পরস্পরের বিরুদ্ধে কেবল নানা মন্তব্যের বুলেট নয়, অডিও-ভিডিও পর্যন্ত ছাড়ছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ ফ্যাসিস্টবিরোধী দলগুলো। প্রমাণ করে দিচ্ছে নিজেদের চরম অসৎ-অনৈতিকতা। তাদের এখন কমন শত্রুর আসনে বিএনপি।
ব্লেম গেমে দলটিকে নির্বাচনের আগেই ঘায়েল করার সাইবার ক্রুশ ছোড়া হচ্ছে নন-স্টপে। এ বিষয়ে জামায়াত-এনসিপি এককাট্টা। পদযাত্রার চলতি পথে সোমবার রাতে বরিশালের চরমোনাই মাদ্রাসা দরবারে গিয়েও হাজির হন এনসিপি নেতারা।
পীর চরমোনাই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম আগে থেকেই ছিলেন অপেক্ষমাণ। দলের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেই চরমোনাইর দরবারে গেছেন বলে জানিয়েছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। আর ফয়জুল করীম বলেন, এনসিপি এবং তাদের বক্তব্য বেশ কাছাকাছি। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদের মেসেজ পরিষ্কার। বিশেষ করে, জুলাই পদযাত্রার নামে এনসিপির সাম্প্রতিক অভিযাত্রায় বেশ চাঞ্চল্য। কিছুটা জিয়াউর রহমানের ধাঁচ নাহিদ-হাসনাত-সারজিসদের মধ্যে। গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষ এবং সফরসঙ্গী মন্ত্রী-আমলাদের সঙ্গে নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে, নিজে কোদাল হাতে খাল খাটা প্রোগ্রাম উদ্বোধন করে এক নতুন রাজনীতি শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সে প্রসঙ্গেই তিনি কথায় কথায় বলেছিলেন, আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান।
রাজনীতির এক শ্রেণি এর অর্থ বিকৃত করেছে। জিয়ার ওই কথা নিয়ে সাড়ে চার দশক ধরে তারা ট্রল করেছে। জিয়াউর রহমানের ওই ইংরেজির বাংলা তরজমায় এখন হাসনাত আবদুল্লাহরা বলছেন, আমরা রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেব। বিএনপি স্বাভাবিকভাবেই এ উক্তির ট্রল করতে পারছে না। তার ওপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান স্বয়ং তারেক রহমানই নতুন করে ট্রলের শিকার। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ নেতারা তার যে সমালোচনা করতেন, জামায়াত-এনসিপি-ইসলামী আন্দোলন তা করছে আরও হাই ভলিউমে। এ প্রশ্নে মারাত্মক দুর্বিনীত তারা। গত দেড় যুগে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আচরণের যে পাঠ নিয়েছেন, তা তার সাম্প্রতিক কথাবার্তায় স্পষ্ট হয়েছে। এর সুবাদে তিনি দলকে যতখানি এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কিছুদিনে তার চেয়ে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে তার দলের লোকেরাই। তাদের লাগামহীন, অভব্য এবং অদূরদর্শী কথাবার্তা এবং চাঁদাবাজি-তোলাবাজি মানুষকে চরমভাবে বিরক্ত করে তুলেছে।
জামায়াত-এনসিপিসহ অন্যরা ষোলো আনা এ সুযোগটি নিয়েছে। কদিন ধরে তার বিরুদ্ধে এমন সব অশোভন স্লোগান হচ্ছে, যা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করাও কঠিন। এর পেছনে ভেতর-বাইরের অন্য কোনো লুক্কায়িত শক্তি রয়েছে কি না, তা নিয়ে একটি ঘোর তৈরি হয়েছে। পুরান ঢাকায় যুবক সোহাগ হত্যার নিষ্ঠুরতাকে নিয়ে জামায়াতের অতিরাজনীতি স্পষ্ট। তারা এই লাশকে পুঁজি করে ভোট বাড়ানোর অঙ্ক কষছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিষ্ঠুরতার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। জগন্নাথের সামনে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে, বুয়েটে আবরারকে পিটিয়ে, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যাকাণ্ড নিয়েও এ রাজনীতি হয়েছে। যে যেভাবে পেরেছে অন্যকে ঘায়েল করেছে। এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় টার্গেটে বিএনপি। আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেকোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার দায়ভার তাৎক্ষণিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হতো বিএনপি-জামায়াতের ওপর। যেকোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হতো। এখন সেটার একক শিকার বিএনপি। আর ঘটক-অনুঘটক জামায়াত-এনসিপি। একসময় আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা ছিল, তারেক রহমান রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। এখন জামায়াতের নেতাকর্মীরা সেই একই প্রচারণাকে হাতিয়ার বানিয়েছেন। সেই প্রোপাগান্ডার ‘গ্র্যান্ড মাস্টার’ এখন অন্যদিকে। বিএনপি ফ্যাসিবাদের পথে হাঁটছে! আওয়ামী লীগকে অনুসরণ করছে, মুজিববাদ জিইয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে- এসব ন্যারেটিভ বেশ বাজার পাচ্ছে। দোষারোপের রাজনীতির পুরোনো খেলা আবার জমছে।
পুরান ঢাকায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুজন খুনি জাতীয়তাবাদী যুবদলের কর্মী। তাদেরকে দল থেকে প্রতিপক্ষকে খুন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কি না, এ প্রশ্ন করার অপেক্ষা থাকছে না। বলা হচ্ছে, সব দোষ তারেক রহমানের। তার নির্দেশেই সব হয়-হচ্ছে। যুবদল এরই মধ্যে ওই দুজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করলেও যত দায় ঠেকানো হচ্ছে তারেক রহমানের ঘাড়ে। তা বাজার পাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থাও হচ্ছে। বাজার বুঝেই মার্কেটিং। লুকিয়ে চাপিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-সমর্থকেরা সরব হয়ে উঠেছে। পুরান ঢাকাতেই দিনদুপুরে প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎ হত্যা বা বায়তুল মোকাররমের সামনে লগি-বৈঠা দিয়ে হত্যা শেষে লাশের ওপর নৃত্য করার ঘটনা এখানে বাধা হচ্ছে না। জামায়াত থেকে বলা হয়েছে, পুরান ঢাকায় পাথর দিয়ে হত্যা বায়তুল মোকাররমের ঘটনাকেও হার মানিয়েছে। যে সময়ে আওয়ামী লীগ নিজেই বিভ্রান্ত, জনবিচ্ছিন্ন ও আত্মরক্ষামূলক রাজনীতিতে ব্যস্ত, তখন বিএনপির এ দুর্গতি জাতীয় পার্টিকেও আশা দেখাচ্ছে। এরই মধ্যে অবিশ্বাস্যভাবে তারা মাঠেও নেমে পড়েছে।
ভাঙতে ভাঙতে ছয়-সাত টুকরা হওয়া অবশিষ্ট জাতীয় পার্টিতে একদিকে ভাঙনের সুর, অন্যদিকে ঐক্যের আহ্বান। জাতীয় পার্টির বিভিন্নপন্থী নেতাদের পাশাপাশি সদ্য অব্যাহতি পাওয়া নেতারা এই ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। অতীতের জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন তারা। আবারও ঐক্য গড়তে তারা এক মঞ্চে উঠেছেন। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে স্মরণসভা করেছেন পল্লীবন্ধু এরশাদ স্মৃতি সংসদের ব্যানারে। সেখানে জাতীয় পার্টির রওশন, কাজী জাফর, মঞ্জু ইত্যাদি পন্থী নেতাদের পাশাপাশি জাপা থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া নেতারাও উপস্থিত হন। এ সময় আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কাজী ফিরোজ রশিদ, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নুর একসঙ্গে হওয়া একদিকে ঘটনা, আবার এর নেপথ্য আয়োজন নিয়েও অনেক কথা ঘুরছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তো বলেই ফেলেছেন, বুর্জোয়া রাজনীতিতে বিপ্লব হয় না। যারা এ দেশে গণতন্ত্রের লড়াই করেছে, তারা বড় স্বৈরাচার। রাজনীতির হালদশাকে অনুকূলে দাবি করে ক্ষমতার রাজনীতিতে জাতীয় পার্টিকে প্রভাবশালী করতে ঐক্যের আহ্বান জানান রওশনপন্থী জাতীয় পার্টির মহাসচিব কাজী ফিরোজ রশিদ। আসন্ন নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির বিকল্প নেই বলে জানান জাপা থেকে অব্যাহতি পাওয়া মুজিবুল হক চুন্নু। ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি গড়তে কাউন্সিলের মাধ্যমে দায়িত্ব বণ্টনের আওয়াজও দেন চুন্নু।