Thikana News
২৬ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করতে ডিসিদের নির্দেশ

‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা’ শাস্তির মুখোমুখি

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে সুযোগ সুবিধা নিলে ৭ বছর জেল হতে পারে * দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। ফারুক-ই আজম, উপদেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের
‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা’ শাস্তির মুখোমুখি ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ না করেও জালিয়াতির মাধ্যমে যারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলেন তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। দেশে প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েই গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অপূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করেছিল তৎকালীন সরকার। যেখানে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জনের নাম ছিল। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময় অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেছে। এমনকি বাংলাদেশে ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ঠিক কত, সে বিষয়ে এখনও পরিষ্কার তথ্য নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা জামুকা বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রায় আট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছে। সেই অনুযায়ী এগুলো বাতিল করা হয়েছে। ২০১৪ সালে পাঁচজন সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে সরকার, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। তখন সনদ বাতিলের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন।
গতকাল সোমবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ডিসি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় অধিবেশন শেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম বলেছেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। ডিসিরা অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন জায়গায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন এদের ব্যাপারে জেলায় জেলায় মুক্তিযোদ্ধারা খুবই সোচ্চার। এদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। এটাতে তারা সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা চান।
তিনি আরও বলেন, আমরা বলেছি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) পুনর্গঠন করা হয়েছে। জামুকার যে আইন ছিল সেটাতে সংশোধনী আনতে হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞার নিরিখে এই সংশোধনী আসছে। সংশোধনী আসার পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদও পুনর্গঠিত হবে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পুনর্গঠিত হলে প্রতিটি জেলায় যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে আমরা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করব। যাদের আমরা শনাক্ত করতে পারব তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব।
এর আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, বীর প্রতীক বলেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝখানে একটা প্রতিষ্ঠান ছিল, সেটা হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল- জামুকা। মুক্তিযোদ্ধা কারা হবে, না হবে সেটা জামুকা নির্ধারণ করে দিতো। মন্ত্রণালয় শুধু তাদের নির্ধারিত বিষয়টি বাস্তবায়ন করতো। এর আইনগত বিষয়াদি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে অনন্য ঘটনা। এটাকে আমরা হাসি-মশকরা কিংবা অবহেলায় নষ্ট করতে পারি না। এর থেকে গৌরবোজ্জ্বল, ত্যাগের ও বীরত্বের মহিমা জাতির কাছে আর নেই। যারা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা, তারা তা-ই ফিরে পেতে চায়। যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও সুবিধা নিয়ে থাকেন, তাহলে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। 
এদিকে, আইনজীবীরা বলছেন, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি সুবিধা ভোগ করা অপরাধ। আর ফৌজদারি আইনের ৪১৬ ধারা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিলে তাও অপরাধ। এছাড়া মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য ৩ বছরের জেল এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিলে ৭ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। হতে পারে অর্থদণ্ডও। মন্ত্রণালয় যদি চায় তাহলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে সংখ্যায় বেশি হওয়ায় সেটা সময় সাপেক্ষ হবে।
শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদে কমবেশি ১৮ হাজার ব্যক্তির নামে মুক্তিযোদ্ধার গেজেট জারি করেছে মন্ত্রণালয়। তাদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর মধ্যে আছেন হাসিনা সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়রও।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপে শত শত ব্যক্তির নামে মুক্তিযোদ্ধার গেজেট জারি হয়েছে। এমন অবস্থায় হাসিনা সরকারের আমলে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংস্কার করা হবে।’ গত ১৪ আগস্ট উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর তিনি আরো বলেন, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব ইসরাত চৌধুরী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে মোট ১৮ হাজার মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিষয়টি তদন্ত করা হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিতর্ক থাকায় ২০১১ সালে ষষ্ঠ দফায় নতুন করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে সরকার। এ জন্য অনলাইনে ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত গ্রহণ করা হয় প্রায় দেড় লাখ আবেদন। ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি আবেদন যাচাই-বাছাই শুরু হয় সারা দেশে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ের করা মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও যাচাই শুরু হয়। ২০২১ সালের ২৫ মার্চ ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার সমন্বিত তালিকা’র নামে কয়েক দফায় চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এখন পর্যন্ত সমন্বিত তালিকায় এক লাখ ৯৩ হাজার ৭৪৩ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার পুরো ১৬ বছরের শাসনামলে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্ত হতে হয়রানির শিকার হলেও মন্ত্রী-এমপি-মেয়রসহ দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেউ কেউ জামুকার বিশেষ কমিটির সুপারিশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির সুযোগ পেয়েছেন। অথচ তারা সময়মতো অনলাইনে বা সরাসরি আবেদন করেননি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যক্তিগত শুনানির মাধ্যমে সেসব আবেদন বিশেষ কমিটিতে পাঠাতেন। এই বিশেষ সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন বলেও অভিযোগ আছে। আবার আওয়ামী লীগ ছাড়া ভিন্ন মতাদর্শের লোকজন আবেদন করলেই তাদের আবেদন নানা অসিলায় বাতিল করে দেওয়া হতো। অভিযোগ আছে, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক হয়রানি করা হতো। উপজেলা-জেলা কমিটির সদস্যদের চাহিদা পূরণ করতে না পারলে ইতিবাচক প্রতিবেদন যেত না জামুকায়। আবার জামুকার সদস্য ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খুশি করার পরই মিলত কাঙ্ক্ষিত সুপারিশ। এ কারণে অনেক নামি-দামি বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধারা সনদের জন্য আর জামুকামুখী হতেন না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে বিএনপি-জামায়াতের মতাদর্শী মুক্তিযোদ্ধারা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করার কথা মুখেও আনতেন না। বরং বিএনপি-জামায়াতের (২০০১-২০০৬) আমলে যেসব গেজেট হয়েছিল তার একটি বড় অংশ নানা অজুহাতে বা পুনঃতদন্তের নামে বাতিল করা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন সরকারের আমলে পাঁচবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটি এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশ করেছিল। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের করা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। ১৯৯৪ সালে করা তৃতীয় তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে চতুর্থ তালিকায় এক লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জনের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়।

ঠিকানা/এসআর
 

কমেন্ট বক্স