। ঠিক করেছি তিন তারিখ দুপুরের ট্রেনে সিলেট ফিরে যাবো। সকালে বাসায় ফোন করেছিলাম আব্বার সাথে কথা হলো, বললেন বিকেলে ডা. খালিক সাহেব তাকে দেখতে আসবেন। মাত্র তিন দিন ঢাকায় ছিলাম- বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ার মাঝে বাসার জন্য কোন বাজারই করতে পারিনি। রেলওয়ে স্টেশনে এসে একটা ম্যাকাবিনের বড় প্যাক কিনলাম আব্বার জন্য। যথারীতি ট্রেন এসে পৌঁছালো রাত ১০টায় সিলেট স্টেশনে। বাসা থেকে গাড়ি গেছে স্টেশনে- সেই গাড়ি নিয়েই রওনা হয়েছি। আমার বাসা হাউজিং এস্টেট এলাকায়। আম্বরখানা পার হয়ে শুধু হাউজিং এস্টেটের গলির মুখে ঢুকেছি চোখ আটকে গেল যেন রোড থেকে আমার বাসা পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে প্রাইভেট গাড়ির সারিবদ্ধ লাইন। গাড়ি থেকে নামতেই আত্মীয়স্বজন এগিয়ে এলেন। কেউ হাত থেকে ব্যাগ নিচ্ছেন। কেউ এগিয়ে এসে হাত ধরে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছেন। তখনও মাথায় ঢুকছে না এত লোক কেন এই সময় আমার বাসায়? সামনের বেডরুমে যেখানে আব্বা এলে থাকেন সেই রুমের দরজায় দাঁড়িয়েই হাত পা কাঁপা শুরু হয়েছে আমার- আপাদস্তক সাদা থান কাপড়ে ঢাকা কেউ একজন যেন শুয়ে আছেন- কিন্তু কে? কার শরীর এমন শ্বেত শুভ্র কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে? নির্বাক প্রতিমার মতো আমার মা পাশের রুমে বসে আছেন। উত্তরহীন কয়েকটা মুহূর্ত আমার কাছে তখন কয়েক বছরের সমান হয়ে উঠেছে- শুধু আম্মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-কী করে হলো? সকালেও ফোনে আব্বার সঙ্গে কথা হলো, এতটা খারাপ ছিল না শরীর, কই একটুও বুঝিনি তখন?
আমার খালা এগিয়ে এসে হাত ধরে চেয়ারে বসালেন। বললেন- শান্ত হও। তোমার আব্বা হার্ট ফেইল করেছেন। আর আমাদের সবাইকে যেতে হবে একদিন, প্লিজ শান্ত হও তুমি? পেছন ফিরে তাকালামÑ আট ভাইবোনের এত বড় পরিবার, সবগুলো ভাইবোনই ছোটছোট আর এই মুহূর্তে আব্বা চলে গেলেন! কী হবে তারপর? কী গভীর অন্ধকার সময় সামনে পড়ে আছেÑ সেই পথ পাড়ি দিতে হবে আব্বাকে ছাড়া?

সবকিছুই ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন হলো। আব্বাকে সমাহিত করা হলো দরগাহে শাহ জালাল (রহ.) এ। আব্বা মারা যাওয়ার পরের দিন খবর পেয়ে এক বই বাঁধাইয়ের ঘর থেকে একজন ভদ্রলোক এসে বাঁধাই করা সাহিত্য বিষয়ক এক ম্যাগাজিনের বড় এক কপি তুলে দিলেন আমাদের হাতে। বললেন- বইটা বাঁধাইয়ের জন্য ‘রব চৌধুরী’ সাহেব আমার কাছে দিয়েছিলেন-। আমার আব্বার নাম ছিল আব্দুর রব চৌধুরী। সেই বাঁধাই করা বইটা হাতে নিয়ে নির্বাক হয়ে রইলাম- ভদ্রলোকের পাওনা মিটিয়ে দিয়েছিÑ সেই সঙ্গে মারা যাওয়ার খবর শুনে বইটা দিতে এসেছেন বলে কতৃজ্ঞতাও জানিয়েছিÑ। কিন্তু মন কিছুতেই মানতে পারছে না যার সঙ্গে সকালে ফোনে কথা বললাম, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সেই তিনি লাশ বনে গেলেন কী করে?

আসলে ডা. খালিক সাহেবের ওপর এত আস্থা ছিল আব্বার। ভাবতেন খালিক সাহেব একবার দেখলেই তার অসুবিধাগুলো ধরতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত সেই ডাক্তারই তার মারা যাওয়ার কারণ হয়ে ছিলেন- আম্মা বললেন, খালিক সাহেব বাসায় এসেই বললেন, ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে-। আপনার রেস্টের দরকার- সেজন্য একটা ইনজেকশন তিনি দাঁড়িয়ে থেকে দেওয়ালেন। ইনজেকশনটা ছিল মরফিন। আর তার পর ডাক্তার চলে যাওয়ার আধাঘণ্টা ভেতরেই হার্ট ফেইল করলেন আব্বা। আমার এক চাচা ডাক্তার, যিনি ঢাকায় থাকেন- তিনি ফোন করে বললেন, মরফিন ইনজেকশন বাসায় দেওয়ার নিয়ম নেই। এই ইনজেকশন দিতে হলে সঙ্গে অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখতে হয়- সেজন্য রোগীকে হাসপাতালে রাখতে হয়Ñ উনি এটা বাসায় দিতে পারেন না- তোমরা চাইলে ডাক্তারের বিরুদ্ধে কেস করতে পার।
না কেস করতে আমার দাদী রাজি হলেন না। সে দাদী তার ১৮ বছর বয়সে আমার আব্বাকে আর এক ফুফুকে নিয়ে বিধবা হয়ে ছিলেন- সেই বয়োবৃদ্ধ দাদীর সামনে আমার আব্বাকে এমন ভুল চিকিৎসার কারণে বিদায় নিতে হলো-। তিনিই আপত্তি জানালেন। বললেন- কেস করলে আমার ছেলের লাশ নিয়ে টানাটানি হবে তার চেয়ে আমি ‘সবর’ করলাম।

আব্বাকে ছাড়া কেটে গেল আমাদের কত যুগ সময়- এখনও যখন কোন কোন কারণেই খুশির খবর আসে কিংবা কষ্টের কারণে হৃদয়টা তছনছ করে দেয় কোন কোন বিষয় তখন চিন্তা করি আব্বা থাকলে হয়ত এমন ঘটনা ঘটত না- হায় আরও কিছুটা সময় যদি শ্রষ্টা আমার জনককে ধার দিতেন তবে আমার ভাইবোনগুলোকে ঠিকমতো দাঁড় করিয়ে যেতে পারতেন তিনি- কত অপূর্ণতা আজ কেবল পেছন ফিরে তাকাতে বাধ্য করে।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078