Thikana News
২৬ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন

শিশু পাচারকারী কে এই নাসরিন?

শিশু পাচারকারী কে এই নাসরিন? প্রতীকী ছবি



 
যুক্তরাষ্ট্রে শিশু পাচারের নেত্রী নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি নারী নাসরিন আক্তারকে নিয়ে চাঞ্চল্যকর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন কানাডার টরন্টোতে বসবাসরত সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক নজরুল ইসলাম মিন্টু। এ ঘটনা বাংলাদেশি কমিউনিটিতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
ব্রুকলিনের একাধিক বাসিন্দা বলেছেন, তারা নাসরিন আক্তার নামে কাউকে চিনেন না। কখনো প্রকাশ্যে দেখেননি এই নারীকে। নিউইয়র্কে কুমিল্লা সমিতির দুজন নেতার কাছে নাসরিন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। তারাও বলেছেন, নাসরিনকে তারা চেনেন না। 
নজরুল ইসলাম মিন্টু তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন - নিউইয়র্ক শহরের এক পুরোনো অভিবাসীবহুল এলাকা ব্রুকলিন। যেখানে অভিবাসী বাংলাদেশিদের বিরাট অংশ দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে। এই শহর কখনো স্বপ্নের মতো আলোকোজ্জ্বল, আবার কখনও বিভীষিকার ছায়ায় ঢাকা এক নির্মম বাস্তবতা। কেউ আসে জীবন গড়তে, কেউ আসে বাঁচার জন্য। এখানকার মানুষ ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে ডেলিভারি কর্মী, ক্লিনিকের নার্স থেকে রেস্তোরাঁর কুক, সব ভূমিকায় কাজ করে। কিন্তু তাদের অনেকেরই দ্বিতীয় একটি পরিচয় আছে, যা দিনের আলোতে দেখা যায় না।
নিউইয়র্ক শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে যেমন বৈধ পরিশ্রমে দিন চলে, তেমনি বেড়ে উঠেছে অপরাধের ঘন জাল। মেডিকেইড ফ্রড, ট্যাক্স চুরি, বেনামী হোম কেয়ার, ভুয়া বিবাহ- এসব যেন অভিবাসী জীবনের কালো অধ্যায়। কিন্তু সব অপরাধ ছাপিয়ে এই শহরের বুকেই গড়ে উঠেছিল একটি নিষ্ঠুর শিশু পাচার চক্র, যার নেতৃত্বে ছিল একজন বাংলাদেশি নারী।
নাসরিন আক্তার। জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায়। ২০০৫ সালে প্রথম স্বামী আব্দুল মালিকের সাথে বিয়ে করে আমেরিকা আসেন। ২০১০ সালে তাদের বিয়েবিচ্ছেদ হয়। এরপর ২০১৫ সালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন আব্দুল্লাহ আল মামুনকে, যিনি পরবর্তীতে তার সাথে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। নাসরিন ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত হোম হেলথ এইড হিসেবে কাজ করতেন, যেখান থেকে তিনি আমেরিকান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা সম্পর্কে গভীর ধারণা লাভ করেন এবং সেই সুযোগেই অপরাধজগতে প্রথম পা বাড়ান।
২০১৬ সালে নিজের এক আত্মীয়ের নবজাতককে দত্তকপ্রক্রিয়ার নামে বিক্রি করেন - সেই থেকে শুরু। ২০১৭ সালে ব্রুকলিনে ‘সারোগেসি কনসালটেন্ট’ নামে একটি ফ্রন্ট কোম্পানি খোলেন। এই কোম্পানিই ছিল শিশু পাচারের মুখোশ।
নাসরিনের ভাই শফিকুল ইসলাম ঢাকায় একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালাতেন। গর্ভবতী নারীদের টার্গেট করতো তারা। স্থানীয় নারী দালালরা গ্রামে গিয়ে বলত: ‘আমেরিকায় জন্ম দিলে শিশু পাবে পাসপোর্ট, তুমি পাবে কাজের ভিসা।’ তাদের ফাঁদে পড়ে বহু নারী নকল এমপ্লয়মেন্ট ভেরিফিকেশন লেটার নিয়ে ভিসা পেতেন, যেখানে তারা ‘হোটেল ম্যানেজার’ বা ‘নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট’ হিসেবে দেখানো হতো।
ভিসা পাওয়ার পর তাদের নিয়ে আসা হতো যুক্তরাষ্ট্রে। কেউ কেউ এয়ারওয়েজের দুর্নীতিপরায়ণ চেক-ইন এজেন্টের মাধ্যমে গর্ভাবস্থা লুকিয়ে পাড়ি জমাতেন, গর্ভাবস্থা গোপন রাখার জন্য পরতেন ঢিলেঢালা পোশাক। আবার কেউ কেউ মেক্সিকো হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসতেন। নিউইয়র্কে এনে রাখা হতো কুইন্সের একটি বেসমেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে, যেখানে একঘরে থাকতেন ১০-১২ জন।
সন্তান জন্মের পর শুরু হতো জালিয়াতি। জন্ম সনদে জৈবিক মায়ের নাম লুকানো হতো, ভুয়া সম্মতি ফর্মে স্বাক্ষর নেওয়া হতো। অনেক সময় মায়েদের ড্রাগ ইনজেকশন দিয়ে অচেতন রাখা হতো। কিছু মায়ের পাসপোর্ট জব্দ করে রাখা হতো, যাতে তারা পালাতে না পারেন। শিশুকে হস্তান্তর করা হতো মধ্যরাতে, কোনো কোনো শিশুকে মলের পার্কিং লটে ডেলিভারি বাক্সে রেখেও পাঠানো হয়েছে। শিশু যেন পণ্য-অ্যামাজনের পার্সেলের মতো।
এই অপারেশনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক ছিল হাসপাতাল কর্মীদের সাথে নাসরিনের আঁতাত। মেডিকেল সেন্টারের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মী তার সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। সেন্টারের একজন কর্মকর্তা ডা. লিসা ম্যাঙ্গিয়েরি (ছদ্মনাম) ১০ হাজার ডলার নিয়ে জাল মেডিকেল রিপোর্ট তৈরি করতেন। কিছু নার্স শিশুদেরকে ‘স্টিলবর্ন’ ঘোষণা করে গোপনে বিক্রি করতেন। জন্ম সনদপত্রে জৈবিক মায়ের তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হতো। এফবিআই-এর তদন্তে ২৩টি সন্দেহজনক জন্ম নিবন্ধন শনাক্ত হয়, যার মধ্যে ১১টির ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রমাণ মিলেছে।
ক্রেতাদের প্রোফাইল ছিলÑধনী নিঃসন্তান দম্পতি, এলজিবিটিকিউ প্লাস দম্পতি, যারা আইনি দত্তক প্রক্রিয়ায় বাধার মুখে ছিলেন, এমনকি কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী। তাদের বলা হতো শিশুটি ‘সিরিয়ান যুদ্ধের অনাথ’ বা ‘মাদকাসক্ত মায়ের সন্তান।’ একজন ক্রেতা শিশুর মেডিকেল রেকর্ডে অসঙ্গতি পেয়ে এফবিআইকে তথ্য দেন।
প্রতিটি শিশুর মূল্য ছিল ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার ডলার। নাসরিন লাভ করতেন ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার ডলার। ব্রুকলিনে তিনি ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন, যা বর্তমানে এফবিআই বাজেয়াপ্ত করেছে। ৩৫ হাজার ডলার সমপরিমাণ একটি মনেরো ক্রিপ্টো ওয়ালেট এখনও এফবিআই আনলক করতে পারেনি।
এফবিআই এক গোপন স্টিং অপারেশন চালায়। একজন এজেন্ট ‘ক্রেতা’ সেজে নাসরিনের সঙ্গে দেখা করেন। নাসরিন বলেন- ‘মায়েদের কিছুই বুঝতে দেবেন না। জন্মের পর পাসপোর্ট বানিয়ে দেব।’ আদালতে তার ইমেইল পড়ে শোনানো হয়- ‘এই শিশুটা হোয়াইট কাপলের জন্য পারফেক্ট, দাম বাড়াও।’
আদালত নাসরিনকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেন। বর্তমানে তিনি কানেক্টিকাটের এফসিআই ডানবারি নারী কারাগারে আছেন। ২০২৩ সালে আপিল করেছিলেন, কিন্তু তা খারিজ হয়। সাজা শেষে ২০৪৫ সালে নাসরিনকে বাংলাদেশে ডিপোর্ট করা হবে। তার দ্বিতীয় স্বামী আব্দুল্লাহ আল মামুন, যিনি অর্থ পাচার ও জাল ডকুমেন্ট প্রস্তুত করতে সাহায্য করেছিলেন, তিনি ১০ বছরের সাজা পেয়েছেন, যিনি বর্তমানে নিউজার্সির ফেডারেল জেলে আছেন। তার বোন মরিয়ম আক্তার নিউইয়র্কে থাকতেন এবং অর্থ পাচারে সহায়তা করতেন। প্লিয়া ডিলের কারণে তিনি মুক্তি পেয়েছেন।
ভুক্তভোগী নারীদের গল্প ছিল হৃদয়বিদারক। রংপুর থেকে আসা রিনা বেগম (২৩) বলেন- ‘আমার শিশুটিকে সাময়িক দেখাশোনার কথা বলা হয়েছিল। আমাকে ২ হাজার দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। পরে শুনি, শিশুটিকে ৬৫ হাজার ডলারে বিক্রি করা হয়েছে।’
৭ জন মাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ২ জন আত্মহত্যা করেছেন। আর ২ জন মা টি-ভিসা (ট্রাফিকিং ভিকটিম ভিসা) পেয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছেন।
মোট ১১টি শিশু পাচারের প্রমাণ মিলেছে। তাদের জন্য আড়াই লাখ ডলারের ট্রাস্ট ফান্ড তৈরি করা হয়েছে, যা তারা ১৮ বছর হলে পাবে। এফবিআই সন্দেহ করছে, আরও অনেক শিশু পাচার হয়েছে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে অনেক কেস বন্ধ। 
এই কাহিনী শুধু শিশু পাচারের নয়। এটি আধুনিক দাসপ্রথা, অর্থলোভের নগ্ন উন্মাদনা এবং মানবিক ব্যর্থতার এক জীবন্ত দলিল। এখনও প্রতি বছর ১০-১৫টি অনুরূপ কেস বিশ্বজুড়ে রিপোর্ট হয়। কিন্তু নাসরিন কেস তার জটিলতা এবং নিষ্ঠুরতায় অনন্য। 
২০২২ সালে নিউইয়র্ক টাইমস নাসরিনকে নিয়ে ‘হাউ এ ব্রুকলিন ওম্যান ট্রাফিকড বেবিজ ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জনপ্রিয় অটিটি প্লাটফর্ম ‘নেটফ্লিক্স’ তার জীবন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করতে যাচ্ছে ‘দ্য বেবি ব্রোকার’ নামে। 
 

কমেন্ট বক্স