জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্ট ঘিরে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের মধ্যে অনৈক্য অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দায়িত্বশীল নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে নতুন এ দলটিকে শুরুতেই অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারেও একধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে। ছাত্রনেতাদের অযাচিত মন্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যেও দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে বলেও অনেকের শঙ্কা।
ব্যাপক জনপ্রত্যাশা সৃষ্টি করে তৃতীয় ধারার এ রাজনৈতিক দলটি সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু একেবারে দল গঠনের প্রথম দিন থেকেই বিতর্ক যেন তাদের পিছু ছাড়ছে না। সঙ্গে নানামুখী অভিযোগের চাপও ঘিরে ধরেছে তারুণ্যনির্ভর দলটিকে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইনহাউস বৈঠকের তথ্য প্রকাশ্যে আনা এবং দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে একে অপরের বিরুদ্ধে মন্তব্য করার ঘটনায় এনসিপিকে নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এনসিপিকে যদি একের পর এক বিতর্ক ঘিরে ধরে এবং দেশবাসীকে আরও আশাহত হতে হয়, তাহলে নতুন এ দলটির পথচলা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া যেহেতু এ দলটির সঙ্গে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা জড়িত, সেহেতু এ দলের যেকোনো নেতিবাচক দিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানান সংকট তৈরি করবে।
এনসিপির কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর সাম্প্রতিক সময়ের একটি আলোচিত ফেসবুক স্ট্যাটাস এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। পতিত আওয়ামী লীগকে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ হিসেবে পুনর্বাসন করার জন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে ওই ফেসবুক পোস্টে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেন তিনি। আর এ ফেসবুক পোস্ট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যখন তুঙ্গে, তখন এর এক দিন পর হাসনাতের সহযোদ্ধা এনসিপির কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের আরেকটি পোস্ট দ্বিতীয় দফায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তোলে। নাতিদীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে সারজিস আলম হাসনাতের ফেসবুক পোস্টের মূল বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও কিছু কিছু বিষয়ে দ্বিমত অবস্থান তুলে ধরেন।
ঘটনার সূত্রপাত এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর এক ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, রিফাইন্ড (সংশোধিত) আওয়ামী লীগ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এ পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। আমিসহ আরও দুজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এ পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়।
হাসনাতের এমন পোস্ট নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পোস্ট করার পরদিন এনসিপির পক্ষ থেকে জরুরি সংবাদ সম্মেলনও করা হয়। সেখানে দলের শীর্ষনেতারা বলেন, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা হলে রুখে দেওয়া হবে। এ নিয়ে কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে কর্মসূচি পালন করা হয়।
হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্টের কাছাকাছি সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সেনাপ্রধানকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। এ ছাড়া গত ২১ মার্চ নিজের ফেসবুক পেজে তুলে ধরা ভিডিও বার্তায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগের ঘটনাক্রমের বর্ণনা দিতে গিয়ে আসিফ মাহমুদ জানান, রাষ্ট্রপতি ও তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে এক বৈঠকে ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করার ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের ‘বিরোধিতার মুখে’ পড়েছিলেন অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা। কিন্তু ছাত্রদের ‘অনড় অবস্থানের’ কারণে শেষ পর্যন্ত ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্ত হয়।
ছাত্রনেতাদের এমন মন্তব্যের পর সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিষয়টি নিয়ে নেত্র নিউজ যোগাযোগ করলে একজন মুখপাত্রের মাধ্যমে বক্তব্য দেয় সেনাসদর। হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্টকে ‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বৈ অন্য কিছু নয়’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে সেনাসদরের বিবৃতিতে। এ ছাড়া ২৭ বছর বয়সী এই ছাত্রনেতার বক্তব্যকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার’ হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে সেনাবাহিনী।
এদিকে হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্টের পর নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে এনসিপির আরেক মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমও ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন। সেখানে তিনি হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্যের সঙ্গে ‘কিছুটা দ্বিমত’ প্রকাশ করে বলেন, সেদিন (১১ মার্চ) সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেওয়া হয়নি। সারজিস এও লিখেছেন, যেভাবে এই কথাগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এসেছে, এই প্রক্রিয়াটি আমার সমীচীন মনে হয়নি বরং এর ফলে পরবর্তীতে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারে। অন্যদিকে হাসনাত আবদুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সেনানিবাসে বৈঠক নিয়ে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সেটি ‘শিষ্টাচারবর্জিত’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী। তিনি বলেন, এনসিপির নেতাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব কিংবা বোঝাপড়ার জায়গায় কোনো ঘাটতি নেই। তবে একটি বড় অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। আন্দোলন ও রাজনৈতিক জায়গা, দুটোই আলাদা। সেই জায়গা থেকে এই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্ররা নিজেদের রাজনৈতিক জায়গায় রূপান্তর করছেন। সেখান থেকে যদি কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, দেশবাসীকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করছি।
এনসিপির দুই নেতার অবস্থানের সমালোচনা করেছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার এমন অবস্থান নতুন আত্মপ্রকাশ করা এনসিপিকে ‘বিতর্কিত করছে’। হাসনাত বা সারজিসের কেউ একজন ‘মিথ্যা বলছেন’ অভিযোগ করে তাদের পাল্টাপাল্টি পোস্টের সমালোচনা করেন আবদুল হান্নান মাসউদ।
একটা নতুন গঠিত দলের মধ্যে এ রকম বিভাজন প্রকাশ্যে আসার পরে স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তিতে এনসিপি নেতৃত্ব। এই বিতর্কে যে এনসিপি বেশ চাপে পড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। সম্ভবত এর ফলে সাধারণ মানুষ বা এনসিপি অনুগামীদের মধ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই দলের অন্য নেতারা এই বিতর্ক থেকে নিজেদের এবং এনসিপিকে আলাদা করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, এই দলকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলাম, আর যা-ই হোক, তারা নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে আসবে। আমাদের রাজনীতি সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু যে কর্মকাণ্ড দেখছি, তাতে হতাশা বাড়ছে। অনভিজ্ঞতা যে কত বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে, তা তারা দেখিয়ে দিয়েছেন। এই অনভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে তারা যে খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারবেন, এটা আমার কাছে মনে হয় না।
                           
                           
                            
                       
    
 
 


 ঠিকানা রিপোর্ট 
                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
                                                     
                                                
