নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ইতিহাসের বাঁকে দাঁড়িয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানি। অর্থাৎ নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র হতে যাচ্ছেন তিনি। যেহেতু নিউইয়র্ক সিটি ডেমোক্রেট অধ্যুষিত, তাই ৪ নভেম্বর চূড়ান্ত লড়াইয়ে জোহরান মামদানিই জয়ী হবেন তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সে হিসাবে জোহরান মামদানিই বিশ্বের রাজধানী হিসাবে পরিচিত নিউইয়র্ক সিটির পরবর্তী মেয়র হিসাবে অভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাইপর্বে জোহরান মামদানির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো। প্রথম দফার র্যাঙ্কড চয়েস ভোট গণনার পর সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি মামদানিকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আজকের রাত মামদানির’।
২৪ জুন মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে র্যাঙ্কড চয়েসে মোট ৯৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ ভোটের ফলাফলে জোহরান মামদানি পেয়েছেন ৪৩ দশমিক ৫১ শতাংশ ভোট, অর্থাৎ ৪ লাখ ৩১ হাজার ৪৩৪ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু ক্যুমো পেয়েছেন ৩৬ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোট, অর্থাৎ ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯৮২ ভোট। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন সিটির বর্তমান কম্প্রট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডার। তিনি পেয়েছেন ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ, অর্থাৎ ১ লাখ ১২ হাজার ২৮৯ ভোট। র্যাঙ্কড-চয়েস নির্বাচনী পদ্ধতিতে ব্র্যাড ল্যান্ডার মামদানিকে দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে সমর্থন দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর সমর্থকদের দ্বিতীয় ভোটগুলোও মামদানির ঝুলিতে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এদিকে রাতে ভোট গণনার পর এক আবেগঘন ভাষণে ক্যুমো বলেন, ‘আজকের রাত জোহরানের। সে এটা অর্জন করেছে। তরুণ ভোটারদের মন জয় করেছে। আমি তাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছি।’ ম্যানহাটনের কার্পেন্টারস ইউনিয়ন ভবনে এসময় তার পাশে ছিলেন তিন কন্যা ও জামাতা।
তবে- নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে ক্যুমো ও বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস উভয়েই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। প্রাইমারির পরাজয়ে ক্যুমোর রাজনৈতিক ভবিষ্যত তলানিতে গিয়ে পৌঁছতে পারে। এ অবস্থায় স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসাবে পুনরায় লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলে ক্যুমোর জন্য তা কতটুকু সম্মানজনক হবে, তা মূল্যায়ন করবে নিউইয়র্কবাসী।
‘নতুন যুগের সূচনা’: মামদানি
প্রাইমারি ভোটের দিন ভোরে অ্যাস্টোরিয়া পার্কে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রচার শুরু করেন মামদানি। পরে জ্যাকসন হাইটসে ভোটারদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সন্ধ্যায় লং আইল্যান্ড সিটির একটি ব্রুয়ারিতে সমর্থকদের সঙ্গে ফলাফল উদযাপন করেন।
আমরা নিউইয়র্ক শহরে এক নতুন যুগের সূচনায় আছি, বলেন ৩৩ বছর বয়সী মামদানি। দুর্নীতিগ্রস্ত পুরনো রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে, মানুষের জন্য সাশ্রয়ী শহর গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সক্রিয় থাকা মামদানির প্রচারে ছিলেন প্রায় ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক, যারা শহরজুড়ে ১০ লক্ষ দরজায় কড়া নেড়েছেন।
‘এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত’: মুসলিম, অভিবাসী ও তরুণদের উচ্ছ্বাস
নিউইয়র্ক মুসলিম ডেমোক্রেটিক ক্লাবের সভাপতি সামান ওয়াকোয়াদ বলেন, আমরা মুসলিম, দক্ষিণ এশীয়, অভিবাসী এবং নিউইয়র্কবাসী হিসেবে এই মুহূর্তকে ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখছি। মামদানির প্রচারণা স্ট্র্যাটেজি দলের সদস্য গ্যাবি জুত্রাও বলেন, “বিশ্বাসই হচ্ছে না -এত বড় জয়।”
মামদানির প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে: বাস সেবাকে বিনামূল্যে করা, রেন্ট-স্ট্যাবিলাইজড অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া হিমায়িত রাখা এবং খাদ্যপ্রবণ অঞ্চলে শহর-চালিত গ্রোসারি চালু করা।
সাবেক মেয়রপ্রার্থী সেলমা বার্থলোমিউ, পেপারবয় প্রিন্স, অ্যাড্রিয়েন অ্যাডামসসহ অন্যান্য প্রার্থীরা ১% ভোটের নিচে পেয়েছেন। সাবেক কম্পট্রোলার স্কট স্ট্রিংগার দ্রুত পরাজয় মেনে নেন।
অন্যান্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্বাচনী ফলাফল :
পাবলিক অ্যাডভোকেট: জুমানে উইলিয়ামস পুনরায় বিজয়ী।
কম্পট্রোলার: ম্যানহাটনের মার্ক লেভিন জয়ী।
বরো প্রেসিডেন্ট: ব্রঙ্কসে ভেনেসা গিবসন ও ব্রুকলিনে অ্যান্তোনিও রেনোসো জয়ী।
ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি: আলভিন ব্র্যাগ (ম্যানহাটন) ও এরিক গঞ্জালেস (ব্রুকলিন) তাঁদের আসন ধরে রেখেছেন।
সিটি কাউন্সিল: শাহানা হানিফ তাঁর ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বী মায়া কর্নবার্গকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জয়ী হয়েছেন। ম্যানহাটনে ক্রিস মার্টে এগিয়ে।
যদিও আনুষ্ঠানিক ফলাফল জুলাইয়ের শুরুতে প্রকাশিত হবে এবং চূড়ান্ত সার্টিফিকেশন জুলাই ১৪-এর পরেই আসবে। তবুও জোহরান মামদানির এই জয় নিউইয়র্কের রাজনীতিতে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশীয়, মুসলিম এবং অভিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী এক প্রগতিশীল তরুণের এই বিজয় নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সূচনা করে দিল।
জোহরান মামদানি জন্ম উগান্ডায়। তাঁর মা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মিরা নায়ার। তাঁর বাবা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামজাদা অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি জন্মগতভাবে ভারতীয়। তবে জীবনের প্রথম ভাগ কাটিয়েছেন উগান্ডায়। ১৯৬৩ সালে কেনেডি পরিবারের আর্থিক অনুদানে গঠিত তহবিলের মাধ্যমে মাহমুদ মামদানি নিউইয়র্কে আসেন। এখানেই ১৯৯১ সালে মিরা নায়ারের সঙ্গে পরিণয়। সে বছরই জোহরানের জন্ম।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের কোনো তুলনা হয় না। তবে নিউইয়র্ক যে কোনো সাধারণ একটি শহর নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহর। প্রায় সাড়ে আট মিলিয়ন মানুষের বাস এই শহরে। এর বার্ষিক বাজেট ১১২ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের গড় বাজেটের চেয়ে বেশি। শুধু শিক্ষা বিভাগের যে বাজেট (৩৮ বিলিয়ন ডলার), তা লাওসের মতো একটি দেশের জাতীয় বাজেটের বেশি।
নিউইয়র্কের ভোটাদাতাদের যে মানচিত্র, তা-ও যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার মানচিত্র থেকে একদম আলাদা। যেমন এই শহরের তালিকাভুক্ত ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের পরিমাণ যথাক্রমে ৭৬ ও ১০ শতাংশ। অথচ সারা দেশে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির ভোটারদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান; ৩০ শতাংশ করে। তার চেয়েও বড় কথা, সারা যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে অশ্বেতকায়দের সংখ্যা প্রায় ৪২ শতাংশ, সেখানে নিউইয়র্ক শহরের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই অশ্বেতকায় ও বহিরাগত।
বস্তুত, জনসংখ্যার গঠনগত দিক দিয়ে পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় এ শহর অধিক বৈচিত্র্যময়। কুইন্স, যেখানে জোহরানের বাস, সেখানে ইংরেজি ভাষা ছাড়াও প্রায় ১৮০টি ভাষা ও উপভাষায় কথা বলা হয়।