Thikana News
২৩ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

অতঃপর...

অতঃপর...
অতঃপর থেমে গেল তোমাকে দেখার দীর্ঘ অপেক্ষা! বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মাফুর ফোনটা হাতে নিয়েই। আমি যেন আর কাঁদতেও ভুলে গেছি। বুকের ভেতর তীব্র এক হাহাকার। স্বজন হারানোর তীব্র কষ্ট। এই কষ্ট আমি ১৯৮৬ সাল থেকেই পাচ্ছি। আমার নানুর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই যেন শুরু হয়েছিল। তারপর শ্বশুর, মা, বাবা, শাশুড়ি, খালা, খালু, চাচা, ফুপু, মামা, মামি একে একে সব চলে গেলেন। ভাইয়া যাওয়ার পর প্রচণ্ডভাবেই আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে গেলেন। স্বাভাবিক হতে পারিনি আজো গত চার বছরে।
আরও অনেক প্রিয় মানুষ চলে গেছে কাউকে কিছু না বলেই হঠাৎ করেই। এই যে না বলে চলে যাওয়া বড় বেহিসাবি যাওয়া যেন। খুব স্বাভাবিক এই নিয়ম, তবু আমি তো সেই সবার মতো স্বাভাবিক মানুষ নই বলেই হয়তো ভীষণভাবে ভাঙছি-গড়ছি আপন মনেই। ভেতরটা যেন একটা যমুনার ঢেউয়ে ঝুরঝুর করে কেবলই ভাঙছে অবিরাম।
জীবনে বহু মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা পেয়েছি। আশপাশের সবাইকেই যেন আমার চার দেয়ালের আপন মানুষ মনে হয়। যাদের জন্য মরতেও ইচ্ছে করে সব সময়। মনে হয়, আমি যদি অমুককে শরীরের একটা অঙ্গ দান করি, তাহলে সে বেঁচে যাবে আরও কয়েক বছর। শারীরিক কষ্টটা কমে যাবে হয়তো-বা। চিনি না জানি না সেসব মানুষের জন্যও এমন করে মন পোড়ে আমার! কত শত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি, অথচ তাদের দেখিওনি বা চিনিও না কস্মিনকালে।
১৯৯০ সালে আমার শ্বশুর তার সম্পত্তির অসিয়ত করে যান সন্তানদের মাঝে। কিন্তু রেজিস্ট্রি করে যাওয়ার আগেই স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন। এলপিআরে যাওয়ার আগেই। উনি বরিশাল আইডব্লিউটির ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যদিও আমার শ্বশুরবাড়ি মিলিটারির বাড়ি নামেই পরিচিত। ওনার চাকরিজীবনের প্রায় ২৪ বছর পাকিস্তানের এয়ারফোর্সে কেটেছে। যখন ফিরে আসেন, এলাকার সবাই ভাবত উনি মিলিটারিতে ছিলেন। রাশভারী ও অসম্ভব মার্জিত নিপাট স্মার্ট ভদ্রলোক। অফিস, বাসা আর বই ছাড়া ওনার অন্য কোনো জগৎ ছিল না। প্রায় সাড়ে চার বিঘার উপরে বাড়ি। ছয় ফুট দেয়াল দিয়ে বাড়িটি ঘেরা। বিশেষ পরিচিত ছাড়া আশপাশের লোকজন ঢুকতে খুব একটা সাহস পেত না। বাড়ির ভেতরে এক বিঘার ওপর একটি পুকুর। শহরে জমির যা দাম! কিন্তু উনি সেই পুকুর বন্ধ করেননি ভরাট করে। বলেছিলেন, এখানে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গোসল করবে, ঘাটে বসবে, গল্প করবে। পুকুরের চারদিকে নারিকেল, সুপারি ও বিভিন্ন গাছ সারি সারি করে লাগিয়েছিলেন। বলতে গেলে এত সুন্দর ও বড় বাড়ি ওই তল্লাটে আর একটিও নেই।
১৯৯২ সালের প্রথম দিকে বাচ্চাদের আব্বু বরিশালে গিয়ে বাড়ির কাজ ধরেন শ্বশুরের অসিয়তনামা অনুযায়ী। কাজের মাঝেই কাঠমিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ানের প্রয়োজন হলো। সবাই সুপারিশ করল রাস্তার মাথার পানের দোকানদারের শ্বশুরকে। উনি এলেন ছোট ছেলে স্বপনকে নিয়ে। সাত-আট মাস বাবা-ছেলে মিলেই আমাদের বাসার দরজা, জানালা, চৌকাঠ সবকিছু বানিয়েছিলেন। কাকা আমায় খুবই স্নেহ করতেন। আমি তার মেয়ের বয়সী। আমায় মা কাকি বলে ডাকতেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জীবনের নানান চড়াই-উতরাইয়ের গল্প করতেন।
কাকার বড় ছেলের নাম নারায়ণ। সংক্ষেপে নরা। ছোটখাটো চিকনচাকন। খুবই স্মার্ট ও ভদ্র। বাসায় এসে ছোট্ট করে হাসিমুখে সালাম দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকত। আমাকে ভাবি বলে ডাকত। আর বাচ্চার আব্বুকে স্যার। ৩৪০০ স্কয়ার ফিটের বাসার সবটুকু কাজ নরা করেছে। অনেক যত্ন করে যেখানে যেখানে যে বোর্ড, সুইচ, প্লাগ সবকিছুই সুন্দর করে লাগিয়েছিল। এর মাঝে আমার জীবনে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আমি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর চলে যাই। মরতে মরতে একটু সুস্থ হয়ে প্রায় এক বছর পর আবার বরিশালে ফিরে আসি।
আমার বন্ধুত্ব আপামর সবার সঙ্গেই। হতে পারে ফকির, সবজির ফেরিওয়ালা, মাছের ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা কিংবা কাজের বুয়া। মফস্বলের সবাই মনের অজান্তেই সবার কখন যে আপন হয়ে যায়, তা বোধ হয় কেউই জানে না। যখন পাড়াপড়শি সবাই শুনতে পেল যে আমি বেঁচে ফিরে এসেছি, মানুষজন দলে দলে একনজর দেখতে এসেছে। সে এক এলাহি কাণ্ড। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টায় ঘুমুতে পারতাম না শরীরের ব্যথায়। তার ওপর এত লোকের সমাগম! নরাও এল আমায় দেখতে। হাতে করে বেশ কিছু চকলেট আর শম্ভুর দোকানের বোম্বাই মরিচের ডালপুরি। সাথে তিন-চারটা মিষ্টি পানের খিলি। বাসায় এসে আমায় দেখেই হতবাক ও। হতভম্ব হয়েই যেন মাথা নিচু করে ফেলল! সারাটা শরীরে তখনো আমার ব্যান্ডেজের অবশিষ্ট। শরীরে বিকৃত রূপ। মাথার ওপর এক ইঞ্চি পরিমাণ চুল। ঘন কালো ঝকঝকে কালো যত্ন করা থ্রি স্টেপ কাট চুলগুলো আর নেই।
মুখের গঠন বিকৃতি ধারণ করেছে। এখানে সেখানে কালো, লাল দগদগে ঘা। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া শরীর! অনেক যত্নে শাড়ি পরা মানুষ আমি! অথচ আমার পরনে তখন আমার আম্মার পুরোনো শাড়িকে সেদ্ধ করে নরম করে নিমা বানিয়ে কোনো রকমে পেঁচিয়ে রাখা মৃত লাশের অবয়ব। কোনো রকমে জড়িয়ে রাখা একটা পেটিকোট। হাত, গলা, বুক আর পা প্রায় জোড়া লেগে গেছে পুড়ে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা নেই। পা ফেটে গ্রাফটিং করা স্কিন ফেটে অঝোরে রক্তাক্ত হচ্ছে ঘরের মেঝে। অনেকক্ষণ পরে নরা মাথা তুলে তাকাল। দু’চোখের কান্না যেন বাঁধ মানছে না । নাকের পানি আর চোখের পানি একাকার; ভারী ধরা গলায় বলল, ‘ভাবি, আপনি বেঁচে আসবেন, ফিরে এসেছেন, এটা যেন আমাকে সব সময় আল্লাহ বলেছেন বুকের ভেতর। আমি হলাম হিন্দু মানুষ। যদি আপনি না আসতেন, যদি খারাপ কিছু হয়েই যেত, আমি আপনার জানাজায় শামিল হতাম। সেটা আপনাকে বরিশালে ফিরিয়ে না আনলেও লোকজন নিয়ে আপনার গায়েবানা জানাজা পড়াতাম। আমি ধর্ম মানি না। আমি নাস্তিক। কিন্তু আপনিই যেন আমার ধর্ম। আমার বিশ্বাস, আপনিই আমার ভগবান। আমি হরিজন, আপনি আমার বাবাকে যে সম্মানে সম্মানিত করেছেন, যে স্নেহ আমাদের দিয়েছেন, তাতে করে তো আপনিই আমার ভগবান।’ আমার ভাইয়াকে উদ্দেশ করে গড় হয়ে প্রণাম করে বলল, ‘স্যারকে আমার প্রণাম বলবেন।’
আবার আমি ঢাকায় ফিরে আসি। প্রায় আট বছর পর আমি আবার ব্যাংকে জয়েন করি। মাঝে মাঝে বরিশালে যাই। ও আমাদের বাসায় আসে ছেলেকে নিয়ে। দেখা হয়, গল্প করি ওর সাথে, বাসার কোনো কাজ থাকলে বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসি ঢাকায়। নরা কাজ করে, অধীর বাবুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ফোন করি, খোঁজখবর নিই। তারপর এক যুগের বেশি আমি প্রবাসে।
ওর ফোন নাম্বার হারিয়ে ফেলি ফোন হারিয়ে ফেলাতে। তা ছাড়া ভৌগোলিক দূরত্ব আর সময়ের তারতম্য থাকাতে কথা হয় না বহুটা বছর। তবে কারও সাথে কথা হলে খোঁজখবর নিই।
বাসায় কাজ করত আজিজের মা, মায়া, খলিলের মা, রেহানার মা, নারিকেল-সুপারি পেড়ে দিত মতলেব, মাছওয়ালা জলিল, ভ্যানচালক সালাম, রিকশাচালক নেয়ামত, খলিল বাবুর্চি, ভিক্ষুক দুলালের মা, সখিনা, লম্ফা মাতারী (নাম জানি না, সবাই এই নামেই ডাকত)-এরাই আমার আপনজন, ভালোবাসার মানুষ। এদের সাথেই আমার হৃদয়ের বন্ধন। সবারই খবর নিই, জানতে ইচ্ছে করে। আমি এমন বলে আমার রাশভারী মা খুব বকতেন, রাগ করতেন। কী আর করা! আমি যে মানুষটাই এমন!
মাফুর সাথে আমার বিয়ের আগে থেকেই রিলেশন। বরিশালের প্রথম পরিচিত এক বছরের জুনিয়র ফ্রেন্ড। যতটা না ফ্রেন্ড, তারচেয়ে বেশি ছোট্ট বোনের মতোই। আজ ওর সাথে কথা বলতে বলতেই নরার বিষয়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম, নরার হেরে যাওয়ার সর্বনাশার গল্প।
দেড় বছর আগে নরা আত্মহত্যা করেছে। উন্নত যুগে বর্তমান সময়ের কাছে নরা হেরে গেছে। ছেলেটা বড় হয়ে ছোটখাটো কাজ করছে। বিয়ে করে আলাদাভাবে থাকলেও বাবাকে হেল্প করতে পারে খুব সামান্যই। নরার বউ স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায়। টুকটাক কাজ করে বাসায় এসে স্ত্রীর যত্ন, রান্না, ওষুধপথ্যের জোগান দিতে না পারা একজন অসহায় স্বামী।
সারা দিন কাজ করে ঘরে ফিরে দেখে স্ত্রী ডার্টি অবস্থায় বিছানায়। দিঘল চুল পর্যন্ত নোংরা হয়ে আছে। একে তো প্রচণ্ড ক্ষিদে, তার ওপর খাবার আছে একজনের মতো। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড রকম গরম। ক্লান্ত শরীর, মেজাজ বিগড়ে গিয়ে বিদ্রোহ করে মনের ওপর। রেগে গিয়ে বউকে দু-একটা চড় মেরে বসে। হঠাৎ বউয়ের কান্নায় সংবিৎ ফিরে পেলে অপরাধবোধ ও আত্মগ্লানিতে ঘরের পেছনের আমগাছের ডালে দড়ি বেঁধে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নির্দ্বিধায়। জানালার গ্রিলের বাইরে নরাকে দেখে চোখের পানি মুছতে মুছতে ঝুলে পড়তে। শুয়ে শুয়ে অসহায় বউ দেখে জানালা দিয়ে। গোঙানো শব্দ কারও কানে পৌঁছাতে পারে না। আমাকে দেবতা মানে, ভগবান মানে, বড় বোন হিসেবে প্রণাম করে, অথচ আমাকে কিছু জানাল না? কিছু বলতে ওর এতটা সংকোচ ছিল! মাথাটা সত্যিই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক হতে পারছি না। বুকের ভেতরে ড্রাম বাজছে ১১৫/১২০ বেগে। দু’হাতে বুক চেপেও থামাতে পারছি না। নরা, এ কী করলেন ভাই! আপনার বোন তো বেঁচে আছে। আমি একমুঠো খেলে কি আপনি না খেয়ে থাকতেন? এটুকুই বিশ্বাস ছিল আমার ওপর আপনার? নাকি এক মায়ের গর্ভে হইনি বলে? প্রশ্নটা আপনার ভগবানকে জিজ্ঞেস করবেন আর আমি আমার আল্লাহকে!
-আলবেনি, নিউইয়র্ক
 

কমেন্ট বক্স