ঈদুল আজহার ১০ দিনের সরকারি ছুটি শেষ। বাংলাদেশের শহর-গ্রাম মেতেছিলো দু’রকমের ভোজে। আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের আপ্যায়ন। আর রেকর্ডসংখ্যক বিয়ের আয়োজন। উভয়ভোজেই ছিলো কুরবানির মাংসের ব্যাপক ব্যবহার। এমন কি ঈদের দিনেও প্যান্ডেল টাঙানো বিবাহ উৎসব। নিয়ন্ত্রিত দামের গরু-খাসিতে কব্জিডোবানো ভুড়িভোজ। সঙ্গে ইউনূস-তারেক লন্ডন মিশনের ওপর পর্যালোচনা। ইরান কর্তৃক ইসরাইলকে নাস্তানাবুদ করায় নতুনদফা ভোজসভা। ভোজবাজি করতেও দেখা গেছে অনেককে।
প্রধানমন্ত্রীত্বের আগে স্টারমার্কের বাংলাদেশ সফর
♦পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর অনীহা
লন্ডনে চারদিনের সফর নিয়ে ড. ইউনূস আছেন আলোচনা-সমালোচনায়। সেটিকে রাষ্ট্রীয় সফর বলতে অনেকে অনাগ্রহী। পৌনে তিনকোটি টাকার রাষ্ট্রীয় খরচ নিয়েও প্রতিপক্ষের প্রতিবাদ। প্রিন্স চার্লসের তত্ত্বাবধানে ‘হারমোনি অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন ড. ইউনূস। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনের পরেই তিনি। কমনওয়েলথ মহাসচিবসহ এমপি, কূটনীতিকদের সাক্ষাৎ। জুলাই আন্দোলনের কুশীলবদের সাথে মতবিনিময়। তবে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার্কের সাক্ষাৎহীনতা। শেখ হাসিনার ভাতিজি টিউলিপ সিদ্দিককে সাক্ষাৎ না দেয়া। দুটিতেই সমালোচকেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার।
বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়ার নেপথ্য কারণটিও আলোচিত। বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্য ছিলো। সভায় আলোচ্য বিষয় হিসেবে সেটি প্রস্তাবিত হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলতে চাননি কিয়ার স্টারমার্ক। সাক্ষাৎকালে টিউলিপ সিদ্দিক-এর দুর্নীতির প্রসঙ্গও উঠতো। উল্লেখ্য, দুর্নীতির অভিযোগে টিউলিপকে তিনি পদচ্যুত করেছিলেন। অনেকের মতে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হন।
প্রধানমন্ত্রীত্বের আগে বাংলাদেশ সফর করেন কিয়ার স্টারমার্ক। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত কিছু সিলেটী তাকে বাংলাদেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য পরিদর্শনে মৌলভীবাজারে নিয়ে যান। এ সময় চা বাগানসহ নান্দনিক এলাকাসমূহ পরিদর্শন করান। ‘সেকেন্ড সিলেট’-খ্যাত বৃটেনের অনেক ভোটার এতে প্রীত হন। যদিও সফর কার্যক্রমটি বাংলাদেশে তেমন প্রচারণা পায়নি।
টাকা উদ্ধারের লক্ষ্যে ড. ইউনূস সঙ্গে নেন দুই কুশীলব- বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও দুদক চেয়ারম্যানকে। কিন্তু বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ হন। তবে সচেতন মহল উদ্যোগটিকে সময়োচিত বলছেন।
ক্ষমতায় ৫ বছর ♦ খেলারামের খেলায়
নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান
বৃটেন সফরের মূল চমক ছিলো ইউনূস-তারেক বৈঠক। গত ১৩ জুনের সকালটি ছিলো ঝকঝকে, রৌদ্রকরোজ্জ্বল। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমানের সঙ্গে আমির মাহমুদ খসরু। বিএনপির আহ্বানে এপ্রিলের নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে এগুনো হয়। এরপর ৪০ মিনিট ছিলো ইউনূস-তারেক একান্ত বৈঠক। একাধিক সূত্রমতে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ছাত্রশক্তির সংগঠন ‘এনসিপি’ বিষয়েও আলোচনা হয়। প্রাথমিক সিদ্ধান্তে জামায়াতের সাথে জোট করার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিসেব পাল্টে যায়। এখন বেশ কিছু আসন ছেড়ে দেয়ার শর্তে ‘এনসিপি’কে জোটে নেবে বিএনপি। ফলে ঈদোত্তর রাজনীতিতে শুরু হয়েছে গোপন তোলপাড়। ১৭-১৮ জুন জামায়াত ঢাকায় ডেকেছে বিশেষ বৈঠক। সব উপজেলা আমির ও এমপি প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকেছে। ‘এনসিপি’র কোলবদল হলে করণীয় কি- বিষয়ে মতবিনিময়।
ইউনূস-তারেক বৈঠক নিশ্চিত করেছে নতুন নির্দেশনা। ড. ইউনূসের বিরোধিতাকারী বিএনপি নেতারা এখন নিশ্চুপ। উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ড. খলিলের পদত্যাগও চেয়েছিলেন। স্ট্যন্ডিং কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমদ সরব থেকে নীরব। অন্যদিকে ড. খলিল দেখালেন কূটনৈতিক খেলা। ইউনূস-তারেক বৈঠকের নেপথ্যে অন্যতম কুশীলব তিনি। আওয়ামী ও ভারতীয় মহলকে ঠেকিয়ে সফল হয়েছেন। বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে সরকার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। এজন্যে অনেকেই ড. খলিলকে সার্থক খেলারাম বলছেন। উল্লেখ্য, সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন শরীরপ্রধান একটি উপন্যাস। শিরোনাম- ‘খেলারাম খেলে যা’।
ড. ইউনূসের সফরকালে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ জানাতে থাকে। ‘গো ব্যাক’ প্লেকার্ড প্রদর্শিত হয় হোটেলের বাইরে। আগে ড. ইউনূসের পক্ষে অবস্থান নিতো বিএনপি। কিন্তু এবারে বিএনপিপন্থীরা মূলত নীরব ছিলো। কিন্তু লন্ডনের আলতাব আলী মাঠে দেখা যায় নতুন জাদু। ‘ড. ইউনূস সমর্থক গোষ্ঠী’র বিশাল উত্থান ঘটেছে। প্রধান শ্লোগান ছিলো ‘ড. ইউনূসকে ৫ বছর ক্ষমতায় চাই’। এই দুর্লভ জমায়েতের নেপথ্যে অনেকের নাম জড়িত। তবে খলিল গংও জড়িত বলে প্রচারণা রয়েছে।
২৩ জুন সেনাপ্রধানের ক্ষমতাযাপনের প্রথম বর্ষপূর্তি ♦ আওয়ামী
মহল যার কাছ থেকে প্রত্যাশা করছেন সুরাহা
সেনাপ্রধান জে. ওয়াকার উজ্জামান জন্মেছেন ১৯৬৬-এর ১৬ সেপ্টেম্বর। বৃহত্তর জামালপুরের শেরপুর জেলায়। পাশেই রংপুর জেলায় করেছেন বিয়ে। স্ত্রী সারাহনাজ কামালিকা শেখ হাসিনার ফুপাতো বোন। শ্বশুর জে. মুস্তাফিজুর রহমান বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি। হাসিনা সরকারের সাবেক সেনাপ্রধান (১৯৯৭-২০০০)। ওজনদার সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জে. ওয়াকার উজ্জামান স্বনামধন্য। সিজিএস, পিএসও, সেনাসদরের সচিব ছিলেন।
১৮তম সেনাপ্রধান পদে আসীন হন ২০২৪-এর ২৩ জুন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৫তম জন্মতিথিতে। নিয়োগদাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মন্তব্য করেন। বলেন, আজকের দিবসের মর্যাদা ধরে রেখো। দেড় মাসের মাথায় সেই প্রধানমন্ত্রীর সর্বস্ব পতন। ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের করুণ বিদায়। ভীষণ দো’টানায় ছিলেন নিকটাত্মীয় ওয়াকার উজ্জামান। ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। প্রায় সময় জামায়াতে ইমামতিও করেন। অফিসে পবিত্র কোরআন শরীফ রাখেন। মেয়ে রাইসা জামান, শায়রা জামানের কল্যাণ কামনা করেন।
হাসিনা সরকারের গুম-খুনের বিরুদ্ধে শেষে অবস্থান নেন। ৩ আগস্টের সামরিক সমাবেশে মধ্যবর্তী অফিসারদের প্রতিবাদ। ‘জাতিসংঘ মিশন’ জবে বাংলাদেশকে বাঁচানোর সংকল্প। অবশেষে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতি। মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্বাক্ষী রেখে নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ। শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘোষক হলেন ওয়াকার উজ্জামান। ৫ আগস্ট বিকেল চারটায় ইথারে-টিভিতে তিনি জানালেন, শেখ হাসিনার ৫ম মন্ত্রিসভার পতন হয়েছে। বললেন, অচিরেই অন্তবর্তী সরকার গঠিত হবে। আমি সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছি। সব হত্যার বিচার হবে।
২০২৫-এর মার্চে ঘটলো অঘটন। ছাত্রশক্তি’র হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের পোস্ট। বিচার না করে ‘রিফাইন আওয়ামী লীগ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব। বুকে পাথর চেপে ড. ইউনূসকে মেনে নেয়া। ছাত্রনেতাদের সাথে কথোকথনের খন্ডচিত্র। বিতর্কিত পরিস্থিটি সামাল দিলেন ড. ইউনূস। সেনাপ্রধানকে নির্ভয়ে কাজ চালানোর পরামর্শ দিলেন। সেই প্রেরণাতেই সেরা সার্ভিস দিচ্ছেন সেনাপ্রধান। অনির্বাচিত সরকারের পাশে সদাসক্রিয় সামরিক বাহিনী।
তবুও পরাজিত আওয়ামী লীগের নেপথ্য ভরসা তিনিই। আসন্ন ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিতে চায় দলটি। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাওয়া মানুষটি এখন নীরব। রাজনৈতিক বিষয়ে নিজেকে সামলে রাখতে চান। জাতিসংঘ ‘ইনক্লুসিভ নির্বাচনে’র কথা বলছে। যদিও জে. ওয়াকার উজ্জামান প্রথম এ বিষয়ে কথা বলেন। বললেও, সেনাপ্রধান পদে ‘পদায়ন বর্ষপূর্তি’তে তিনি নীরব। নিকটজনদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন ‘নো কমেন্টস’।
উল্লেখ্য ২৩ জুন শুধু আওয়ামী লীগের বর্ষপূর্তি নয়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহর ঐতিহাসিক পতন দিবসও। কিংবদন্তী আব্দুল গাফফার চৌধুরী দুটি পতন নিয়ে নাটক লেখেন। শিরোনাম : ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’। অর্থাৎ নবাব সিরাজ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। নিয়তি এমন যে আওয়ামী লীগ এখন চরম কোণঠাসা। ২৩ জুন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনে বাংলাদেশ নীরব। দলটি নিষিদ্ধ, কার্যক্রমও শিকেয় উঠে গেছে। বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী থাকলেও সব ঊদ্দীপনা নিরুপায়।