কমিউনিটিতে বাড়ছে প্রতারক-ধান্ধাবাজ ও জালিয়াত চক্র, ক্ষুণ্ন হচ্ছে সুনাম

তাদের এক পা কারাগারে  আরেক পা সমাজসেবায়!

প্রকাশ : ২২ অগাস্ট ২০২৫, ০০:১০ , অনলাইন ভার্সন
সৎ ও বৈধ উপায়ে এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পাহাড়সম সাফল্য বয়ে এনেছেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা অগণিত। তাদের অনেকেই পরিবার, সমাজ এবং মাতৃভূমি বাংলাদেশের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নিজেকে নানাভাবে উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশি কমিউনিটিকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কিন্তু হাতেগোনা কিছু লোক এই প্রবাসে রাতারাতি বড়লোক হতে গিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছেন। ক্ষুণ্ন করছেন কমিউনিটির সুনাম। এদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে যত বাংলাদেশি বসবাস করেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। তবে নানান সূত্র থেকে ধারণা করা যায়, এই সংখ্যা ১ মিলিয়নের কম হবেনা। যার মধ্যে ৮ লাখের মত বসবাস করেন নিউইয়র্কে। ২০২০ সালে করোনা মহামারীর আগের তিন দশকে নিউইয়র্কে মর্টগেজ প্রতারণা, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, কলিং কার্ড জালিয়াতি, ধাক্কা পার্টিসহ ছোট ছোট স্ক্যামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল কিছু বাংলাদেশি। এসব কাজে তাদের ‘গুরু’ ছিল পাকিস্তানি অপরাধী চক্র। জালিয়াতি ও প্রতারণায় তাদের সহযোগী হিসাবে কাজ করতো বাংলাদেশিরা। এখন অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির পুর্ণ সদ্ব্যবহার করছে বাংলাদেশি একটি চক্র। এখন শুধু মর্টগেজ বা ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি নয়, বড় বড় স্ক্যামের সঙ্গে বাংলাদেশিদের নাম আসছে। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের প্রতারণার তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ততা। গত এক দশকে কমপক্ষে ১০ জন বাংলাদেশি এসব অপরাধের দায়ে আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হয়েছেন। তাদের কয়েকজন নিউইয়র্কের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলাদেশি দুজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পালাক্রমে কারাভোগ করছেন। তারা হঠাৎ উধাও হয়ে যাচ্ছেন। কখনো তিন মাস, আবার কখনো ছয় মাস কারাভোগ শেষে কমিউনিটিতে ফিরে এসে নানান গল্প ছেড়ে দিচ্ছেন এই বলে যে তারা ইউরোপ সফরে ছিলেন। কখনো বলছেন বাংলাদেশে ছিলেন, আবার ব্যবসায়িক কাজে চীনে গিয়েছিলেন বলছেন। সেখানে শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছেন। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে- সরকারি বা লোনের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাদের ২০-২৫ বছরের সাজা হয়েছে। কিছু অর্থ ফেরত দিয়ে তারা সাজা কমিয়ে এনেছেন অথবা পালাক্রমে সাজা খাটছেন। ওই দুই ব্যবসায়ীর পায়ে চিপ পরানো আছে, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে যেতে না পারে। তবে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুজন ব্যবসায়ী তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় চিপ অপসারণ করে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন। ওই দুই ব্যবসায়ী বাংলাদেশে অবস্থান করলেও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন সেখান থেকে। বাংলাদেশ-ভারত-ফিলিপাইন ও পাকিস্তানি স্ক্যামার চক্রের সাথে তাদের যোগসূত্র রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। 
সূত্রটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কোনোভাবে স্ক্যামারদের দমন করতে পারছে না। বিভিন্ন সময় স্ক্যামারদের শনাক্ত করতে পারলেও তাদের আটক করতে পারছে না। এসব স্ক্যামাররা মানুষের তথ্য চুরি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ব্যাংক, ক্রেডিট কার্ড ও শেয়ার বাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের শিকার হয়ে অনেকে পুলিশে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। 
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আইডেন্টিটি থেফট প্রতিরোধে প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়েও স্ক্যামারদের দমন করতে পারছেন না। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অধিকতর তদন্তে স্ক্যামারদের আটক করেছে। লজ্জাজনক ব্যাপার হলো- আটককৃতদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের নাগরিকদের সাথে বাংলাদেশিরাও জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ মিলছে। গত মে মাসে ব্রুকলিনের সুপ্রিম কোর্টে একজন বাংলাদেশি স্ক্যামারের শুনানি শেষ হয়েছে। তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ২০ বছরের সাজা হতে পারে। ওই বাংলাদেশি স্ক্যামারের গ্রামের বাড়ি বৃহত্তর চট্টগ্রামে। 
এদিকে আমেরিকায় পড়তে আসা শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা ও স্বপ্নপূরণের লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তাদের অনেকেই কখনও অজান্তে, কখনও ইচ্ছায় জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর স্ক্যামিং চক্রে। এই স্ক্যামাররা সাধারণত ছাত্রদের আর্থিক সংকট, আইনি অজ্ঞতা বা সহজ-সরল স্বভাবকে কাজে লাগিয়ে তাদের ব্যবহার করে ভয়াবহ অপরাধে।
ভূয়া এসএমএস-এর মাধ্যমে চাকরির প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে বেশ কয়েকজন স্ক্যামিংয়ে জড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি কুইন্সে গ্রেপ্তার হওয়া একজন ছাত্র এফবিআই’র হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। তিন বছর আগে স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসা ওই শিক্ষার্থী অর্থের লোভে খুব সহজেই ক্যামারদের ফাঁদে পড়ে নিজেকে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে। ফেডারেল পুলিশ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ওই ছাত্রটি প্রথমে এসএমএস-এর মাধ্যমে ঘরে বসে কাজ করার অফার পায়। তার কাজ ছিল নিজের ফেসবুকে বাসা ভাড়ার মিথ্যা বিজ্ঞাপন পোস্ট করা। সুন্দর লোকেশনে বাসা ভাড়া পোস্ট করার পরে যারা ফোন করেন তাদের অগ্রিম অর্থ দিতে বলেন। এভাবে বহু লোকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিত ওই ছাত্র। প্রথম ধাপে উন্নীত হওয়ার পর স্ক্যামার চক্রটি তাকে আরো বড় অ্যাসাইমেন্ট দিত। এভাবে ওই ছাত্রই একসময় নিজেই বড় স্ক্যামার হয়ে ওঠে। 
আরেকটি ঘটনা- যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে এসে আরেকজন ছাত্র যুক্ত হয়ে পড়েন এক বৃদ্ধকে লক্ষ্য করে পরিচালিত স্ক্যামে। একজন ৮৩ বছর বয়সী মানুষকে এফডিআইসি এজেন্ট পরিচয়ে ভয় দেখিয়ে ২৫ হাজার ডলার হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তিনি জেলে আটক হন। তিনি দাবি করেন, এই অর্থ তার ভাইয়ের জন্য নিচ্ছিলেন। কিন্তু আইন তার এই যুক্তি মানেনি এবং এখন তার শিক্ষাজীবন, ভিসা, এমনকি ভবিষ্যৎ সবই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে তিনি কারাভোগ করছেন। 
নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে মর্গেজ প্রতারকরা এখনো সক্রিয়। তারা নতুন নতুন কৌশল যোগ করেছে প্রতারণায়। নিলামে বাড়ি কেনার মাধ্যমে প্রতারকরা সাধারণ মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অনেকে নিজেই বাড়ির মালিক হচ্ছেন। পরে তা বিক্রি করে মোটা অংকের মালিক হচ্ছেন। পরে সেই অর্থ অন্য খাতে বিনিয়োগ করছেন।  
বাংলাদেশি কমিউনিটির একজন কথিত ব্যবসায়ী আছে যার প্রধান ব্যবসা ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করা। অন্তত তিনশ ক্রেডিট কার্ড আছে তার, যার মালিক সে নয়। বিভিন্ন ব্যক্তির তথ্য চুরি করে ক্রেডিট কার্ড আবেদন করে সে। এরপর লেনদেন করে লিমিট বাড়িয়ে নিয়ে রাতারাতি অর্থ তুলে ফেলে সে। বর্তমানে নিজ ব্যবসার কোনো অস্তিত্ব নেই এই প্রতারকের। রাতের বেলা জ্যাকসন হাইটসে অবস্থিত কথিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দরজা আটকে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন করাই তার প্রধান পেশা। অথচ এই প্রতারকই কমিউনিটিতে সমাজসেবক হিসাবে পরিচিত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইমিগ্রেশন ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পর এই প্রতারককে এখন আর কমিউনিটিতে খুববেশী দেখা যায় না। 
কুইন্সে আরেকজন ব্যবসায়ী আছে,  যার একসময় প্রধান পেশা ছিল ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ও মর্গেজ প্রতারণা। প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে গড়ে তুলেছেন ব্যবসার সাম্রাজ্য। জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের দায়ে এই প্রতিষ্ঠিত প্রতারক ব্যবসায়ীর লম্বা সময়ে কারাদণ্ড হয়েছে। এখন অর্থদণ্ড দিয়ে পালাক্রমে সাজা খাটছেন। এ কারণে ওই প্রতারক ব্যবসায়ীকে হঠাৎ দেখা যাচ্ছে না কমিউনিটিতে। 
বাংলাদেশি কমিউনিটিতে একজন মর্গেজ প্রতারক দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। তার সম্পত্তি, এমন কি নিজের বউও অন্য আরেকজন নিয়ে গেছে। কুইন্সের বিভিন্ন এলাকায় তার বাড়িতে চারজন কমিউনিটির লিডার বাস করছে, যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালন করছে।  
ইমিগ্রেশন সেবার নামেও বাংলাদেশি কমিউনিটিতে প্রতারণা বাড়ছে। ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান খুলে ইমিগ্রেশন প্রতারণা করছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। ইবি-১, ২ ও ৩ ভিসা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে কিছু প্রতিষ্ঠান মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 
গত বছর নিউইয়র্ক থেকে মেরিল্যান্ডে গোপনে চলে যাওয়া একজন বাংলাদেশি কথিত ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞকে গ্রেপ্তার করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। বিভিন্ন লোককে গ্রিন কার্ড পেতে সাহায্য করার কথা বলে মিথ্যা কাগজপত্র জমা দিয়ে ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ করে দিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন ওই ব্যক্তি। 
একজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি বাংলাদেশির বিরুদ্ধে তদন্ত করে। ভুক্তভোগীর অভিযোগ- গ্রিনকার্ডের জন্য তার কাছ থেকে ১০ হাজার ডলার নিয়েছে। এরপর একটি ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ করে দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন ওই বাংলাদেশি কথিত বিশেষজ্ঞ। 
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে অসংখ্য সম্প্রদায়ের মানুষ এ ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। আর এসব প্রতারণায় বহু বাংলাদেশি জড়িত বলে জানা গেছে। ইমিগ্রেশনের জটিলতা এড়িয়ে দ্রুত কাগজপত্র পাইয়ে দেবে, বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়। বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন ইমিগ্রেশন প্রতারণায় জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এ কারণে এ ধরনের প্রতারণায় বাংলাদেশিদের জড়িত থাকার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলে উদ্বেগ তৈরি করেছে। 
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078