Thikana News
১৮ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫

কষ্ট

কষ্ট
সকালে রুবি এসে দুবার ডেকে গেল। বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। কদিন ধরে শরীর-মন দুটোই কেমন বিগড়ে রয়েছে। কিছুই ভালো লাগে না। গত রাতে ভাত খাওয়ার সময় রুবি জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে তোমার?’
-শরীরটা ভালো যাচ্ছে না! মুখটা তেতো হয়ে আছে।
-জ্বর-টর হয়নি তো?
ডানির কপালে হাত বুলায় রুবি।
-না, তা তো না।
-তবে কী?
-বুঝি না।
-খাবারের পর একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়ো। আচ্ছা বলো তো, তুমি এত কী ভাবো?
-ভাবনার কি আর শেষ আছে, রুবি।
-এত ভাবনা কেন?
-বাপ-দাদার এই সমৃদ্ধ ভিটা, জমি-জিরাত সবই তো দেখছ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে!
-হ্যাঁ, আমরা এই বাস্তুভিটা ছেড়ে কোথায় যাব বলো? আমাদের তো আর কোথাও কিছু নেই!
বুক খালি করে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ডানির।
রাতে ভালো ঘুমও হয়নি। কী যেন উলট-পালট স্বপ্ন দেখেছে। ডান পায়ের হাঁটুর কাটা অংশের ওপর চিনচিনে ব্যথাটা আবার যন্ত্রণা দিচ্ছে। সে হাত বুলায় সেখানে।
-হায়রে ডানিয়েল কস্তা। কী পেলে তুমি তোমার এ জীবনে?

সকালে দরজা খোলার শব্দ হলো। রুবি ঢোকে ভেতরে।
-কই আর কত শুয়ে থাকবা। ওঠো, চা হয়ে গেছে।
রুবি এগিয়ে এসে ডানির কপালে হাত রাখে।
-না, জ্বর নেই তো।
-আজ যেন কী বার?
-শুক্রবার!
-ও, বিজয় তো বাড়ি আসবে।
-হ্যাঁ, তার তো আসতেই হবে। কাল ফোনে বলেছে, সরাসরি মিশনে চলে যাবে। সমিতির কাজ সেরে রাতে বাড়ি আসবে।
-ও। তো বউ-বাচ্চা নিয়ে আসবে না। নাতির ঠান্ডা-জ্বর কি কমেছে?
-না। শিউলি, দাদুভাই আসবে না। শুভ দাদুর ঠান্ডা-জ্বর একটু নাকি কমেছে।
-নাতিটা এ সপ্তায়ও আসবে না! ওকে না দেখলে যে আমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ি!
-তোমার মতো তো আমিও। এই তো আমাদের ভাগ্য! হ্যাঁ, ঈশ্বর ভরসা! এই শুনেছ?
-কী?
-গত রাতে ফেলু মামার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে!
-কী! ডাকাতি? ফেলু মামার বাড়িতে?
ব্যস্ত হয়ে উঠে বসে ডানি। চোখেমুখে বিস্ময় আর ক্ষোভ ফুটে ওঠে তার।
-হ্যাঁ, দীপু ভাই বলল।
-কাল তো তারা জমি বিক্রির টাকা পেয়েছে।
-আর এ জন্যই ডাকাতি! সব টাকা-পয়সা তো নিয়েছেই। অনেক মারধরও করেছে। ফেলু মামা তো হাসপাতালে ভর্তি।
-কী অবস্থা দেখলে রুবি! গত সপ্তায় শশী কাকাদের গোয়াল থেকে নিয়ে গেছে চারটা গরু। এর আগে মিশনের সিস্টারদের কনভেন্ট থেকেও নিয়ে গেছে দুটো গরু। এসবের কি কোনো বিচার হয়েছে?
-এই দেশটা আর কোনো দিন ঠিক হবে না! হ্যাঁ!
-দেশ না রুবি। দেশ আছে দেশের মতোই। বলো, আমাদের কথা। এই আমরা আর কখনো ঠিক হব না। কই, আমার ক্রাচ দুটো দাও তো।
-ওই তো। তোমার হাতের কাছেই।
-দেখলে রুবি। চোখের কাছের জিনিসও ঠিকমতো ঠাওর করতে পারি না! আমার চোখের জ্যোতিও গেছে!
-হ্যাঁ, যাবেই তো। আর কত কষ্ট সইবে? বুকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করে দেশটাকে তো স্বাধীন করেছিলে।
-কথায় কথায় খালি দেশ আর দেশ! তোমারও মাথাটা গেছে!
দুই ক্রাচের ওপর ভর করে বাইরে বারান্দার দিকে পা বাড়ায় ডানি। রুবি তাকে ধরে চেয়ারে বসতে সাহায্য করে।
-ও ডানিদা, ফেলু মামার খবর শুনেছ?
ব্যস্ত হয়ে দীপু প্রলম্বিত হেমন্তের সোনালি রোদ ভেঙে উঠানে এসে দাঁড়ায়।
-শুনেছি। তো ফেলু মামা কোন হাসপাতালে?
-কালীগঞ্জ। ডাকাইতরা ফেলু মামারে অনেক মাইর দিয়েছে গো ডানিদা!
-তুমি থাকো ডানিদা। চা-নাশতা করো। এই আমি যাচ্ছি হাসপাতালে।
-শোন দীপু। কী হবে আর হাসপাতালে গিয়ে। আজ ফেলু মামা, কাল আমি। এবার যে আমাদের একে একে শেষ হয়ে যাওয়ার পালা! হা! হা! হা! সত্যি আমার খুব হাসি পাচ্ছে। পরানভরে হাসতে ইচ্ছে করছে খুব। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে আমার একটি পা হারিয়েছি! ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে পেয়েছি একটি দেশ। কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ! আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ! হা! হা! হা!
-এই তুমি শান্ত হও তো! তোমার এ কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না!
রুবির দু’গাল বেয়ে কান্নার ধারা নামে।
-তুই যা, দীপু। আজ ফেলু মামাকে দেখতে যা। কাল যাবি আমাকে দেখতে। ধর্মান্ধ ওই পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা আমাদের সাধের দেশটার বুকে জেঁকে বসেছে! হ্যাঁ! হ্যাঁ! ওরা পাকিস্তানি প্রেতাত্মা! এরা সহজে ছাড়বে মনে করেছ?
-তুমি থামো, প্লিজ। মুখ ধুয়ে কিছু খাও। ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ডায়াবেটিস আর হাইপ্রেশার তো তোমার শরীরটাতে জেঁকে বসেছে। একেবারেই অর্ধেক হয়ে গিয়েছ তুমি! আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখেছ?
-রাখো তোমার ওষুধ! রাখো চেহারা! আমার কিছুই ভালো লাগে না আর! দেখো, আমাদের সবুজ-শ্যামল গ্রামের বুক চিরে কিসের নাকি বিশ্বরোড না বাইপাস গেছে। এখান দিয়ে এখন বাস, ট্রাক, লরি দৈত্য-দানবের মতো সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে যায়! আমাদের গ্রাম, আমাদের এলাকা আগের সেই সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে! এই রাক্ষুসে শহুরে চিত্র আমাদের সুখ, মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছে! উন্নয়নের নামে চলছে জোর-জবরদস্তি করে বাস্তুভিটা, ফসলি জমি অধিগ্রহণের মহাযজ্ঞ! গ্রামের মানুষ আমরা বাড়িঘর, জমি-জিরাত সব বেচে কোথায় চলে যাচ্ছি! দেখো, বাপ-দাদার বাস্তু হারিয়ে আমরা হন্যে হয়ে ঘুরছি! একটুকরো জমি খুঁজে মরছি মাথা গোঁজার জন্য! অর্থলিপ্সু জমির দালালরা শুধু এই আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। তাদের উৎপাতে এখন আমরা দিশাহারা! একরকম বাধ্য হয়েই আমরা, আমাদের বাপ-দাদার ঠিকানা পানির দামে ভূমিদস্যুদের হাতে তুলে দিচ্ছি। এই সুযোগে এখন আবার ডাকাতরা বাড়িতে বাড়িতে চড়াও হচ্ছে। শান্তিতে ঘুমাতেও পারছি না আমরা। রাত জেগে গ্রাম পাহারা দিতে হয়। এই কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফল? এই কি আমাদের স্বাধীনতা? এই কি আমাদের স্বাধীন দেশের নমুনা?
হা হা হা শব্দে উঁচু গলায় কেঁদে ওঠে ডানিয়েল কস্তা। তার হাহাকারের শব্দ হেমন্তের বাতাসকে ভারী করে তোলে। এলাকায় সকলের প্রিয় মুখ ডানি। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রাচের ওপর তার শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে চিনতে বড়ই কষ্ট হয় তার। বুকভরে শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সমস্ত অস্তিত্বে তার জমাটবাঁধা পাহাড়সমান কষ্ট, দিন দিন কেবল চেপেই বসছে!
দখিনের বিলে এই হেমন্তে পানি থাকার কথা ছিল। সেখানে পানকৌড়ি, মাছরাঙা, ডাহুক, সাদা বক পাখির অবাধ বিচরণের কথা ছিল। আরও কথা ছিল বিলের বুকজুড়ে সাদা, লাল শাপলা আর অদ্ভুত বেগুনি কচুরি ফুল হাসবে। গাঁয়ের কিশোর-কিশোরীরা হইচই করে ডিঙিনৌকা ভরে শাপলা তুলবে। গাঁয়ের সাধন, আগস্টিন, হেকমত, রহমত, হরিদাস, ক্ষীরোদ বিলের পাড়ে ডেরা-ঘর করে দিন-রাত মাছ ধরা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।
এখন সেখানে কিছুই নেই! আছে শুধু বালি আর বালি! পূর্বাচল উপশহর ধেয়ে আসছে, তার তথাকথিত ‘উন্নয়নের’ খড়্গ উঁচিয়ে! এখন বাতাসে ওড়ে শুধু বালি। সেই আগের সবুজ শ্যামলিমা বলতে যা আছে, ক্রমেই লোপাট হয়ে যাচ্ছে! কোথায় এখন আগের সেই চিরচেনা গ্রামের নান্দনিক চিত্র?
ইতিমধ্যে ভোরের সোনালি আভায় পরিস্নাত জনপদ জেগে ওঠে। কাছেই সটান পড়ে আছে আজরাইল-চেহারার ‘বাইপাস’ নামক অজগরটা। সারা রাত তার বুক কাঁপিয়ে সশব্দে দাপাদাপি করছে যত মালবোঝাই ট্রাক-লরি। ঘুমের ঘোরে গ্রামের অনেকেই দুঃস্বপ্নের বীভৎসতা বুকে চেপে আচমকা জেগে ওঠে! আর সেই দুঃস্বপ্নের ঘোর না কাটতেই দিনের উদ্বোধনীতেই আবার শুরু হয়ে যায় অভুক্ত অজগরের উচ্চমাত্রার ফোঁসফোঁসানি! এটি এখন এখানকার নিত্যদিনের, এলাকার সকলের কাছে জ্বালাময়ী চিত্র! কখন আবার কোন সমীর রোজারিও বেপরোয়া লরির নিচে বেঘোরে চাপা পড়ে! ট্রাকের ধাক্কায় ইজিবাইকের আরোহী রবি ক্রুজের বউ ছিটকে পড়ে কাঁটাময় ঝোপে! কার মুরগি, গরু, ছাগল যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে পড়ে থাকে কালো পিচের ওপর! কুড়ানির পেট্রোল পাম্পের কাছে পড়ে থাকে অজ্ঞাতনামা নারীর বস্তাবন্দী লাশ!
ডানিয়েল কস্তা চিৎকার করে বলতে চায়, ‘এত সমস্ত কিছু কিসের আলামত? আমরা কোথায় যাচ্ছি? হায় ঈশ্বর! আমাদের শেষ গন্তব্য কোথায়?’ কী এক শোকের মাতম বুকে চেপে তার বাড়ির উঠান বিমূর্ত হয়ে আছে! খোলা জানালার পরিসরে দৃষ্টি রেখে একবুক নিঃশ্বাস ছাড়ে ডানিয়েল। তার দু’চোখ কষ্টের প্রবল ধারায় সিক্ত হয়। সেই অবাধ ধারা দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। রুবিও নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। স্বামীর বেহাল-করুণ চিত্র দেখে সে আঁচলে নিজের চোখ-মুখ ঢাকে! তার বুকের চাপা কান্না সশব্দে মূর্ত হয়ে ওঠে।
দেখতে দেখতে ডানিয়েল কস্তার বাড়ির স্থবির উঠান, উৎকণ্ঠিত মানুষের পদচারণায় জেগে ওঠে। শেষ হেমন্তের শীতল বাতাস পাথরসম ভারী হয়ে ওঠে এখানে! কী এক দুঃসহ শোক সবাইকে সন্তপ্ত করে রেখেছে! অন্যদের সঙ্গে ডানিয়েলের ও রুবির পাশে এসে দাঁড়ায় বিনয়, সুনীল, সুবাস, সুশান্ত, নিকু, সন্তোষ, কিরণ, বকুল, মানিক ওরা। তাদের কারও মুখে ভাষা নেই। সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো উপায়ও জানা নেই তাদের। এ সময় তারাও সকলে ভাবছে দেশের গৌরব, সমাজের গৌরব মুক্তিযোদ্ধা ডানিদার মতো তারাও সবাই ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চাইছে। এই ডানিদার মতো তাদেরও সকলের বুকভরা শুধু কষ্ট আর কষ্ট! এ কষ্টের শেষ কখন? কোথায়?
[মিশনের সিস্টারদের কনভেন্ট : গির্জা প্রাঙ্গণে, খ্রিষ্টান ক্যাথলিক সন্ন্যাস-ব্রতিণীদের আবাস]
 

কমেন্ট বক্স