‘পাখি’ কেবল একটি নাটক নয়- এটি যেন এক জীবনভাষ্য। প্রতিটি দৃশ্য, সংলাপ ও চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের নীরব বেদনা, নিঃশব্দ কান্না, ক্ষয়ে যাওয়া স্বপ্ন এবং টিকে থাকার এক অসম লড়াই। নাটকটির কাহিনী, সংলাপ, দৃশ্য পরিকল্পনা ও চরিত্রচিত্রণে ছিল এক অনন্য শিল্পসুষমা ও পরিমিত নান্দনিকতা।
এক ছাপোষা চাকুরিজীবীর মনের ক্ষরণ, জীবনের ভারে ক্লান্ত এক নারীর নিঃশব্দ হতাশা, অর্থনৈতিক বৈষম্যের নির্মম ছায়া, আর এক মায়ের বেদনা- এসব মিলিয়ে নাটকটি গড়ে তুলেছে এক অন্তরঙ্গ, অন্তরস্পর্শী আবহ, যা দর্শকদের মননে প্রভাব ফেলে। এইসব জীবনঘনিষ্ঠ অনুভবের মধ্য দিয়ে নাটকটি ধীরে ধীরে গড়ে তোলে এক অন্তরস্পর্শী বয়ান।
বিছানার চাদরের নিঃসঙ্গ ভাঁজে হারিয়ে যাওয়া এক পাখির বেদনার নীল ছায়ায় মিশে থাকে গল্পের গভীরতা। কাহিনীর প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে থাকে প্রতীকী ব্যঞ্জনা, কল্পনার বিস্তার এবং মনন-মনোহর এক শিল্পিত পরিমিতি।পাখি শুধু একটি নাটক নয়, এটি অনুভবের একটি নিঃশব্দ ভাষ্য।

হল ভর্তি দর্শকদের উপস্থিতিতে ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয় একঘন্টার এই নাটকটি।পিন পতন নীরবতায় পুরো নাটকটি উপভোগ করেছেন দর্শকরা।
নাটকে নিতিশ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবীর আলমগীর ও শ্যামা চরিত্রে কান্তা আলমগীর- এই দুটি চরিত্র দারিদ্র্যের আবদ্ধ হলেও তাদের অন্তর্জগতের দ্বন্দ্ব, আবেগ ও বেদনার বহিঃপ্রকাশ নাটকে এক অনন্য মাত্রা যুক্ত করেছে।চরিত্র দুটি পরস্পরের প্রতি অগাধ আস্থা ও নির্ভরতায় জড়ানো।এই আন্তরিক সম্পর্কের টান, নিঃশব্দ রোমান্স ও আবেগের পরিমিতির প্রকাশ তারা যথার্থই করতে পেরেছেন নাটকে, যা দর্শকদের গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।
গোপালের চরিত্রে চন্দন চৌধুরী ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত, সংলাপ প্রক্ষেপণের সূক্ষ্মতায় তিনি চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন।মিস চৈতালী চ্যাটার্জীর ভুমিকায় জাফরিন আবেদীন ছিলেন সাবলীল।একজন আইনজীবীর স্বভাবজাত দৃঢ়তার প্রকাশ তিনি দক্ষতার সাথেই মঞ্চে ফুটিয়ে তুলেছেন।
অভিনেতা-দর্শকের মাঝে এক সেতুবন্ধ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন নির্দেশক জহির মাহমুদ। তাঁর নির্মাণে ছিল নিপুণতা, ছিল গল্প বলার এক সহজ অথচ গভীর ধারা- যা দর্শকদের মনে দাগ কেটে যায়। জটিলতা নয়, বরং সরলতার মোড়কে তিনি যে গল্পটি উপস্থাপন করেছেন, তা নাটকের প্রাণ হয়ে উঠেছে। তাঁর নির্দেশনায় যেন দৃশ্য ও অনুভব একসাথে মিশে গেছে।
নাটকটি প্রযোজনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন নার্গিস আহমেদ, প্রযোজনা অধিকর্তা রিপা আহমেদ, মঞ্চ ব্যবস্থাপনা এস কে বুখারি ও মিল্টন আহমেদ, আবহ সংগীত ফারহানা তুলি, আলোক পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ আবু সুফিয়ান বিপ্লব।সঞ্চালনায় ছিলেন আদিবা জহির, বক্স অফিস নিয়ন্ত্রন করেছেন অমিতা ইসলাম, ভিডিও চিত্রধারন তানভির আজহার সুকি।মিলনায়তন ব্যবস্থাপনায় ছিলেন মোহাম্মদ মোহসিন, লুৎফর রহমান, শারমিন মোহসিন, আলেয়া ফেরদৌসী, শাহ আলম, রুকসান আরা, লেমন চৌধুরী, শায়লা আজিম, রুমি মুস্তাফা, সুদান শেখ, শাহনাজ পারভিন রিতা, আকাশ আহসান, লিলি ইসলাম, নিশাত খাজা, জুয়েল খাজা, ফারজানা মম সুলতানা ও জায়ান।
নিউইয়র্কের বাঙালি সংস্কৃতির জগতে ‘ড্রামা সার্কল’ একটি গর্বিত নাম। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরবর্তী এক দশকে তারা পরপর ২৩টি পূর্ণাঙ্গ নাটক মঞ্চস্থ করেছে।তাদের প্রতিটি প্রযোজনা ছিল সৃজনশীলতার অনন্য প্রকাশ।সে ছিলো এক উজ্জ্বল অধ্যায়।বেশ কয়েক বছর পর আবারো পূর্ণাঙ্গ নাটক নিয়ে মঞ্চে ফিরেছে ড্রামা সার্কল।নতুন প্রযোজনা, নতুন উৎসাহ, কিন্তু সেই একই অটুট প্রতিশ্রুতি নিয়ে আবারো মঞ্চে সরব উপস্থিতি।এই প্রত্যাবর্তন শুধু একটি নাট্য প্রযোজনা নয়, এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।