স্মৃতির আলপনায় আঁকা

প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৫, ১৯:৪৫ , অনলাইন ভার্সন
আমাদের বাড়িটা বরিশাল শহরের একদম দক্ষিণে অবস্থিত। সাগরদী তার নাম। সাগরদী বরিশাল সিটি করপোরেশনের অধীন। ঢাকা-বরিশাল হাইওয়ের সঙ্গেই সিঅ্যান্ডবি পুল থেকে পশ্চিমের দিকে নামলেই আমাদের বাড়ির সীমানা শুরু। বিশাল বড় পরিবার আমাদের। মোট চারটা বাড়ি ভাগ হয়েছে। সেখানে অনেক পরিবার বাস করে। আমাদের আদি নিবাস কোথায়, তা জানি না। কয়েক পুরুষ ধরে আমরা এখানেই বসবাস করছি। মল্লিক বাড়ি বললে পুরো শহরের সবাই চেনে। রিকশাওয়ালারা একটানে নিয়ে আসতে পারে। মল্লিক বাড়িতে কোনো এক নিভৃত সকালে সম্ভবত আঁতুড়ঘরেই আমার জন্ম হয়েছে। আমার জন্মের সময়টাই-বা কীভাবে হয়েছিল, কখনো জানতে চাইনি। তখন দিন ছিল না রাত, তা-ও জানা নেই। মায়ের কাছ থেকে জানতে পারলে ভালো ছিল। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। এখন মা নেই। সে সময় টিনের চালের দোচালা ঘর ছিল আমাদের বাড়ির প্রায় সবার। ১৯৬১ সালের ৯ এপ্রিল আমার আসল জন্মসাল। সেটা জেনেছি পরে। যদিও সরকারি নথিপত্রে আমার জন্ম ১৯৬১ সালের ১৭ মার্চ। স্কুলের শিক্ষক এই তারিখ দিয়েছেন। তখন এটাই রেওয়াজ ছিল। স্কুলের শিক্ষকেরা আইডিয়ার মাধ্যমে একটা তারিখ দিয়ে দিতেন। তার মানে প্রকৃত জন্মতারিখের চেয়েও কয়েক দিন বেশি বয়স দেখানো হয়েছে। পুরোনো সেই ঘরবাড়ির স্মৃতি অতি পরিষ্কার মনে আছে আমার। দক্ষিণের ভিটায় পড়েছে আমাদের ঘরটা। তখন তো আর সিজারিয়ান ছিল না! ডাক্তার বা নার্সও কেউ ডাকত কি না সন্দেহ। হয়তো কোনো দাইয়ের হাতেই আমি এই পৃথিবীর আলো দেখেছি। কেমন ছিল সেই মুহূর্তটি, কে জানে! যখন আমার বাবা মারা যান, তখন আমার মাত্র দুই বছর বয়স। মানুষ কি দুই বছরের স্মৃতি মনে করতে পারে! আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি আমার বাবার কথা মনে করতে পারি। চোখ বন্ধ করলে তাঁকে যেন অস্পষ্ট দেখতে পাই। একটা অবয়ব ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মুখভরা দাড়ি, সৌম্য চেহারার একজন মানুষ। জানি না এটা কল্পনা কি না। নাকি সত্যি তিনি আসেন স্মৃতিতে! অবাক কাণ্ড, তাঁর একটা ছবি পর্যন্ত নেই কারও কাছে। বাবার কত বয়স হয়েছিল, তা-ও জানি না। আমি কোনো দিন জানতে পারব না আমার বাবা দেখতে কেমন ছিলেন! কোনো মানে হয়!
আমার শৈশবকালটা যতই সাদামাটা থাক না কেন, সেখানে আনন্দ আর ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। ওই সময় সবারই প্রায় এমনই থাকে। ষাটের দশকের পরিবারগুলো এমনই ছিল। কোনো জাঁকজমক ছিল না। ওটাই ওই সময়ের সৌন্দর্য ছিল। সাধারণ এক কিশোরকাল ছিল আমার কিন্তু সেটাই ছিল বিরাট আনন্দের। তখন আমার মা ছিল, ভাইবোনেরা ছিল, খেলার সাথিরা ছিল। মনের মধ্যে সব সময় একটা আনন্দের শিহরন কুলকুল করে বয়ে যেত। মা ছিল বলে নিজেকে কখনো অসহায় মনে হয়নি। মনে হতো, আমি কখনো একা নই। মনে হতো, আমার মা পাশে আছে। সবার ছোট ছিলাম বলে মা চোখে চোখে রাখত। মা ছিল আমার শক্তির জায়গা। মা যত দিন বেঁচে ছিল, যত দূরেই ছিলাম কোনো শূন্যতা অনুভব করিনি। বড় হয়ে সংসার শুরু করার পরও মায়ের কাছে সব সময় বুদ্ধি-পরামর্শ পেতাম। এখন যেমন আমার সন্তান অর্ক-অরিত্রির কাছ থেকে পরামর্শ নিই। ওরা ঠান্ডা মাথার মানুষ। সঠিক পরামর্শ দিতে পারে। ওদের কাছে গেলে মনে হয়, যেন আবার ছোট হয়ে গেছি। শৈশবে ফিরে গেছি। সোনাঝরা শৈশব। আবার শিশু হয়ে মায়ের কোলে ফিরে গেছি যেন। খেলার সাথিদের যেন দেখতে পাই চোখ বন্ধ করলেই। পরিষ্কার সব দেখতে পাই। মাঠ, ঘাট, উঠোন, পুকুর, খালবিল সব।
শৈশবে আমি খুব দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম। হেন কোনো দুষ্টুমি নেই, যা আমি করিনি। কখনো একা, কখনো দলবেঁধে এসব করতাম। পুরো পাড়া মাতিয়ে রাখতাম। আমার দুরন্তপনা এতটাই প্রবল ছিল যে বাড়ির দু-একজন মুরব্বি তাদের সন্তানদের আমার সঙ্গে মিশতে দিতেন না, ওরা নষ্ট হয়ে যাবে এই ভয়ে। আমার মাকে এ জন্য কম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়নি। মা শুধু কষ্ট পেতেন। ভাবতেন, আমার ছেলেটা কেন যে এমন হলো! অনেক শাসন করতেন। চোখে চোখে রাখতেন। কখন কী করে বসি, তার ঠিক নাই। সারা দিন পাড়া, মহল্লা দাপিয়ে বেড়াই। সেই বয়সেই স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখা শুরু করি। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে, টিয়াখালি রাস্তা বলে, সেটা দিয়ে সুন্দর সুন্দর মেয়েরা স্কুলে যেত। সেই রূপসী কন্যাদের দেখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। তখন থেকেই ঘুড়ি ওড়াতাম, সুতায় মাঞ্জা দিতাম, কাটা ঘুড়ির পেছনে দৌড়াতাম। ক্যাপস্টান, ব্রিস্টল, স্টার সিগারেটের কাগজ দিয়ে চারা খেলতাম, মার্বেল খেলতাম। সে সময় মার্বেল খেলত রাস্তার ছেলেরা। সাত চারা খেলতাম, সাইকেলের রিং চালাতাম সিঅ্যান্ডবি রোডে। বেয়ারিং দিয়ে তিন চাকার গাড়ি বানিয়ে চালাতাম। একজনকে পেছন থেকে ধাক্কা দিতে হতো। তারপর ঘরঘর করে চলত। খেলাধুলা করতাম তখন খুব। আমাদের মল্লিক বাড়ির নিজস্ব খেলার মাঠ আছে কয়েকটা। সেই সব মাঠে নানা ধরনের খেলাধুলার প্রচলন ছিল। আমি নিজেও আয়োজকদের একজন ছিলাম। ফুটবল, হাডুডু, হকি, ক্রিকেট খেলতাম। শীতের সময় রাতে লাইট জ্বালিয়ে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতাম। হাইজাম্প, লংজাম্প, দৌড় প্রতিযোগিতা হতো। বড়রা করত নাটক। সবকিছুতেই আমার অংশগ্রহণ থাকত। ব্যাডমিন্টন আমার খুব প্রিয় খেলা ছিল। বাড়ির পুকুরে বা খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতাম। গায়ের চামড়া সাদা হয়ে যেত, তা-ও পানি থেকে উঠতাম না। মা এসে টেনে তুলে নিয়ে যেত, আর আচ্ছামতো পিটুনি দিত। সাঁতার শিখেছিও একা একা। নৌকা বাইতাম মামাবাড়ি গেলে, ডিঙি উল্টে কতবার পানিতে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছি। কলাগাছের ভেলায় ভেসে বেড়াতাম পুকুরে। মামাতো ভাইদের সঙ্গে বিড়ি ফুঁককাম। শীতের দিনে পানিতে ডুব দিয়ে শিং, কৈ ধরেছি। শিং মাছের কাঁটায় কতবার রক্ত বের হয়েছে। চিনে জোঁক একবার ধরলে সহজে ছাড়ানো যেত না। শীতের দিনে ধান মাড়াই হতো। গরুর পেছন পেছন ছুটতাম, রাতে সেদ্ধ ধানের নাড়ার মধ্যে ঘুমাতাম। দারুণ ওম ছিল।
একটু বড় হয়ে সেভেন-এইটে পড়ার সময় থেকেই লাইব্রেরিতে যাওয়ার হাতেখড়ি। তখন আমাদের বাড়িতে একটা পাঠাগার ছিল। নাম ছিল ইকবাল পাঠাগার অ্যান্ড ক্লাব। সেখানে বই ছিল, ক্যারম বোর্ড ছিল, দাবা ছিলÑসেসব খেলতাম। দাবা খেলাটা যে কে আবিষ্কার করে! বড্ড জটিল। তাসও তেমনই। কখনো শেখা হলো না। মাঝে মাঝে বই নাড়াচাড়া করতাম। দু-একটা সংবাদপত্র রাখা হতো। বই পড়তে গিয়েই আমার মনের পরিবর্তন ঘটল। পাড়ার লাইব্রেরির পরিবর্তে আমি বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরির খোঁজ পেলাম একদিন। ১২-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত আমার দুরন্তপনার স্থায়িত্বকাল ছিল। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ফটিকের মতো ছিল আমার স্বভাব। তারপর হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম, আমি আর সেই আমি নেই। আমি বদলে যাচ্ছি। নির্জনতা আমার পছন্দ। আমার খেলার সাথিরা খুবই অবাক হতো। মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মা মনে করতেন, আমার মাথার সমস্যা হয়েছে। মাথায় ঘুঘু ডাকছে। হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে আমার মাথায় ঘুঘু ডাকত। আমি একা হয়ে যেতাম। একা একা ঘুরতাম, নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলতাম। কারও সঙ্গে মিশতে ইচ্ছে করত না। শুধু বইয়ের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে উঠল। কলেজে উঠেও তা-ই। পেনপলস করতাম। আমার একশর বেশি পত্রবন্ধু ছিল কলেজ-জীবন থেকেই। তাদের নিয়মিত চিঠি লিখতাম। নিজের কথা শেয়ার করতাম।
কৈশোর থেকেই আমার মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কল্পনা কাজ করত। কিন্তু কোনো একটা কল্পনা বা ইচ্ছাই বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারত না। এখনো যেমন আমার মনটা ঠিক কৈশোরের মতোই চঞ্চল রয়ে গেছে। মন মুহূর্তে একটা জায়গা থেকে লাফ দিয়ে অন্যত্র চলে যায়। কিছুতেই এক জায়গায় স্থির থাকে না। আমি আমার এই মনোজাগতিক সমস্যা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পাইনি। যদিও-বা কেউ কোনো সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছে কিন্তু তা আমি অনুসরণ করিনি। আচ্ছা, আমি কি কখনো নিজেকে শুধরাতে পারব? নিজেকে প্রায়ই এই প্রশ্ন আমি করি। আমি কখনো কারও অধীন নই। যত দিন মায়ের ছায়াতলে ছিলাম, তত দিন একটা নিয়মের ঘেরাটোপে মা আমাকে বন্দী করে রেখেছিল। আমি যতটুকু শেখার, তখনই মায়ের কাছ থেকে শিখেছি। যখন আমার ১৯ বছর বয়স, মায়ের ছায়াতল থেকে বেরিয়ে পড়লাম, তখন থেকে আমি পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে গেলাম। কেউ আর আমাকে বাঁধতে পারেনি। এমনকি আমি আমার দীর্ঘ সংসার-জীবনেও একই রকম রয়ে গেছি। আমাকে ঠিক নিয়ন্ত্রণ করা যাকে বলে, সেটা কেউ করে উঠতে পারেনি। সেই চেষ্টা কেউ করলে হিতে বিপরীত হয়েছে। অথচ আমি কি কখনো চাইনি আমাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করুক? আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু সবাই তার নিজের মতো করে সব করতে চায়। তখনই আমার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। পালাই পালাই করে। আমার এই চঞ্চল মনকে কেউ কখনো সঠিকভাবে বাগে আনতে পারেনি বা পারলেও আমি বুঝতে পারিনি। আমার শৈশব-কৈশোর সময়টা একটু হেলাফেলা টাইপ ছিলÑএ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। কোনো মূল্য ছিল না অন্যের চোখে। কেউ তেমন খেয়াল করত না আমাকে। আমি নীরবে বেড়ে ওঠা এক মানুষ। অন্যদের কাছে ছিলাম অবহেলার পাত্র। আমার বয়সী যারা ছিল, তারা অনেক কিছু করত, অনেক কিছু পেত, আমি পেতাম না। আমি কিছু চাইতামও না সহজে। চাওয়ার সাহসও আমার ছিল না। একমাত্র আমার মা সব বুঝতেন। কিন্তু আমার চাহিদা পূরণের সামর্থ্য তার ছিল না। আমার তেমন বড় কোনো চাহিদা ছিল না।
আমি খুবই কল্পনাবিলাসী তখন থেকেই। কল্পনার ভেলা ভাসাতে আমার জুড়ি নাই। এখনো প্রায়ই আমি গাড়ি চালাতে চালাতে কল্পনার জগতে হারিয়ে যাই। ভুলে যাই কোথায় যাব। আমার কল্পনাগুলো সব সময় লাগামছাড়া। আমার জীবনের সঙ্গে যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি যে রকম একটা গণ্ডিবদ্ধ জীবনে বড় হচ্ছিলাম, তাতে আমার যথেষ্ট ভীত হওয়ার কারণ ছিল। আমি ভাবতাম, এই জীবন থেকে কখনো বের হয়ে আসতে পারব না। আমি যে কখনো কারও অধীন হব না বা কারও আজ্ঞাবহ হব না, এটা তখনো আমি জানতাম না। এতটা স্বাধীনচেতা মনোভাব তখনো আমার গড়ে ওঠেনি। একটা অনিশ্চয়তার আতঙ্ক সব সময় আমাকে ঘিরে ছিল। আমাকে সাহস জোগানোর কেউ ছিল না। তাই আজও এতটা বয়সেও আমার মধ্যে একধরনের ইনসিকিউরিটি আছে। ওসব আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। স্কুলে যখন পড়ি, তখন থেকেই আমার কাপড়চোপড়ের অভাব ছিল প্রচণ্ড। সবারই থাকে। তখনকার বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারে এমনই ছিল। সেই অভাব কলেজ, ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত ছিল। একটা-দুইটার বেশি কাপড় আমার ছিল না। পাজামা পরে স্কুলে যেতাম। জাইঙ্গা থাকত না। জানতামও না যে আন্ডার গার্মেন্টস বলে কিছু লাগে। একবার আমার ক্লাসের বন্ধু লাবু আমাকে লজ্জা দিয়েছিল কেন জাইঙ্গা পরে আসিনি। কিম্ভুত নাকি লাগছে আমাকে। আমি বাড়ি চলে এসেছিলাম স্কুল থেকে। আরেকবারের ঘটনা। আমি তখন ক্লাস সিক্স, সেভেনে পড়ি। একদিন হঠাৎ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান এলেন ক্লাস ভিজিটে। অত্র অঞ্চলে খুব দাপট লোকটার তখন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হঠাৎ করে বেশ পয়সাওয়ালা হয়েছে। ছিল টিনের ঘর। রাতারাতি বিল্ডিং উঠে গেছে বাড়িতে। লোকটা আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিল। আমি সেদিন প্রোপার ড্রেস পরে আসিনি, এটাই আমার অপরাধ। সেদিন আমি মনের দুঃখে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।
সে সময় আমি মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি ঢাপরকাঠি গিয়ে থাকতাম বছরে দু-তিন মাস। সেটা প্রায়ই যেতাম শীতের সময়। তীব্র শীতে মায়ের বুকের মধ্যে গুটিশুটি মেরে ঘুমাতাম। মায়ের শরীরের ওম আমাকে উষ্ণতা দিত। টিনের চালের ঘরে ফাঁকফোকর দিয়ে ঠান্ডা ঢুকে পড়ত। মনে হতো, কাথা-কম্বলের ওপর কে যেন ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। সকালে রোদ উঠত অনেক দেরি করে। কুয়াশায় ছেয়ে থাকত দিগন্ত। রোদটা উঠতে না উঠতেই আবার সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসত। শীতের বিকেলে আমরা দল বেঁধে ধানখেতে নেমে পড়তাম। ঘুড়ি ওড়াতাম পাতা দিয়ে। নাড়া কাটতাম (ধান কেটে নেওয়ার পর অবশিষ্টাংশ) ধারালো কাঁচি দিয়ে (একধরনের খাঁজ কাটা)। বড় মামি আখের গুড় দিয়ে নাড়ু আর মোয়া বানাতেন, সেসব খেতাম মজা করে। আমার বয়সী মামাতো বোনদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। সকালে নাশতা হিসেবে আমরা পান্তা ভাত খেতাম। বরফের মতো ঠান্ডা ভাত, সাথে জমে যাওয়া জিয়ল মাছের তরকারি। কই শিং মাগুর শোল সরপুঁটি। আহ্্ কী স্বাদ ছিল সেসবের। তরকারি গরম করে খাওয়ার প্রচলন বা একটা ম্যাচের কাঠি খরচ করে চুলা জ্বালানোর মতো বিলাসিতা ছিল না। আমার জন্য ছিল একটা সেগুন কাঠের পিঁড়ি। বেশ বড়সড় পিঁড়ি। দেখতে সুন্দর। আমি আসন পেতে বসতে পারতাম। আর ছিল ঝকঝকে কাঁসার একটা থালা। সারা বছর এই দুটো জিনিস তোলা থাকত। আমি গেলেই শুধু বের করা হতো। তখনো ডাইনিং টেবিল কী জিনিস, আমি জানতাম না।
১৩-১৪ বছর বয়সে আমি প্রথম ডাইনিং টেবিল দেখি। আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে ডাইনিং টেবিলে বসে খেয়েছিলাম। আমাদের বরিশালের বাড়িতে আমরা কাঠের চৌকির ওপর বসে সবাই মিলে খেতাম। আমার মা রান্না করে থালায় ভাত বেড়ে দিতেন। আমরা হালুম হুলুম করে খেতাম। মা যা-ই রান্না করতেন, তা-ই ছিল অমৃত। তখনো সিদ্দিকা কবিরের বই বাজারে আসেনি। এলেও লাভ ছিল না। আমার মা লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু আমার মায়ের বোঝার ক্ষমতা ছিল খুব ভালো। শীতের সময় ছোট্ট ছোট্ট ডোবার মধ্যে কী করে এত মাছ থাকে! অবাক কাণ্ড। ভরা বর্ষার সময় ডালপালা ফেলে রাখা হতো। যখন শীত আসত, পানি কমে যেত, তখন পানি সেচে থকথকে কাদার মধ্য থেকে জিয়ল মাছ মেরে কলসি ভরে রেখে দিত। ছয় মাস প্রায় সেই মাছ খাওয়া হতো। মামাবাড়িতে কয়েকটা পুকুর ছিল। বছরান্তে পুকুর সেচে ফেলা হতো। তখন তো আর সেচযন্ত্র ছিল না। পুকুরপাড়ে মাচা বানিয়ে সেখানে মুড়ির টিন কেটে দড়ি বেঁধে পানি সেচা হতো। ম্যানুয়ালি। কয়েক দিন লেগে যেত। তারপর সবাই মিলে মহা উৎসবে মাছ ধরা চলত। খুব মিস করছি আমার সেই পিঁড়ি আর কাঁসার থালাকে। পেছনে ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর আমাকে টানে। খুব টানে। স্মৃতি ছাড়া মানুষের কিছুই থাকে না। আমার মা-বাবা, নানা-নানি, মামারা আজ কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু স্মৃতিগুলো পড়ে আছে। আমার সেই পিঁড়ি আর কাঁসার থালাটা কি আছে! কে জানে! (চলবে)
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078