চন্দন স্যার, কেঁদেও পাব না তাকে

প্রকাশ : ৩১ অগাস্ট ২০২৩, ১০:৫৬ , অনলাইন ভার্সন
খবরটা আপাতত পুরোনো হয়ে গেছে। তবু থামেনি ভেতরের কান্না। আপাতত শ্রাবণের বিষন্ন বৃষ্টিধারা নেই, আকাশও তাকিয়েছে মাথা তুলে। তবু কেবলই মনে যেনো হয় চন্দন স্যার, কেঁদেও পাব না তাকে কী নেই, কী নেই। একটা করুণ, কাতর গোঙানি চারপাশজুড়ে। একটা শূন্যতা। একটা হাহাকার। কান্না ছড়ানো দিনমান। বুকের ভেতর ডেকে চলছে এক ব্যাথিত ডাহুক। ভ্রাম্যমাণ বেদনার পরতে পরতে কত কথা, কত স্মৃতি।
তিনি উড়ে গেলেন একখণ্ড মেঘের মতো। তিনি আমাদের চোখের সামনে হারিয়ে গেলেন এক দলা তুলার মতো।  কঁচু পাতার বুকে জমা এক ফোঁটা বৃষ্টিজলের মতো টুপ করে তিনি হারিয়ে গেলেন। যেন ‘নয়ন সমুখে তিনি নেই’, তিনি ‘নয়নের মাঝখানে নিয়েছেন ঠাঁই’।
তিনি ছিলেন হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতো। তিনি ছিলেন আমাদের সক্রেটিস। তিনি ছিলেন কুমোরের মতো, কাদামাটি হাতে নিয়ে গড়েছেন কত মানুষ। তিনি ছিলেন চিত্রশিল্পীর মতো, এঁকেছেন কত শত জীবনছবি। তিনি ছিলেন অভিনেতা, আলো ছড়াতে ছড়াতে বিদায় নিলেন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে।
তিনি আমাদের চন্দন স্যার। রাধেশ্যাম রায় চন্দন। সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে তিনি ‘আছেন’ থেকে ‘ছিলেন’ হয়ে গেলেন; বর্তমান থেকে অতীত। রাধেশ্যাম থেকে স্বয়ং ‘কৃষ্ণ’ হয়ে গেলেন তিনি। রাধা হয়ে শ্যাম সমান মৃত্যুর বাড়িয়ে দেয়া দু’হাতে সমর্পন করে দিলেন নিজেকে। বৃন্দাবনের অতল ছায়ায় হারিয়ে গেলেন চিরকালের মতো। অযুত হৃদয়ের আকুলি বিকুলি ঠেলে চন্দন স্যার মিশে গেলেন তাঁর কাক্সিক্ষত অনন্ত আকাশে, পঞ্চভূতে হারিয়ে গেলেন কী অবলীলায়।


চন্দন স্যার বাংলাদেশের এক মফস্বলী জনপদ কুলাউড়ায় শিক্ষকতার দীপ্তি ছড়িয়েছেন অর্ধশতাব্দী ধরে। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গণে ছড়িয়ে ছিলেন সমান আভা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তিনি ছিলেন এক কিংবদন্তী। রাজপুত্রের মতো অঙ্গসৌষ্ঠব, বাঘের মতো তেজীকণ্ঠ আর কুসুমসম হৃদয় নিয়ে জড়িয়ে ছিলেন কুলাউড়ার শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর সুধীমহলের সাথে। অসাধারণ ব্যাক্তিত্বগুণে একটা সময় কুলাউড়ার স্বপ্ন-সম্ভাবনার সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বায়ান্নতে জন্ম নিয়ে বায়ান্ন বছর একাধারে শিক্ষকতা করেছেন। তেত্রিশ বছর কাটিয়েছেন কুলাউড়ার ঐতিহ্যবাহী নবীনচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে। অবসরের পর জালালাবাদ উচ্চবিদ্যালয় এবং ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলেও বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। ফলে আজ মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, ‘চন্দন স্যারের ছাত্র সংখ্যা কত?’
শুধু কি শিক্ষকতা? চন্দন স্যার ছিলেন সমাজ প্রগতির সংগ্রামেরও একনিষ্ঠ একজন। দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কুলাউড়ার নাট্যাঙ্গন। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় অভিনয় করেছেন সিরাজদৌল্লাহ নাটকের নাম ভূমিকায়। তারপর ‘এখনো ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ‘বেয়াদবি মাফ করবেন’, ‘ফাঁস’ ইত্যাদি নাটকে তাঁর অভিনয় ছিল উল্লেখযোগ্য। অভিনয়ে থেমে থাকেননি আমাদের চন্দন স্যার। ‘দর্পন নাট্যগোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কুলাউড়ায় নাট্য ও সংস্কৃতিচর্চায় স্বপ্নবীজ বুনেছিলেন তিনি। সমানতালে যুক্ত ছিলেন ক্রীড়াঙ্গণে। তারুণ্যের মনোজাগতিক বিকাশে বিতর্ক চর্চায়ও উৎসাহ যুগিয়েছেন অনেক বছর। সেই শৌর্যবান, মননঋদ্ধ, শিল্পীত জীবানাচারী, আমাদের ‘মহারাজা’, বেশ কিছুদিন অসুখের সাথে পাঞ্জা লড়ে হেরে গেলেন গত ২৩ আগস্ট। সেইসাথে অগনিত শিক্ষার্থী, শুভার্থীর হৃদয়ের আকাশ থেকে ঝরে পড়ল শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় এতোটা কাল যত্নে রাখা সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি। চন্দন স্যারের মৃত্যুর সাথে যবনিকাপাত হলো একটি অধ্যায়ের।
শেষে এসে যদি বলি, জীবনকে শুধু যাপন নয়, রীতিমতো উদ্যাপন করে গেছেন তিনি। বাহাত্তর বছরের একটি তাপস, দ্যোতনাময়, অর্থবহ জীবন তিনি হেসেখেলে কাটিয়ে গেছেন পরমানন্দে।
বস্তুতপক্ষে, মৃত্যুর সামনে এসে নির্বাক হয়ে যায় মানুষ। পেছনে আর জীবনকে দেখা যায় না। তবু বুঝি তখন তুমুল স্বাদ জাগে আরও কিছুদিন বাঁচি। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনা। কর্পূরের মতো উবে যায় জীবন। অন্যদিকে, কাহলিল জিবরান যখন বলেন, ‘জীবন দিয়েই মৃত্যুকে চেনা যায়’ কিংবা জীবনানন্দ যখন জানান- ‘সব ভালোবাসা যার বোঝা হলো,- দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে’- তখন প্রশ্ন জাগে, কোনটা সত্য!
সারা জীবন যে চন্দন স্যার ছড়িয়েছেন জ্ঞান-প্রজ্ঞার অমল মাধুরী, অমিয় চক্রবর্তীর ভাষায় বলি – ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।’ শুধু বলি, আমাদের চিরঋণ আপনার কাছে স্যার। শিক্ষক সবাই হতে পারে না। আপনি আমাদের হৃদয়-মন-মানসজগতের শিক্ষক। আপনি হারাবেন না, আড়াল হলেই হারিয়ে যায় না কেউ কেউ। আপনি মেঘ হয়ে উড়বেন, আমরা বৃষ্টি কামনা করব। আপনি পাখি হয়ে উড়বেন, আমরা আমাদের অজ্ঞতা দিয়ে হলেও একেবার একেক নাম দেব আপনার। আপনি বৃক্ষ হবেন, আমরা নীচে দাঁড়াবো খরতাপে, আপনি ছায়া দেবেন, আমরা পাতা কুঁড়াবো আপনার নাম নিয়ে। আপনি জল হবেন আমাদের স্বপ্ন সমুদ্রে, আমরা ঢেউগুলো জমাবো আশা নিয়ে। আপনি একটা মহার্ঘ গ্রন্থ হবেন, আমরা জীবনবোধ আর জীবন-সংগ্রামের পাঠ নেব সেখান।
তবু আপনাকে হারিয়ে যেতে দেব না স্যার...
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078