Thikana News
১৯ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

দি অ্যান্ড অব আওয়ামী লীগ এরা?

১০ মে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার কয়েক দিন পূর্বে এই জনরোষ স্ফুলিঙ্গ থেকে অনেকটা দাবানলে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। ১০ মে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
দি অ্যান্ড অব আওয়ামী লীগ এরা?



 
একজন ব্যক্তি বা সংগঠনের অতীত ভূমিকার মূল্যায়ন হয় সাধারণত তার চলতি বা সাম্প্রতিক কার্যকলাপের নিরিখে। বিগত দেড় দশক, বিশেষ করে নিকট অতীতে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের অন্যতম বড় ও ঐতিহ্যবাহী পুরোনো (১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত) রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গসংগঠনগুলো এবং এসব সংগঠনের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে মাত্রায় অত্যাচার-নিপীড়নের স্টিমরোলার চালান, তার তুলনা সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল। দলের শীর্ষ থেকে প্রায় সকল পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক নেতার কিংবদন্তিতুল্য পর্বতসম দুর্নীতির কথা না হয় বাদই দিলাম। সেই কলঙ্কজনক অধ্যায়ের বহু নমুনা সম্পর্কে মিডিয়াসূত্রে বাংলাদেশের জনগণ সম্যক অবহিত আছেন। দলের শীর্ষ নেতাসহ অনেকের অবিশ্বাস্য রকমের দুর্নীতির চিত্র দেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় (কাতারের আল-জাজিরা, লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ ইত্যাদি) খবরের শিরোনাম হতে দেখা যায়। এ নিয়ে সবিস্তারে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি না।

বিগত দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগ ও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকতে যেসব অন্যায়-অপকর্ম করেছে, তার ফিরিস্তি অত্যন্ত দীর্ঘ। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও সেসব দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জঙ্গি ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগে জেলে প্রেরণ করা ছাড়াও তাদের অনেককে আয়নাঘর বা টর্চার সেলে রেখে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানোর বহু ঘটনা ঘটেছে, যা অতীতে হিটলারের জার্মানিতে বন্দিশিবিরে সংঘটিত নির্যাতনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, কেবল জুলাই বিপ্লবের ৩৬ দিনে সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য উপায়ে প্রায় ১৪০০ জন নিহত ও কুড়ি হাজার মানুষ আহত হন। নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর এহেন নৃশংস নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও এর নেতৃত্বের কোনো পর্যায় থেকে তাদের অপরাধমূলক কৃতকর্মের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্র দুঃখ ও অনুশোচনা পর্যন্ত করতে দেখা যায়নি। উপরন্তু, এ সময়ে সংঘটিত সব নৃশংসতা ও হত্যার দায়ভার ড. ইউনূস এবং জুলাই বিপ্লবের নেতাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়।

আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বের দ্বারা সংঘটিত দিনের আলোর মতো পরিষ্কার একটি পরিকল্পিত গণহত্যাকে বাংলাদেশের মানুষ নিয়তির বিধান হিসেবে মেনে নিয়ে সেসব নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনের স্মৃতি ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ও সরব হয়ে ফের ক্ষমতার মসনদে ফিরে আসার সুযোগ করে দেবে, এমনটা ধরে নিয়ে দলীয় নেত্রী কর্তৃক ভারতে থেকে নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দলের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করার ঘটনায় জনরোষ তীব্র হয়ে ওঠে, যেটাকে অনেকে দেশকে অস্থিতিশীল করার এক সুগভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন।

১০ মে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার কয়েক দিন পূর্বে এই জনরোষ স্ফুলিঙ্গ থেকে অনেকটা দাবানলে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। ১০ মে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আইন উপদেষ্টা সভার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আওয়ামী লীগ ও দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে বলে জানান। ১৯৭৩ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জুলাই বিপ্লবের নেতারা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তিরা ও সেসব মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয় বলে জানানো হয়। নিষিদ্ধ ঘোষণার পরে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করে।
উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার করে কিছু বিরোধীদলীয় নেতাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে ফাঁসি দেওয়া ও জেলে প্রেরণ করা হয়। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, সেই একই আইনে ও ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও এর নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান রয়েছে। পাপ বাপকেও ছাড়ে না, কথাটির যথার্থতা এতে পরিষ্কার হয়ে যায়।

বিশ্ব ইতিহাসে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী দলের নিষিদ্ধকরণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। অতীতে একাধিক পশ্চিমা দেশ কর্তৃক জাতীয় স্বার্থে ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে জার্মানি ও ইতালিতে নাজি ও ফ্যাসিস্ট পার্টি নিষিদ্ধের ঘটনার উল্লেখ করা যায়। যদিও কিছু মহলকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার ক্ষেত্রে যথাযথ পন্থা (Duc Process) অনুসরণ না করা এবং এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে অনুরূপভাবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের রীতি চালু হওয়ার সম্ভাবনার উল্লেখ করে নিষিদ্ধ ঘোষণার সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও দল হিসেবে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক এর নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

পূর্ব ইউরোপের এস্তোনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মার্কিন নাগরিক লুই কান (Lonis Kan) বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি। তিনি ওই ভবনে প্রবেশের জন্য দুটি পথের ব্যবস্থা রাখেন। ভবনের নিচ তলার পথ দিয়ে সংসদ সদস্য এবং উপরের পথ দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা হয়, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণ জনগণের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বার্তা বহন করে।

জনমনে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বিদ্যমান নেতিবাচক মনোভাব ও ক্ষোভ এবং চলমান বিচারপ্রক্রিয়ায় দলীয় নেতাদের অনেকের সাজাপ্রাপ্তি অনেকটা নিশ্চিত প্রতীয়মান হওয়ায় অনেকে আগামীতে দলের পক্ষ হতে প্রভাব-প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধার করা বেশ কঠিন হবে বলে মনে করেন। এ কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বহুলাংশে অপ্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
লেখক : কলামিস্ট
 

কমেন্ট বক্স